গান ভালবেসে: বেহালায় সঙ্গীতানুষ্ঠানে দূরত্ব-বিধি মেনে বসেছেন শ্রোতারা। শনিবার। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
‘‘দর্শক-শূন্য স্টেডিয়ামে আইএসএল বা টেস্ট ক্রিকেট হতে পারে। কিন্তু শুধুই শিল্পীরা মিলে অনুষ্ঠান আর ভাল লাগছে না’’— বলছিলেন কৌশিকী চক্রবর্তী। ফের অনুষ্ঠানে গেয়ে শ্রোতাদের সঙ্গে আগের মতো নিজস্বী তুলতে কিছুটা আশঙ্কাও থাকবে শিল্পীর। ‘‘তবু অনুষ্ঠানের কোনও বিশেষ মুহূর্তে সামনে তাকিয়ে কলাকুশলীরা শুধু ক্যামেরা দেখলে একটু ফাঁকা লাগে বইকি! রসিক দর্শকের মুগ্ধতার তাৎক্ষণিক প্রাপ্তির আমেজই আলাদা’’— বার বার বলছেন কৌশিকী।
প্রবীণ তবলাশিল্পী অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ও বলছেন, ‘‘অতিমারি বা করোনাভাইরাসকে সমীহ করতেই হবে। কিন্তু কারও জীবনযাপনই ১০০ শতাংশ নিরাপদ নয়। শিল্পীরা ছাড়া বাকিরা না-হয় মাস্ক পরেই অনুষ্ঠান শুনুন!’’ লকডাউনের আগে মুম্বইয়ে শিবকুমার শর্মার সঙ্গে অনুষ্ঠান এবং লখনউয়ে কর্মশালার পর থেকে শুধুই ঘরবন্দি অপেক্ষা চলেছে তাঁর। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে পা রেখে শনিবার বেহালা ব্লাইন্ড স্কুলের মাঠে প্রায় দশ মাস বাদে পুত্র অনুব্রতের সঙ্গে অনুষ্ঠান করলেন অনিন্দ্যবাবু।
সব কিছু ঠিক থাকলে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ডোভার লেনের সঙ্গীত সম্মেলনও সম্ভবত বাদ যাবে না কলকাতার রসিকজনের বচ্ছরকার মেনু থেকে। ‘‘শহরের সঙ্গীত ঐতিহ্য মনে হয় অক্ষুণ্ণ থাকবে। কিছু দিন বাদে সব কিছুর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হবে’’— বলছেন কর্মকর্তা বাপ্পা সেন। তার আগে বেহালা সাংস্কৃতিক সম্মিলনীর আয়োজনে বচ্ছরকার শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসর শহরকে সাহস জোগাচ্ছে। চলচ্চিত্র উৎসবের মতো বেহালার সঙ্গীতানুষ্ঠানও হচ্ছে নানা বিধিনিষেধ মেনে। উদ্যোক্তাদের তরফে সন্দীপন বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘আগে পাশাপাশি ২৬ জনের বসার জায়গা থাকত মাঠে। এ বার সেখানে দূরত্ব বাড়িয়ে বড়জোর ১৬ জন বসতে পারবেন। ১০০০ জনের জমায়েতের মাঠে ভিড় অর্ধেকেরও কম।’’ আগামী মঙ্গলবার, ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত চলবে সম্মেলন। অনলাইনে দেখা ও শোনার জন্য কিছু টিকিটের বন্দোবস্তও থাকছে।
এই পরিস্থিতিতে কলকাতাকে দেখে আশাবাদী ভিড়ের নিরিখে দেশের সব থেকে বড় সঙ্গীতানুষ্ঠান পুণের ‘সোয়াই গন্ধর্ব ভীমসেন মহোৎসব’ও। উদ্যোক্তাদের তরফে মুকুন্দ সাঙ্গোরাম বলছিলেন, ‘‘আমাদের অনুষ্ঠানে ১০-১৫ হাজার মানুষ টিকিট কেটে আসেন! ডিসেম্বরে কোভিড-বিধি মেনে ছোট হলে আসর বসাতে পারিনি। পরিস্থিতি ভাল হলে ২০২১-এ না-হয় দু’বার উৎসব করব।’’ রবিশঙ্করের জন্মশতবর্ষের বছর ২০২০ সাল অতিমারিতে কাবু ছিল। ২০২১ সালে ভীমসেন জোশী সেঞ্চুরি পূর্ণ করছেন। সেই শতবর্ষ অনুষ্ঠানের সূচনা উপলক্ষে অবশ্য সোয়াই গন্ধর্বের কর্তারা ধাপে ধাপে গোটা দেশে বা দেশের বাইরেও কিছু অনুষ্ঠান শুরু করতে পারেন। ফেব্রুয়ারি মাসে পুণেতে কিছু অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করা হয়েছে। ভীমসেন জোশীর কলকাতা-যোগ মাথায় রেখে এ শহরেও অনুষ্ঠান করানোর ইচ্ছে রয়েছে মুকুন্দের।
কলকাতার আশপাশে অন্য কিছু সঙ্গীত সম্মেলনও এখন আশায় রয়েছে। গোলপার্কের রামকৃষ্ণ মিশনে স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিনের অনুষ্ঠানের জন্য আগেই রেকর্ডিং সেরেছেন তবলা-শিল্পী শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। বলছেন, ‘‘ফেব্রুয়ারি, মার্চ থেকে বিভিন্ন অনুষ্ঠান বাড়বে।’’ শিল্পীদের মুখ চেয়ে গত বছরের শেষে গানমেলা-য় ছাড়পত্র দিয়েছিল রাজ্য সরকার। রবীন্দ্র সদন বা শিশির মঞ্চে সীমিত দর্শক নিয়ে সেই অনুষ্ঠান হয়েছে। রাজ্য সঙ্গীত অ্যাকাডেমির বার্ষিক অনুষ্ঠানের আহ্বায়ক, সরোদ-শিল্পী দেবজ্যোতি বসু বলছেন, ‘‘৩-৭ ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্র সদনে সব রকম সতর্কতা-বিধি মেনে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসর বসবে।’’ সঙ্গীত রিসার্চ অ্যাকাডেমির নির্ধারিত অনুষ্ঠান করা যায়নি গত ডিসেম্বরে। ফেব্রুয়ারি-মার্চে অনলাইন বা মুখোমুখি মিশিয়ে সেই অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা রয়েছে উদ্যোক্তাদের। সকলেই তাকিয়ে জানুয়ারির শেষে কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন কোভিড-বিধির দিকে।
কৌশিকী মনে করেন, ‘‘বদ্ধ প্রেক্ষাগৃহের বাইরে খোলা মাঠে প্যান্ডেলের অনুষ্ঠানই মনে হয় বেশি জুতসই হবে। আমার বাবাও (অজয় চক্রবর্তী) অন্য কাজে সাবধানতা মেনে কলকাতার বাইরে যাচ্ছেন। ফেব্রুয়ারিতে আমি মহারাষ্ট্রে অনুষ্ঠান করতে যাব।’’ শুভঙ্করের কথায়, ‘‘মনে পড়ছে না শেষ কবে এত দিন কলকাতায় থেকেছি। এই লম্বা সময়ে নিশ্ছিদ্র চর্চার পরে দর্শকদের মাঝে অনুষ্ঠান করার জন্য মুখিয়ে আছি।’’ তবু শীতের শহর তার চেনা সুরে ফিরবে কি না, কোভিড-পরিস্থিতিই তা ঠিক করে দেবে!