দেবাশিস হালদার। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
ধর্মতলার মোড়ের অনশন মঞ্চে গেলে পাওয়া যাবে তাঁদের। এক জন আমরণ অনশনে বসেছেন। অন্য জন আরজি কর আন্দোলনের ‘মুখ’। প্রথম জন স্নিগ্ধা হাজরা। দ্বিতীয় জন দেবাশিস হালদার। নড়বড়ে অনশন মঞ্চ তাঁদের পুজো মণ্ডপ। আন্দোলনই তাঁদের কাছে পুজো। ঘটনাচক্রে, সম্পর্কে তাঁরা স্বামী-স্ত্রী।
দু’জনেই কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের জুনিয়র চিকিৎসক। মাস ছয়েক আগে বিয়ে হয়েছে। বিবাহের পরে যুগলজীবনে এটাই প্রথম পুজো দেবাশিস-স্নিগ্ধার। আরজি করের নির্যাতিতার জন্য বিচার চেয়ে আমরণ অনশনে বসেছেন স্নিগ্ধা। দেবাশিস স্ত্রীর সঙ্গে অনশন মঞ্চে রয়েছেন। আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কখনও বই পড়ছেন দু’জনে, কখনও গলা মেলাচ্ছেন স্লোগানে। দু’জনের গলাতেই ঝরে পড়ছে ক্রোধ এবং ক্ষোভ। ঝরছে দাবি আদায়ের অঙ্গীকারও। পর ক্ষণেই হাসিমুখে একে অপরের দিকে চেয়ে থাকা। চাহনিতে পরস্পরের প্রতি আস্থা আর ভরসা। যা সম্বল করে অন্যদের সঙ্গে দাবি আদায়ের দীর্ঘ লড়াইয়ে নেমেছেন তাঁরা।
সেই লড়াই, সেই আন্দোলনের ‘মুখ’ তো তিনিই? দেবাশিস তেমন মনে করেন না। বরং তাঁর কথায়, ‘‘এখানে ‘আমি’ বলে কিছু নেই। পুরোটাই আমরা। আমরা সম্মিলিত ভাবে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। এখানে কারও একার কথায় কিছু হচ্ছে না।’’ হতে পারে। যে কোনও গণ আন্দোলনের এটাই দস্তুর। কেউ ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছুই করেন না। ‘আমি’ নয়, ‘আমরা’ই প্রাধান্য পায়। কিন্তু দেবাশিস সেই ‘আমরা’র মধ্যেও ‘আমি’ হয়ে উঠেছেন। হয়তো তাঁকে ‘আমি’ করা হয়েছে।
গত ৯ অগস্ট আরজি করের ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পরেই অ্যানাটমি বিল্ডিংয়ের সামনের গাছতলায় জড়ো হয়ে আন্দোলনের সলতে পাকানো শুরু করেছিলেন মেডিক্যাল কলেজের পড়ুয়ারা। পরে সেই প্রতিবাদ-আন্দোলনে দেবাশিস, স্নিগ্ধা-সহ অন্য মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক-পড়ুয়ারা একে একে যোগ দেন। দীর্ঘ প্রায় দু’মাস টানাপড়েনের মধ্যে তাঁদের আন্দোলনের চাপে পিছু হটেছে সরকার। তাঁদের দাবি মেনে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে কলকাতার পুলিশ কমিশনার-সহ তিন সরকারি আধিকারিককে। মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কালীঘাটের বাসভবনে গিয়ে বৈঠক করেছেন তাঁরা। তার আগে স্বাস্থ্য ভবনের সামনে অবস্থান-বিক্ষোভে গিয়ে হাজির হয়েছেন স্বয়ং মমতা।
