বাঁশদ্রোণীকাণ্ডে মৃত স্কুলপড়ুয়া। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
শনিবার শাস্ত্রমতে বিজয়া! দুর্গাপুজোর দশমী। মা দুর্গার চলে যাওয়ার বিষণ্ণ দিন। কিন্তু বাঁশদ্রোণীর শঙ্কর শীলের জীবনের পঞ্জিকায় বিদায়ের দিন লেখা হয়ে গিয়েছে অনেক আগে। সেই মহালয়ার সকালে।
গীতানগরে খালের উপর নড়বড়ে বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে বাড়িটা। বাড়ির সামনের এখনও কাদা শুকোয়নি। সাঁকোর পরে কাদা-মাটির রাস্তায় ইট পাতা। এক কামরার ঘর। সেই ঘরের সামনে ছোট্ট বারান্দায় রান্নার গ্যাস রাখা। বাড়ির বাইরের দিকে উপরের ঘরটা যাওয়ার জন্য লোহার সিঁড়ি। সিঁড়ি? না কি লোহার মই? কোনওমতে সেই মই বেয়ে উঠে বৃদ্ধা অঞ্জলি শীল বললেন, “টাকা ধার করে নাতির জন্য এই ঘর বানানো হয়েছিল বছরখানেক আগে। পড়াশোনায় ওর খুব মন ছিল। এই ঘরে ও নিজের মতো থাকতে পারবে বলে ছেলে বানিয়ে দিয়েছিল।”
বিছানায় বসে অঞ্জলি বলতে শুরু করেন, ‘‘ছোট বাড়িতে ছ’জনের সংসার।” আচমকা থমকান তিনি। কয়েক লহমার বিরতি। তার পর শ্বাসবায়ুর শব্দে ভেসে আসে, ‘‘এখন তো পাঁচ জন!” ছয় থেকে পাঁচ জনের হয়ে যাওয়া অঞ্জলির সেই সংসারের কর্তা তাঁর ছেলে শঙ্কর। শঙ্কর শীল। যাঁর পুজো শেষ হয়ে গিয়েছে মহালয়ার দিন সকালেই।
ই-রিকশা চালক শঙ্করের বড় ছেলে সৌম্য মহালয়ার সকালে পুজোর পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছে। বাঁশদ্রোণীর সেই ঘটনা ঘিরে উত্তাল হয়েছে জনরোষ। দিনভর পুলিশের সঙ্গে বচসা আর ধস্তাধস্তি হয়েছে জনতার। পুলিশের ওসি-কে কাদাজলে দাঁড় করিয়ে ‘শাস্তি’ দিয়েছে ক্রুদ্ধ জনতা। বিশাল বাহিনী নিয়ে গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়েছে পুলিশকে। দুর্ঘটনা নিয়ে গণবিক্ষোভের চাপে দীনেশনগরে রাস্তা তৈরির কাজও শুরু হয়েছে। গণবিক্ষোভের চাপে? না কি এক কিশোরের জীবনের বিনিময়ে?
রূঢ় বাস্তবের সঙ্গে এখনও ধাতস্থ হতে পারেননি সদ্য সন্তানহারা মা। ছোট এক কামরার ঘরের খাটে প্রায় সংজ্ঞাহীন অবস্থায় সারা দিন শুয়েই আছেন সৌম্যর মা মাধু। চিকিৎসক বলে গিয়েছেন, এখন মাধুর সামনে সৌম্যর কথা বলা যাবে না। তাই শীল পরিবারের সকলে ঠোঁটে আঙুল রেখে চুপ থাকতে ইশারা করছিলেন আগন্তুককে। সন্তানহারা মায়ের বাবা ফণী দাস চাপা স্বরে বললেন, “ও জাগলেই ‘বাবু-বাবু’ বলে ডাকছে! ছেলেকে খুঁজছে! এখানে দয়া করে কোনও কথা বলবেন না।”
ফণীই বলছিলেন, ফি-বছর পুজোর প্রথম কয়েকটা দিন বাঁশদ্রোণীর বাড়িতে কাটিয়ে সৌম্যরা চলে যেত গড়িয়ায় তাঁর বাড়ি। এ বছর যাওয়ার কথা ছিল সপ্তমীতে। ক্যানসারে আক্রান্ত ফণী বলছিলেন, “পুজোয় ওরা আমার বাড়িতে চলে যেত। ওখানেই নতুন জামা কেনা, ঠাকুর দেখা সব হত।” এ বছরও এক দিন রাত জেগে ঠাকুর দেখার কথা ছিল। অসুস্থ ফণী অবশ্য নাতিদের ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যেতে পারতেন না। এমনিতেও বাড়ি থেকে বিশেষ বেরোনো বারণ তাঁর। তাই প্রতি রবিবার সৌম্যই গড়িয়া যেত দাদুর খোঁজ নিতে।
