Rabindranath Tagore

রবিঠাকুর কোন দলে, ধন্দ ভোট-হাওয়ায়

ভাবতে ভাবতে অর্থনীতির অধ্যাপক সৌরীন ভট্টাচার্যের মনে পড়ছিল, ১৯৬২-র ভোটের আগে উত্তর কলকাতার কলেজ রোয়ের মুখে একটি দৃশ্য।

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০২১ ০১:৪৪
Share:

প্রাসঙ্গিক: রাজনীতির ময়দানে বার বারই উঠে আসছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সুভাষচন্দ্র বসুর নাম।

সময়টা খুব ভাল যাচ্ছে না বিশ্বকবির! একটি সর্বভারতীয় টিভি চ্যানেলে তিনি ‘টেগোর’ না ‘ঠাকুর’ বলতে গিয়ে সদ্য দাবড়ানি খেয়েছে বাঙালি। তবু তাঁকে ঘিরে দলে দলে এমন টানাটানিও কবে দেখা গিয়েছে, কে জানে!

Advertisement

ভাবতে ভাবতে অর্থনীতির অধ্যাপক সৌরীন ভট্টাচার্যের মনে পড়ছিল, ১৯৬২-র ভোটের আগে উত্তর কলকাতার কলেজ রোয়ের মুখে একটি দৃশ্য। পাশাপাশি হোর্ডিংয়ে ‘রাশিয়ার চিঠি’ থেকে রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি। একটিতে সোভিয়েট রাষ্ট্র বিষয়ে প্রশস্তি, আর একটিতে সমালোচনার সুর। দু’টি বার্তার উদ্গাতা যথাক্রমে সিপিআই এবং কংগ্রেস। সে অবশ্য সদ্য রবীন্দ্র জন্ম শতবর্ষোত্তর আবহ। তবু ২০২১-এর ভোট দামামায় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এতটা মাতামাতি সৌরীনবাবুরও বেশ বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে। এটা স্পষ্ট, ‘বহিরাগত’ তকমা ঘোচাতে বিজেপিকে নিরুপায় হয়েই রবীন্দ্র-আশ্রয় খুঁজতে হচ্ছে। তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই বা কিসে কম যান! ইদানীং নিত্য ভোটনাট্যের রঙ্গমঞ্চ বোলপুরে দাঁড়িয়েই তিনি ঘোষণা করেছেন, এ বার লড়াই দানব বনাম মহামানবের! শুনলে খটকা লাগে, রবিঠাকুর নিজেই ভোটে দাঁড়াচ্ছেন বুঝি?

শিকাগোয় বসে ইতিহাসের অধ্যাপক দীপেশ চক্রবর্তীরও এমনটা মনে হয়েছিল বটে। হোয়াটসঅ্যাপে বিশ্ববিদ্যালয় মারফত তাঁর হাতেও মুসলিমদের সমালোচনায় ভরপুর রবীন্দ্র-উদ্ধৃতি। তিনি স্তম্ভিত, ‘কালান্তর’ গ্রন্থ থেকে রবীন্দ্রনাথের ‘হিন্দুমুসলমান’ লেখাটির প্রক্ষিপ্ত অংশ তুলে ধরে এ তো বদমায়েশি করে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা। অথচ, রবীন্দ্রনাথ সেখানে হিন্দুদেরও কড়া সমালোচনা করেছেন।

Advertisement

দীপেশবাবুরও মনে হচ্ছে, তামিলনাড়ুর ভোট-বাজারে নেতানেত্রীদের দৈত্যাকার কাট-আউটের মতো বাঙালি আইকনদেরও সাইজ় আচমকা বর্ধিত হয়েছে। এবং দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, তাঁদের সারবস্তুটি যাচ্ছে হারিয়ে। তাঁর কথায়, “আমেরিকায় বড়জোর কৃষ্ণাঙ্গ বিদ্বেষের সময়ে সাদারা সিভিল ওয়ারের সময়কার প্রতীক ব্যবহার করেন। আব্রাহাম লিঙ্কনও সচরাচর রাজনীতির আবর্তে নেমে আসেন না। অথচ ভারতীয়রা কিন্তু এখনও শিবাজী বা আওরঙ্গজেবের নামে দাঙ্গা বাধাতে পারে!”

গত লোকসভা ভোটের শিক্ষা বলছে, অমিত শাহের রোড-শো থেকে তাণ্ডবে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙচুরের পরে বিজেপির ফল খারাপ হয়েছিল। এই ভোটেও তাই স্রেফ শুভেন্দু অধিকারী নন, রবীন্দ্রনাথকেও হাতছাড়া করা চলে না! ভোট-সিলেবাসে শ্রীঅরবিন্দ পর্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বিবেকানন্দ থেকে সুভাষচন্দ্র— সবাইকে দলে টানাই সব দলের নীতি।

রাজনীতির লোকেদের মনীষী চর্চায় ততটা গভীরতা থাকে না। বাংলার ভোটে ধারাবাহিক ভাবে রবীন্দ্রনাথ বা ‘নেতাজি’-কে কবে কে, কী বলেছিল, সেই কাজিয়াই মুখ্য! এটা অস্বীকার করছেন না নাট্যকর্মী তথা মন্ত্রী ব্রাত্য বসু। তবে তাঁর চোখে, “বাম আমলে দীর্ঘদিন আলগা ভাবে মার্কস, লেনিনের ছবি ঝুলিয়ে রাজনীতির পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতিতে বাঙালি মনীষীদের স্মরণ অনিবার্য ছিল।”

‘‘আসলে সময়টাই এক ধরনের ফাঁপা, অন্তঃসারশূন্য রাজনীতির। বিবেকানন্দের ছবিটা থাকছে, কিন্তু সঙ্ঘ বা সাবেক হিন্দু মহাসভার সঙ্গে রামকৃষ্ণ মিশনের পার্থক্য আমরা মনে রাখছি না। রবীন্দ্রনাথও তাঁর ক্ষুদ্র বাঙালি ইমেজ নির্মাণে তিতিবিরক্ত হতেন”— বলছেন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব সোশ্যাল সায়েন্সেসের শিক্ষক মৈত্রেয়ী চৌধুরী। ইতিহাস কিন্তু মনীষী-সর্বস্বতার বাইরেও বাঙালি সত্তার এক অন্য নির্মাণের কথা বলে। মৈত্রেয়ী মনে করাচ্ছেন, “উনিশ শতকের আধুনিক বাঙালি প্রোগ্রেসিভ, কসমোপলিটান। বাঙালি হওয়ার সঙ্গে বিশ্বনাগরিক হওয়ার কখনও বিরোধ ছিল না।’’ ভোটের কিচিরমিচিরে এই কথাটা একেবারেই হারিয়ে যাচ্ছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement