অসহনীয় রোদ থেকে বাঁচতে ভরসা চাদর। ভূপেন বসু অ্যাভিনিউয়ে। শুক্রবার দুপুরে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
যতীন দাস পার্ক স্টেশন থেকে বিকেল সাড়ে তিনটের নন-এসি মেট্রো। প্রবল গরমে হাতল ধরে কোনও মতে দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তির হাতের ঘাম কনুই বেয়ে পড়ছে। সামনে সাত জনের আসনে ঠেসেঠুসে বসে ন’জন। তাঁদেরই এক জন বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘‘আরে দাদা, ঘাম গায়ে পড়ছে। একটু দেখুন!’’ কথাগুলো যাঁকে বলা হল, এ বার তিনিও প্রবল বিরক্ত। সপাটে উত্তর দিলেন, ‘‘গরমে ঘাম পড়বেই। আপনি দরকার হলে ছাতা খুলে বসুন।’’
রাগের বাক্যবাণ বা প্রবল পরাক্রমে একে অপরের দিকে তেড়ে যাওয়া চলল আরও কিছু ক্ষণ। কয়েকটি স্টেশন পরে দু’জনেই নেমে গেলেন সেই ঘামে ভেজা প্যাচপেচে চেহারাতেই।
আবহবিদদের বড় অংশই বলছেন, আপেক্ষিক আর্দ্রতা এমন অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে গিয়েছে যে, প্রবল ঘাম হতে বাধ্য। ঘরের তাপমাত্রায় পাখার নীচে দাঁড়ালেও ঘাম ঝরবে। আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে তাঁরা বলছেন, এখনই কলকাতায় কালবৈশাখীর দেখা পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। সব মিলিয়ে এই হাঁসফাঁস পরিস্থিতিতে শহরবাসীর মাথা ও শরীর— দুই-ই ঠান্ডা রাখা শক্ত বলে মনে করছেন চিকিৎসকেরা।
গরমে সুনসান শ্যামবাজার। শুক্রবার দুপুরে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের শিক্ষক-চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার এই গরমে সুস্থ থাকতে বাইরের কাটা ফল ও ফাস্ট ফুড খাওয়া বন্ধ করতে বলছেন। তাঁর কথায়, ‘‘কাটা ফল ও মশলা দেওয়া উচ্চমাত্রার প্রোটিনযুক্ত খাবার যত খাওয়া হবে, হজমের গন্ডগোল বাড়বে। তার বদলে ঘরে পাতা বা কেনা টক দই, মরসুমি ফলের রস ও ডাবের জল বেশি করে খেতে হবে।’’ এই সময়ে দিনে অন্তত চার থেকে সাড়ে চার লিটার জল অবশ্যই খেতে হবে বলে জানাচ্ছেন তিনি। তাঁর আরও পরামর্শ, ‘‘হাল্কা রঙের পোশাক পরার পাশাপাশি শরীর যতটা সম্ভব ঢেকে রাখা দরকার। খুব প্রয়োজন না পড়লে সকাল ১০টা থেকে বিকেল তিনটের মধ্যে বাইরে না বেরোনোই ভাল।’’
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
শুক্রবার দুপুর একটা থেকে বিকেল চারটে পর্যন্ত শহরে ঘুরে দেখা গেল, সূর্যের তাপে কাহিল শ্যামবাজার মোড় প্রায় জনশূন্য। লোকজন কম শিয়ালদহের বৈঠকখানা বাজার ও রাসবিহারী মোড়েও। যাঁরা রাস্তায় বেরিয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগেরই মুখ-হাত ও গলা পর্যন্ত ঢাকা। ভূপেন বসু অ্যাভিনিউ ধরে যাওয়ার পথে লরির মাথায় বসা এক যুবক আবার গোটা শরীরে চাদর জড়িয়ে নিয়েছেন। হাওয়ায় উড়তে থাকা সেই চাদর দেখে এক ট্র্যাফিক পুলিশকর্মী বললেন, ‘‘কী করবে? যা রোদ, কেউ পেরে উঠছে না।’’ নিজের মোটরবাইকে রাখা ঠান্ডা জল বার করে বললেন, ‘‘গরমে মারা পড়ার অবস্থা। কোনও মতে লড়ে যাচ্ছি।’’
শুধু গরম নয়, এ দিন গায়ে ছেঁকা দিয়েছে অ্যাপ-ক্যাবের চড়া ভাড়াও। ফলে এসি-র আরামে গন্তব্যে পৌঁছনো সম্ভব হয়নি অনেকের পক্ষেই। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে দেখা গেল, মহম্মদ আলি পার্কের কাছে বস্তা কাঁধে এক মোটবাহক ফ্যালফ্যালে চোখে চেয়ে আছেন কাচ তোলা এসি গাড়ির ভিতরের দিকে।
কোনও মতে রাস্তা পার হয়ে হাজরা মোড়ের এক মিষ্টির দোকান থেকে আবার জলের পাত্র চেয়ে নিলেন এক বৃদ্ধ। মাথায়, ঘাড়ে জল দেওয়ার পরে জড়ানো গলায় বললেন, ‘‘শরীরটা ভাল লাগছে না। বুক ধড়ফড় করছে।’’
হৃদ্রোগ চিকিৎসক বিশ্বকেশ মজুমদারের বক্তব্য, ‘‘এই গরমে ডিহাইড্রেশন হয়ে শরীরে সোডিয়াম-পটাশিয়ামের মাত্রায় গন্ডগোল দেখা দিতে পারে। যার ফলে খুব দুর্বল লাগে। যত বেশি সম্ভব জল খাওয়াই এই বিপদ এড়ানোর একমাত্র রাস্তা।’’ তাঁর পরামর্শ, ‘‘যাঁদের হার্ট ফেলিওর হয়েছে, এই গরমে তাঁদের একেবারেই বাইরে বেরোনো উচিত নয়। হার্ট ফেলিওর হওয়া লোকজনকে দিনে এক লিটারের বেশি জল খেতে বারণ করা হয়। কিন্তু এই সময়ে একটু বেশি জল খেতে পারেন তাঁরা।’’ শিশুরোগ চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষের আবার দাবি, এই সময়ে বাচ্চাদের স্বাস্থ্য ঠিক রাখা সব চেয়ে কঠিন কাজ। তাঁর কথায়, ‘‘হাল্কা পোশাক পরানো ও ভিজে গামছায় গা স্পঞ্জ করানোর পাশাপাশি শিশুদের হাই প্রোটিন ডায়েট একদম বন্ধ রাখা দরকার। আরও বেশি সময় তারা যেন ঘরে থাকে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে।’’
দিনের শেষে চাঁদনি চকে দাঁড়িয়ে অফিস ফেরতা এক জনও বলছিলেন, ‘‘গরমে আর ভাল লাগছে না। ঘর অন্ধকার করে চুপচাপ পড়ে থাকতে ইচ্ছে করছে।’’
চোখে-মুখে ক্লান্তি স্পষ্ট!