—প্রতীকী চিত্র।
সরু গলির দু’দিকে বাড়ি। তেমনই একটি গলির মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা মধ্যবয়সি মহিলার শরীর দাউদাউ করে জ্বলছে। ওই অবস্থাতেই সেই মহিলা একটি বাড়ির দরজায় নাগাড়ে ধাক্কা দিয়ে চলেছেন। তাতেও অবশ্য খুলল না দরজা। অবশেষে দরজার সামনে বসেই নেতিয়ে পড়লেন মহিলা।
সোমবার রাতে হরিদেবপুরের ব্যানার্জিপাড়ার এই ঘটনায় চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, সোমবার রাত সাড়ে আটটা নাগাদ ১০০ ডায়ালে ফোন আসে। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বলা হয়, হরিদেবপুরের ব্যানার্জিপাড়ায় গলির ভিতরে একটি বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এক মহিলা গায়ে আগুন দিয়েছেন। ঘটনাস্থলে গিয়ে মহিলাকে ওই গলিতে পড়ে থাকতে দেখে হরিদেবপুর থানার পুলিশ। বাসিন্দাদের সাহায্যে দ্রুত মহিলাকে এম আর বাঙুর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার মৃত্যু হয় তাঁর। পুলিশ জানিয়েছে, মৃত্যুর আগে মহিলার জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত ওই মহিলার নাম পিঙ্কি পাণ্ডে (৪৪)।
ঘটনার তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পেরেছে, পিঙ্কির বাড়ি ভবানীপুর এলাকায়। বাড়িতে তাঁর বছর কুড়ির ছেলেও রয়েছেন। মাসকয়েক আগে হরিদেবপুরের ব্যানার্জিপাড়ার বাসিন্দা সুবীর বিশ্বাসের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সম্প্রতি ওই ব্যক্তির সঙ্গে মহিলার সম্পর্কের টানাপড়েন শুরু হয়। এমনকি, ওই ব্যক্তি বিভিন্ন ভাবে পিঙ্কিকে হুমকিও দিচ্ছিলেন বলে অভিযোগ। মহিলার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ছবি ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন বলেও অভিযোগ। এর পরেই ওই মহিলা সোমবার সুবীরের সঙ্গে কথা বলতে তাঁর বাড়িতে হাজির হয়েছিলেন বলে জানা গিয়েছে।
কিন্তু সুবীর বাড়ির দরজা না খোলায় বাইরে দাঁড়িয়েই নিজের গায়ে কেরোসিন তেল ঢেলে পিঙ্কি আগুন লাগিয়ে দেন বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা। কেরোসিন ওই মহিলা সঙ্গেই এনেছিলেন বলে অনুমান। ঘটনাস্থল থেকে কেরোসিন ও দেশলাই উদ্ধার করেছে পুলিশ। ওই ঘটনার পর থেকে অভিযুক্ত সুবীরকেও পাওয়া যাচ্ছে না।
এ দিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ব্যানার্জিপাড়ার বাসিন্দা সুবীরের বাড়ির সামনে সিমেন্টে বাঁধানো গলিতে পোড়া দাগ। তবে এলাকার বাসিন্দাদের দাবি, গলিটা এমনিতেই নির্জন। সোমবার সারা দিন বৃষ্টি হচ্ছিল বলে তাঁদের জানা নেই, কখন ওই মহিলা সুবীরের বাড়ির সামনে এসেছিলেন। অভিযুক্তের বাড়ির ঠিক উল্টো দিকের বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, হঠাৎ এক মহিলার চিৎকারে দোতলার বারান্দা থেকে তাঁরা দেখেন, অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় ওই মহিলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে। তাঁর শরীর তখন জ্বলছে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা দোতলা থেকে প্রথমে জলের বালতি দিয়ে ওই মহিলার গায়ে জল ছেটাতে শুরু করেন। কিন্তু ওই অবস্থাতেই মহিলা গেট খুলে ভিতরে ঢুকে বাড়ির মূল ফটকে ধাক্কা মারতে শুরু করেন।
এক প্রত্যক্ষদর্শী অনিরুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমি পাঁচিলের অন্য দিকে ছিলাম। দেখলাম, পাশের বাড়ি থেকে বালতির পর বালতি জল মহিলার গায়ে ঢালা হচ্ছে। তাতে ওই মহিলার শরীরের আগুন নিভে গেলেও গায়ের চামড়া ঝলসে গিয়েছিল। ওই অবস্থায় তিনি বার বার দরজায় ধাক্কা দেওয়া সত্ত্বেও সুবীরের বাড়ির ভিতর থেকে কেউ এক জন বলছিলেন, ‘দরজা খোলা হবে না’। আমরা ওঁকে সঙ্গে সঙ্গে ওই জায়গা থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাই।’’
মঙ্গলবার বিকেলে গিয়ে দেখা গেল, অভিযুক্তের বাড়ির চত্বরের গেটের তালা ভিতর থেকে বন্ধ। বার বার ডাকাডাকি করেও কোনও সাড়াশব্দ মেলেনি। গোটা ঘটনায় স্তম্ভিত এলাকার মানুষ। কয়েক জন বাসিন্দার আলোচনায় বার বার শোনা গেল আক্ষেপ, ‘‘এক জন মহিলা অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় বাড়ির দরজায় বার বার আঘাত করছিলেন। অথচ কেউ দরজা খুললেন না! এতটা অমানবিক কী করে কেউ হতে পারেন?’’
এ দিকে, অভিযুক্ত সুবীরের খোঁজ শুরু করেছে পুলিশ। একাধিক ধারায় মামলা রুজু করে গোটা ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে বলেও পুলিশ জানিয়েছে।