মহালয়ার সেই সকালে খালের উপরের নড়বড়ে সাঁকো পেরিয়ে গৃহশিক্ষকের কাছে যাচ্ছিল সৌম্য। সাইকেল নিয়ে ডান দিক-বাঁ দিক সামলে সাঁকো পেরিয়ে ও পারে নেমে গিয়েছিল। তখনই দীনেশনগরের রাস্তায় কাজ করছিল বিভীষণ পে লোডার। গর্ত-জল-কাদা ভরা রাস্তায় স্টিয়ারিং আয়ত্তে ছিল না চালকের। তার অতিকায় দাঁড়ায় পিষে যায় বছর পনেরোর কিশোর। তার দেহ থেকে যখন বেরিয়ে যাচ্ছে প্রাণ, তখনও টিন আর ইটের তৈরি তার একলা ঘরের বিছানায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে বইপত্র।
সৌম্যর খাটের পাশে টেবিলের উপর এখনও রাখা একটা ডায়েরি। তার পাশে অনেক তার, টুনি বাল্ব, ইলেকট্রিকের যন্ত্রপাতি। পাশে পড়ে রয়েছে স্কুলের পরিচয়পত্র। শঙ্কর ডায়েরির পাতা উল্টে দেখাচ্ছিলেন অকালে চলে-যাওয়া ছেলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। কোনও পৃষ্ঠায় হাতে আঁকা গাড়ির যন্ত্রাংশ। একটি পৃষ্ঠায় লেখা ‘পাওয়ারফুল ফ্যান’, অন্য এক পৃষ্ঠায় ‘আরসি কার’, কোনও পাতায় ‘প্ল্যানেটরি গিয়ার সেট’ তৈরি করতে কী কী দরকার পড়তে পারে, সেই তালিকা লিখে রাখা। সৌম্যর দাদু বলে যাচ্ছিলেন, ‘‘ও বলত, ও গাড়ি তৈরি করবে। শুধু গাড়ি তৈরির পরিকল্পনাই নয়, এই ঘরে বসেই হাতের কাছে থাকা জিনিসপত্র দিয়ে আরসি কার তৈরিও করেছিল। ওর বাবার মোবাইলে তার ভিডিয়ো করে সেটা আপলোডও করেছিল।’’ বাবা শঙ্কর বললেন, “বাড়িতে এটা-ওটা বানাত। ইংলিশে কথা বলে ভিডিয়ো বানিয়ে ইউটিউবে দিত। এ সব নিয়ে বাড়িতে বেশি আলোচনা না করলেও বলত, বড় হয়ে নিজের হাতে গাড়ি বানাবে।’’
নিজের বিজ্ঞানচর্চার খরচের জন্য লক্ষ্মীর ভাঁড়ে কয়েন জমাত সৌম্য। টেবিলের এক পাশে রাখা সেই প্লাস্টিকের ভাঁড়। শঙ্কর বলছিলেন, ‘‘ওটাতেই টাকা জমাত। কখনও দরকার পড়লে আমার কাছে চেয়ে নিত।’’ তার পরে একটা দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে ভেসে এল, ‘‘এখন শুধু ওর আঁকা, লেখা খাতাগুলো দেখছি। আমি তো কিছু বুঝতেও পারছি না। ছেলেটা বুঝত। গাড়ি বানানোই ওর স্বপ্ন ছিল। আমার রিকশায় ছোটখাটো সমস্যা হলেও ওর যন্ত্রপাতি নিয়ে বসে পড়ত। বিশ্বকর্মা পুজোতেও আমার গাড়িতে আলো লাগিয়ে দিয়েছিল জয়।’’
পুত্রশোকে বিহ্বল সৌম্যর মায়ের পাশে থাকার জন্য তাঁর বোন মধুমিতা এসেছেন। তিনিও বলছিলেন, ‘‘ছেলেটার যন্ত্রপাতির শখ ছিল। আমার স্বামীর চশমা তৈরির যন্ত্র, ইলেকট্রনিক্সের কাজ দেখে দেখে জয় যন্ত্রপাতি নিয়ে এটা-সেটা তৈরি করে ফেলত। বছর দেড়েক আগে আমার স্বামী ওর সাইকেলটা জয়কে দিয়ে দেয়। ওটা চেপেই যাতায়াত করত জয়।’’
জয়। সৌম্যর আদরের ডাকনাম।
আর পাঁচটা গৃহস্থালির মতো এককোণে ঠাকুরের আসন। বাইরে দুর্গাপুজোর আবহ। কিন্তু এই ঘরে আলো নেই, আনন্দ নেই, নতুন জামার গন্ধ নেই। আছে সন্তানহারা বাবার চোখের জল। আছে তাঁর বিলাপ, ‘‘আর কোনও বছরই আমাদের পুজো আসবে না। তবে মহালয়ার দিনটা এলে ছেলেটার কথা মনে পড়বে খুব।’’
আগমনীতেই বিজয়ার বিদায় লেখা হয়ে গিয়েছে শঙ্করের জীবনপঞ্জিকায়। অকাল বিজয়া!