নতুন দক্ষিণেশ্বর স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে নিজস্বী তোলার হিড়িক। ছবি: সুমন বল্লভ
এ-ও যেন আর একটি ‘দর্শনীয়’ স্থান!
কালী তীর্থ দক্ষিণেশ্বরে পুজো দিতে এসে কয়েক মিনিটের ঝটিকা সফরে অনায়াসেই দেখা নেওয়া যাচ্ছে সেই জায়গা। আর বিভিন্ন দ্রষ্টব্যের সামনে দাঁড়িয়ে ঝটপট তা মোবাইলে বন্দি করারও সুযোগ মিলছে অনায়াসে। সেই সঙ্গে অবশ্যই রয়েছে নিজস্বী তোলার হিড়িক।
দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের খুব কাছেই সেই জায়গা, দক্ষিণেশ্বর মেট্রো স্টেশন। মঙ্গলবার থেকে সাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে মেট্রোর উত্তর-দক্ষিণ করিডরের ওই স্টেশন। যার গোটাটাই সাজানো হয়েছে বাংলার সংস্কৃতি, শিল্প এবং অতীত-বর্তমানের বিভিন্ন ছবির সমন্বয়ে।
এ দিন সকাল ৭টায় প্রথম মেট্রো ছাড়ার কিছু ক্ষণ আগে স্টেশনের প্রবেশপথের মূল দরজা খুলতেই সেখানে ভিড় করতে শুরু করেন মন্দিরে আসা দর্শনার্থী থেকে আশপাশের এলাকার বাসিন্দারা। সেই ভিড় দেখা যায় রাত পর্যন্ত। আর যাত্রীরা ট্রেনে ওঠার আগে মোবাইলে বন্দি করলেন স্টেশনের বিভিন্ন রকম কারুকাজ। অনেকে আবার স্টেশনে ঢোকা থেকে ট্রেনে উঠে যাত্রা— গোটাটাই ভিডিয়ো কলে দেখালেন প্রিয়জনদের।
সকাল ৭টায় দক্ষিণেশ্বর থেকে ছাড়া প্রথম মেট্রোয় যাঁরা উঠেছিলেন, এমন কয়েক জন যাত্রীর কাছ থেকে তাঁদের অনুভূতির কথা শুনলেন
মেট্রোর আধিকারিকেরা। এ দিন সকালে টিকিট কাউন্টারের সামনে লাইনের একেবারে প্রথমেই স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন দক্ষিণেশ্বরের বাসিন্দা সন্দীপ ঘোষ। বললেন, ‘‘প্রথম দিনের মেট্রোয় চড়ার আনন্দ পেতেই স্ত্রী ও মেয়ের জন্য স্মার্ট কার্ড কিনে শ্যামবাজার পর্যন্ত গিয়েছিলাম।
আবার ফিরতি ট্রেনে ফিরে এসেছি।’’ একই ভাবে প্রথম দিনের ‘স্বাদ’ পেতে লাঠিতে ভর দিয়ে বারাসত থেকে দক্ষিণেশ্বরে চলে এসেছিলেন বৃদ্ধ দেবেন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য। বললেন, ‘‘নতুন মেট্রো স্টেশন দেখব বলে বেরিয়েছি।’’
দমদম থেকে দক্ষিণেশ্বরের দিকে যাচ্ছে প্রথম মেট্রোটি। মঙ্গলবার। ছবি: সুমন বল্লভ
অনেকে আবার গন্তব্যে পৌঁছতেও এ দিন মেট্রোয় চেপেছেন। যেমন, রবীন্দ্র সদনে মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিতে যাচ্ছিলেন মণীশ সাউ। তাঁর কথায়, ‘‘দক্ষিণেশ্বর থেকে দমদমে গিয়ে বাইক রেখে তার পরে মেট্রোয় চাপতাম। অনেক সময় লাগত। এখন হাতের মুঠোয় মেট্রো।’’ গিরিশ পার্কের আত্মীয়ের বাড়ি থেকে ফেরত ঋতুপর্ণা দাশগুপ্তের কথায়, ‘‘টালা সেতু বন্ধ থাকায় হুগলি থেকে উত্তর কলকাতা যেতে বহু সময় লাগত। তার উপরে যানজট তো রয়েছেই। মেট্রো চালু হওয়ায় সেই যান-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি মিলল।’’
প্রায় ৩৭ বছর আগের স্মৃতি নিয়েই এ দিন মেট্রোয় চেপে স্ত্রীকে নিয়ে দক্ষিণেশ্বরে পুজো দিতে এসেছিলেন মুদিয়ালির বাসিন্দা নীলমণি সরকার। তাঁর কথায়, ‘‘ভবানীপুর থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত প্রথম মেট্রো চালুর দিনও আমি তাতে চেপেছিলাম। আজ দক্ষিণেশ্বর পর্যন্ত চালু হতেই চলে এলাম পুজো দিতে।’’ তাঁদের মতো অনেকেই এ দিন মেট্রোয় চেপে এসেছেন দক্ষিণেশ্বর দর্শনে। বেলা যত বেড়েছে, দক্ষিণেশ্বর মেট্রো স্টেশনে যাত্রীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভিড় বেড়েছে সাধারণ লোকজনের। মেট্রো সূত্রের খবর, এ দিন দুপুর ২টো পর্যন্ত নতুন স্মার্ট কার্ড বিক্রি হয়েছে ৮৬০টি, পুরনো কার্ড রিচার্জ হয়েছে ৪১২টি।
দক্ষিণেশ্বর মেট্রো স্টেশনের মূল প্রবেশদ্বার থেকে দোতলার টিকিট কাউন্টার পর্যন্ত যেতে কোনও বাধা নেই। সেই কারণে ওই সব জায়গায় অনায়াসে ঘুরে বেড়িয়েছেন দর্শনার্থীরা। ডোমজুড় থেকে মন্দির দর্শনে এসে কিছু ক্ষণের জন্য স্টেশন দেখতে ঢুকেছিলেন রিয়াঙ্কা ঘোষ। প্রবেশপথের সামনে থাকা রামকৃষ্ণদেব, সারদাদেবী ও স্বামী বিবেকানন্দের মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে তুললেন ছবি। শুধু রিয়াঙ্কা নন, মেট্রো স্টেশনে ঢোকার মুখে ওই মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ছিলেন প্রায় সকলেই। সেখানে কয়েকটি ছবি তোলার পরেই চলমান সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে শহরের স্থাপত্যের অতীত-বর্তমানের ছবির কোলাজ মোবাইলে বন্দি করেছেন তাঁরা।
অনুপ খান্ডেলওয়াল নামে এক যাত্রীর কথায়, ‘‘ভিন্ রাজ্যের মেট্রোতেও চড়েছি, কিন্তু এত সুন্দর করে সাজানো স্টেশন খুব কম দেখেছি। মন্দিরের এত কাছে যদি এমন একটা জায়গা থাকে, তা হলে তো লোকজন দেখতে আসবেনই। শনি-রবিবার তো আরও ভিড় বাড়বে।’’
এক দম্পতিকে দেখা গেল, মন্দিরের সামনে গেট খোলার অপেক্ষা না করেই ছেলেকে নিয়ে নতুন স্টেশন দেখাতে চলে এসেছেন। স্টেশনে ঢোকার মুখে বাঁ দিকের বাগানে সাজানো মূর্তির একটি দেখে শিশুটি বলে উঠল, ‘‘ওই দেখ, কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি, বোঝাই করা কলসি হাঁড়ি।’’