মনমোহন সিংহ-এর সঙ্গে জহর সরকার। ছবি: সমাজ মাধ্যম।
মনমোহন সিংহ কখনও নিজের সমস্যা নিয়ে অন্যের কাছে মুখ খুলতেন না। নীরবে যন্ত্রণা সহ্যকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। আর তাই আমরা প্রায় জানিই না তাঁর স্বাস্থ্য কতটা ভেঙে পড়েছিল, আজ আচম্বিতে চলে যাওয়ার পর যেন সম্বিৎ ফিরল।
তাঁকে দেখছি ১৯৯১ সাল থেকে। নরসিংহ রাওয়ের মন্ত্রিসভায় তিনি তখন অর্থমন্ত্রী। আমি বাণিজ্য মন্ত্রকের অধিকর্তা। আমার মন্ত্রী পি চিদম্বরম এক দিন একটি বন্ধ খাম ওঁর হাতে দিতে বলেন। তাঁর ঘরে যাওয়ার পরে আমাকে বসতে বললেন। সেই প্রথম নজর করলাম, কী ধবধবে ফর্সা তাঁর গাত্রবর্ণ, যা ছবিতে বোঝা যায় না। আরও দেখলাম কি অপরূপ সারল্য সেই মানুষটার যিনি দেশকে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের খাদ থেকে উদ্ধার করেছিলেন। আমরা সবাই তখন বিস্মিত হয়ে ভাবতাম এক জন কংগ্রেস নেতা হয়ে তিনি দীর্ঘদিন চলে আসা নেহরু-ইন্দিরার অর্থনীতির মডেল সরকারের নিয়ন্ত্রণ এবং পারমিট রাজকে চ্যালেঞ্জ করার মতো শক্তি কী করে পেলেন? বার্লিনের প্রাচীর ভাঙার তাঁর সেই টিমে আমরাও ছিলাম।
সরাসরি তাঁর সঙ্গে কাজ করেছি ২০০৯ সালের মে থেকে টানা ১৮ মাস সংস্কৃতি মন্ত্রকের সচিব হিসাবে। প্রতি সপ্তাহে ৭ নম্বর রেসকোর্স রোডে যেতাম আমি। অনেক সময় দীর্ঘ সময়ও থাকতে হতো। ধীরে ধীরে তাঁকে জানতে শুরু করলাম, বিভিন্ন মন ও মেজাজে তাঁকে দেখার সুযোগ পেলাম। কখনও ফিরতেন ক্লান্ত হয়ে দীর্ঘ মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর, কখনও বা বামেদের কাছ থেকে আক্রান্ত হয়ে। সামান্য কিছু ক্ষণের বিষণ্ণতা ঝেড়ে ফেলে এক গ্লাস জল খেয়ে আবার কাজ শুরু করতেন। কখনও দেখতাম লনে একটু হেঁটে নিচ্ছেন বা সামান্য ফ্রি হ্যান্ড করছেন। বছর খানেক পর যখন তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা সামান্য বাড়ে, কখনও সখনও তাঁর স্বল্পপাল্লার হাঁটার সঙ্গীও হতাম। আমরা হেঁটে যেতাম কোনও কথা না বলে। মনে আছে এক বার সংস্কৃতি জগতের কোনও কেষ্টবিষ্টুর আচরণে বেজায় বিরক্ত হয়ে আমায় জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কী ভাবে আমি ওঁদের সঙ্গে দিন রাত কাজ করি? বলেছিলাম সৃজনশীল মানুষের মেজাজ মর্জি প্রায়ই বদলাতে থাকে। ওঁর মুখ দেখে বুঝলাম আরও খোলাখুলি জানতে চাইছেন। বললাম, এঁরা আসলে পদ্মের মতো। বেশির ভাগ শিল্পীই কাজ করেন এবং বেড়ে ওঠেন পাঁকের মধ্যে। কিন্তু সেই পাঁককে অগ্রাহ্য করে আমরা যদি তাঁদের সৌন্দর্যে মন দিই, তা হলে আর সমস্যা থাকে না। জবাবে খুব খুশি হয়েছিলেন মনে আছে। এর পরে যখন কোনও এক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের উপর বেজায় চটে তাঁকে বলেছিলাম, উনি আমায় আমারই বলা ওই বাক্যটি মনে করিয়ে শান্ত হতে বলেন। এই ছিলেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ।
যখনই কোনও কাজে তাঁর ঘরে গিয়েছি, ফেরার সময়ে তিনি দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিতেন। বারে বারে বলতাম, “আমাকে এ ভাবে লজ্জা দেবেন না।” এক বার হেসে বললেন, “ডাক্তার আমাকে প্রতি আধ ঘণ্টায় হাত পায়ে রক্ত সঞ্চালন করাতে বলেছেন। তাই তো উঠে আসি!” তখন তিনি প্রধানমন্ত্রী। তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময়ে পিঠে হালকা টোকা। “তুমি এটা ফেলে যাচ্ছ জহর!“ প্রধানমন্ত্রী আমার পেনটি দিতে এগিয়ে এসেছেন আমার কাছে! এমনই ছিলেন মনমোহন।
কত ঘটনা যে মনে পড়ছে। এক বার এক খুবই উচ্চপদস্থ ব্যক্তির কাছ থেকে আমার বিরুদ্ধে তাঁর কাছে অভিযোগ এল সংস্কৃতি জগতে আমি নাকি বাঙালিদেরই বেশি সুযোগ সুবিধা দিচ্ছি। কী মনে হল জবাবে বললাম, ‘স্যার যদি সেরা হকি দল বানাতে হয়, তা হলে আমরা বাংলার কাছে যাব না। অন্য একটি রাজ্যকেই সামনে নিয়ে আসার সুযোগ দেব। সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও একই ভাবে বিষয়টি দেখি।’ বুঝেছিলেন, হকির প্রশ্নে পঞ্জাবের কথা বলছি। কথা শুনে এক বিরল হাসি সে দিন হেসেছিলেন মনমোহন। আমি ভাগ্যবান তাঁর পূর্ণাঙ্গ আস্থা পেয়েছি বরাবর।
(লেখক মনমোহন সিংহের প্রধানমন্ত্রিত্বে কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি সচিব ছিলেন।)