প্রতিটি জমায়েতে, প্রতিটি বিক্ষোভে, প্রতিটি মিছিলে আগুয়ান থেকেছেন দেবাশিস। পাতলা চেহারা। গালে কোমল দাড়ি-গোঁফ। কপালের উপর নেমে আসা অবিন্যস্ত চুল। পরনে আটপৌরে পোশাক। কিন্তু গলায় ঝাঁজ। সাংবাদিক বৈঠকে তাঁকেই সামনে এগিয়ে দেওয়া হয়েছে বার বার। কণ্ঠস্বর খানিক উচ্চে তুলে, চিকন গলাকে আরও খানিক তীক্ষ্ণ করে চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন সরকারকে।
আরজি করের চিকিৎসক কিঞ্জল নন্দ, অনিকেত মাহাতোদের মতোই জনমানসে পরিচিত হয়ে গিয়েছেন দেবাশিস। জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের পরিচিত ফ্রেম হয়ে থেকেছে স্বাস্থ্য ভবনের সামনে অবস্থান-বিক্ষোভের মঞ্চে দেবাশিসের ভাষণ, মুখ্যমন্ত্রীর কালীঘাটের বাড়ির ফটকের সামনে বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে অন্যদের সঙ্গে তাঁর দাঁড়িয়ে থাকা, ধর্মতলায় মিছিলের সামনে বিরাট দেওয়াল ঘড়ি হাতে নিয়ে তাঁর বক্তৃতা করার দৃশ্য। রাজনীতিকদের ধাঁচে বক্তৃতা করেছেন দেবাশিস। তাঁর গলায় প্রায় সর্বদা থেকেছে প্রতিবাদের সুর। স্বাভাবিক। রাজনীতিতে তাঁর অভিজ্ঞতা আছে বইকি! আরজি করের আন্দোলনে যাঁরা যোগ দিয়েছেন, তাঁদের অনেকেই কোনও দিন রাজনীতির আঙিনায় পা রাখেননি। অনেকে এমবিবিএস পড়ার সময় থেকে সক্রিয় রাজনীতি করছেন। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অ্যানাস্থেশিয়া বিভাগে কর্মরত দেবাশিস কিন্তু আগে থেকেই ছাত্র সংগঠন পিডিএসএফের সঙ্গে যুক্ত। প্রতিবাদের মঞ্চে বসার সময় অবশ্য অন্যদের মতো তিনিও নিজের দলীয় বা সাংগঠনিক পরিচয় ভুলে গিয়েছেন। রাজনীতির রং, মতাদর্শ দূরে সরিয়ে রেখে আরজি করের আন্দোলনকে গণ আন্দোলনের রূপ দিয়েছেন। দেবাশিস হয়ে উঠেছেন সেই আন্দোলনের অন্যতম ‘মুখ’।
টানা কর্মবিরতি চলেছে। মাঝে আংশিক উঠেছে। তার পরে কর্মবিরতি পুরো তুলে নিয়েছেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। কিন্তু তাঁদের আন্দোলন থামেনি। ধর্মতলার মোড়ে আমরণ অনশনে বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জুনিয়র চিকিৎসকেরা। আর দেবাশিস বলছেন, ‘‘পুজো বা উৎসবের মরসুম হলেও আন্দোলনটা আমাদের চালিয়ে যেতে হবে। বিচারের অপেক্ষায় তো আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারব না। এই আন্দোলনটাই এ বার আমাদের কাছে পুজোর মতো।’’
পেশায় চিকিৎসক হওয়ায় এমনিতেই পুজো-উৎসব বলে কিছু থাকে না দেবাশিস-স্নিগ্ধার। পুজোর সময়েও ডিউটি করতে হয়। মাঝে এক দিন ছুটি পেলে দেবাশিস ফিরে যেতেন নিজের বলাগড়ের বাড়িতে। আর স্নিগ্ধা বাঁকুড়া চলে যেতেন বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু গত দু’মাসে ওলটপালট হয়ে গিয়েছে তাঁদের জীবন। আপাতত আন্দোলন ছাড়া কিছু ভাবতে পারছেন না দেবাশিস। তাঁর কথায়, ‘‘ডিউটি থাকে পুজোর মধ্যেও। সুযোগ পেলে সহকর্মী, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে একটু বেরোনো হত। কিন্তু এ বার তো বাড়িতেও ফিরব না।’’ পাশ থেকে স্নিগ্ধা বলেন, ‘‘আমরা চিকিৎসক। এমনিতেও পুজো বলে আলাদা করে কিছু থাকে না আমাদের। পুজোর সময়েও কাজ করতে হয়। মানুষের চিকিৎসা করতে হয়। এক দিন ছুটি পেয়ে বাড়ি ফিরি। এ বার তো আর সে সবের কোনও প্রশ্নই নেই। পুজোর মধ্যেও আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। আর কোনও রাস্তা নেই। এই আন্দোলন থেকে পিছিয়ে আসতে পারব না।’’
