প্রতীকী ছবি।
কখনও করোনার সঙ্গে লড়তেলড়তে, কখনও কোলের সন্তানের মৃত্যুর পরে, কখনও আবার রোগগ্রস্ত বাবার মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ীকরে ঝাঁপ। বিগত কয়েক বছরে হাসপাতাল থেকে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুর ঘটনার কমতি নেই। একই প্রবণতা হাওড়া সেতু বা মা উড়ালপুল থেকে ঝাঁপের ক্ষেত্রেও। দিল্লিতে উঁচু মেট্রো স্টেশন থেকে এক মূক ও বধিরতরুণী ঝাঁপ দেওয়ার পরে তাঁর পকেট থেকে উদ্ধার হয় চিরকুট— ‘আমি বড় একা। একা বেঁচে থাকার চেয়ে নাথাকা ভাল।’
শনিবার মল্লিকবাজারের ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেসের আটতলা থেকে পড়ে গিয়ে সুজিত অধিকারী নামে এক রোগীর মৃত্যুর ঘটনাতেও শোরগোল পড়েছে। সময় পেলেও কেন তাঁকে উদ্ধার করা গেল না— সেই প্রশ্ন উঠেছে। তাঁর এমন আচরণের কারণ নিয়েও আলোচনা চলেছে দিনভর। তিনি অবসাদগ্রস্ত ছিলেন কি না, তা-ও জানার চেষ্টা চলছে। পুরনো ঘটনার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অবশ্য তদন্তে উঠে এসেছে এই অবসাদের দিকটিই।
এ দিনের ঘটনার সঙ্গে ২০১৯ সালের নাগেরবাজারের একটি বেসরকারি হাসপাতালের ঘটনার মিল রয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। সেখানে বছর একষট্টির এক প্রৌঢ় হাসপাতালের সাততলা থেকে ঝাঁপ দেন। তার পরেরদিনই তাঁর অস্ত্রোপচার হওয়ার কথা ছিল। মল্লিকবাজারের এই ঘটনায় হাসপাতাল জানিয়েছে, সুজিতবাবুকে সেখান থেকে রবিবারইছুটি দেওয়ার কথা ছিল। চলতি বছরে আর জি করের পাঁচতলা থেকে ঝাঁপ দিয়ে মারা যান বনগাঁর বছর ষাটেকের এক প্রৌঢ়। সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে তাঁর পা ভাঙে। হাসপাতালে ভর্তির পরে তাঁর ব্রেন টিউমার ধরা পড়ে। পরিবার জানিয়েছিল, এর জেরে তিনি অবসাদে ভুগছিলেন। সেবছরেই বীরভূমের রামপুরহাট হাসপাতালের ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন এক যুবক।
২০২১ সালে বাবার মৃত্যুর পরে হাসপাতালে গিয়ে আত্মঘাতী হন দুর্গাপুরের এক যুবক। বাবার মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী করে, দাদাকে মেসেজ পাঠিয়ে হাসপাতালের ছাদ থেকে ঝাঁপ দেন তিনি। মেধাবী ওই ছাত্রের তার কয়েক মাসের মধ্যেই বেঙ্গালুরুর একটিকলেজে পড়তে যাওয়ার কথা ছিল। ওই বছরেই শিয়ালদহের বি আর সিংহ হাসপাতালে পাঁচতলার জানলার কাচ ভেঙে পড়ে মৃত্যু হয় এক রোগীর। হৃদ্রোগে আক্রান্ত ওই রোগী এতটাই ছটফট করছিলেন যে, কেউ তাঁকে ধরে রাখতে পারেননি। কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কর্তব্যে গাফিলতির অভিযোগ তুলে রুজু করা মামলা এখনও চলছে।
চলতি বছরে এমন মৃত্যুর ঘটনা ঘটে মা উড়ালপুলেও। ডাক্তার দেখাতে যাচ্ছেন বলে জানিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে উড়ালপুল থেকে ঝাঁপ দেন এক প্রৌঢ়। পুলিশি তদন্তে জানাযায়, কয়েক মাসের মধ্যেই তাঁর মেয়ের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। ব্যবসায় মন্দার জেরে আর্থিক অনটনের কারণেই ওই সিদ্ধান্ত। মেয়ের বিয়ের টাকা জোগাড়ের চাপেই তাঁর এই পদক্ষেপ কি না, সেই প্রশ্ন উত্তরহীনই রয়ে যায়।
মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেব বলছেন, ‘‘কেউ দীর্ঘদিন ধরে রোগে ভুগলে, তাঁর মাথায়বিভিন্ন ধরনের চিন্তা আসে। তাই ওই রোগের চিকিৎসার সঙ্গে তাঁর মানসিক স্বাস্থ্যেরও খোঁজ নেওয়া দরকার। পরিবারের পাশাপাশি সকলের উচিত তাঁর সঙ্গে কথা বলা, তিনি যাতে নিঃসঙ্গ বোধ না করেন সে দিকে খেয়াল রাখা।’’
তবে হাওড়া সেতু থেকে অসমের যুবককে নামাতে অবশ্য সফল হয়েছিল পুলিশ। ডিব্রুগড়ের বাসিন্দা ওই যুবক মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন দিল্লি থেকে। কিন্তুসর্বক্ষণ নেশা করে থাকতেন। সঙ্গীদের পাল্লায় পড়ে কলকাতায় এলেও কিছুই করতে না পেরে শেষে হাওড়া সেতু থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মঘাতী হওয়ার পরিকল্পনা করেন। দীর্ঘ চার ঘণ্টা ধরে তাঁর সঙ্গে পুলিশের মনস্তাত্ত্বিক লড়াই চলে। তিনি যত বলেন, ‘‘মদ দাও, সিগারেট দাও’’, পুলিশ ততই কেক ও চা-বিস্কুট এগিয়ে দেয়। শেষে ওই যুবককে নামাতে পারেন পুলিশকর্মীরা। মাসখানেক চিকিৎসার পরে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় পরিবারের কাছে।