কত দিন চলবে তাঁদের আন্দোলন? দেবাশিস জানাচ্ছেন, যত দিন না আরজি করের নির্যাতিতা বিচার পাবেন। তাঁর কথায়, ‘‘এখন আমাদের আন্দোলন দুটো বিষয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এক, আমাদের সহকর্মীর বিচার। দুই, এই ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে সমাজে, তা নিশ্চিত করতে হবে প্রশাসনকে। তাই পুজোর মধ্যেও আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। এই মুহূর্তে প্রতিবাদটাই আমাদের কাছে উৎসব।’’
আরজি কর নিয়ে গণ আন্দোলনের আবহে পুজো-উৎসবে ফেরার ডাক দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। তা নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর ওই মন্তব্যের বিরোধিতা করে অনেকে সাধারণ মানুষকে বলেছেন, তাঁরা যেন উৎসবে না-ফেরেন। দেবাশিসেরা অবশ্য তেমন কোনও আহ্বান জানাচ্ছেন না। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা সাধারণ মানুষকে বলতে পারি না যে, আপনারা উৎসবে শামিল হবেন না। পুজো-উৎসবের সঙ্গে সত্যি সত্যিই অর্থনৈতিক বিষয় জড়িয়ে রয়েছে। এই উৎসব থেকে অনেকের রুজিরুটির জোগাড় হয়। এতে আমরা কোনও ভাবে বাধা দিচ্ছি না। দিতে চাইও না। কিন্তু আমাদের সহকর্মীর সঙ্গে যা ঘটেছে, তাতে আমরা মানসিক ভাবে এই পুজোয় বা এই উৎসবে অংশ নিতে পারছি না। এই আমরণ অনশনই তার প্রতিফলন।’’
দেবাশিসদের বিশ্বাস, সাধারণ মানুষ উৎসবে অংশগ্রহণ করলেও প্রতিবাদ-আন্দোলন থেকে তাঁরা সরে যাবেন না। তাঁদের মনে জমে থাকা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটবে উৎসবেও। দেবাশিসের কথায়, ‘‘আমাদের ধারণা, মানুষ উৎসবে অংশ নিলেও তাঁদের মনে প্রতিবাদের জায়গাটা থাকবে। সেটা আমরা দেখতেও পাচ্ছি। পুজোর থিম হিসাবে অনেকে শিরদাঁড়ার মডেল বানাচ্ছেন। এই শিরদাঁড়ার মডেল নিয়েই আমরা মিছিল করেছিলাম। বিনীত গোয়েলের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে শিরদাঁড়া উপহার দিয়ে এসেছিলাম। শুধু শিরদাঁড়াই নয়, আরও নানা রকম প্রতিবাদের ছাপ কিন্তু দেখা গিয়েছে এ বারের পুজোয়। প্রশাসনের উপর ক্ষোভ থেকে অনেকে সরকারের দেওয়া অনুদান ফিরিয়ে দিয়েছেন। শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে যে অনেকেই বেরিয়ে আসছেন, সেটাকেও আমরা এক উৎসব হিসাবেই দেখছি।’’
দেবাশিসের পুজো নেই। স্নিগ্ধার পুজো নেই। তাঁদের আছে প্রতিবাদের উৎসব। আন্দোলনের উৎসব।