ছেলের ছবি হাতে রানি সর্দার। নিজস্ব চিত্র
ঠিক কত বছর আগে দু’জনের বিচ্ছেদ হয়েছিল, সে কথা মা বা ছেলে, কারওরই আজ আর ঠিক মতো মনে পড়ে না। ছেলের বয়স এখন ১৩। দীর্ঘ দিন ধরে ভিন্ রাজ্যে ঘুরে ঘুরে হাওড়ার ফুলবাজারের ওই কিশোর বাংলা ভাষাটাই ভুলে গিয়েছে। পটনা শহরের একটি হোম থেকে ফোনে মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছে তার। কিন্তু, মায়ের ছবি দেখে আজ আর সে চিনতে পারছে না।
দুই প্রতিবেশী রাজ্যে বসে মা ও ছেলে। আইনি জটিলতায় আটকে রয়েছে দু’জনের পুনর্মিলন। পটনার সেই হোম, ‘সফিনা বালগৃহ’-এর বাঙালি কর্তা সমীর কর্মকার ফোনে জানিয়েছেন, মা পটনায় সশরীরে যেতে পারলে ভাল। নয়তো তাঁর যাবতীয় কাগজপত্র পাঠালে তদন্ত শুরু হবে। পটনা ও কলকাতা— দুই জায়গাতেই তদন্ত হবে। জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ডের কাছে সেই তদন্ত রিপোর্ট জমা পড়বে। তার পরেও যদি তাঁদের সম্পর্ক নিয়ে ধোঁয়াশা থাকে, তা হলে প্রয়োজনে ডিএনএ পরীক্ষাও করানো হতে পারে।
মায়ের দাবি, ছেলের নাম নিরঞ্জন সর্দার। ছেলে বলছে, তার নাম আর্যমান। সমীরবাবুর কথায়, “আর্যমান নামটাই আমাদের খাতায় লেখা রয়েছে। ওর বক্তব্য, খুব ছোটবেলায় এক বার গঙ্গায় স্নান করতে গিয়ে ও ডুবে যাচ্ছিল। সেই সময়ে এক ব্যক্তি ওকে বাঁচান। তাঁর বাড়িতেই পরিবারের সদস্য হিসেবে কয়েক বছর থেকে যায় সে। এক সময়ে ওই ব্যক্তি ছেলেটিকে চেন্নাইয়ের একটি হোটেলে কাজের জন্য পাঠিয়ে দেন। সেখানেই সম্ভবত তার নতুন নামকরণ হয়। সেই হোটেলে পটনারও কিছু নাবালক কাজ করছিল। পটনার পুলিশ বছর দেড়েক আগে চেন্নাইয়ের সেই হোটেলে হানা দিয়ে পটনার ছেলেদের সঙ্গে আর্যমানকেও তুলে আমাদের হোমে নিয়ে আসে। সেটাও প্রায় দেড় বছর হতে চলল।”
আর্যমানের সঙ্গে কথা বলে হাওড়ার বিষয়ে জানতে পারেন সমীরবাবুরা। ছোটবেলার স্মৃতি হিসেবে সে জানায়, বাবা-মা হাওড়ায় গঙ্গার সিঁড়িতে বসে ফুল বিক্রি করতেন। বাবার নাম রমেশ সর্দার। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। পুলিশ হ্যাম রেডিয়ো সংগঠনের কর্তা অম্বরীশ নাগ বিশ্বাসের সঙ্গে যোগাযোগ করে। হাওড়ার হ্যাম রেডিয়ো অপারেটর রহমাতুল্লা মল্লিক খোঁজ শুরু করেন মল্লিকঘাটে।
খোঁজখবর করে জানা যায়, রমেশ এবং তাঁর স্ত্রী রানি সর্দারের এক মেয়ে ও এক ছেলে। এক সময়ে স্বামী-স্ত্রী মল্লিকঘাটের সিঁড়িতে বসে ফুল বিক্রি করতেন। বেশ কয়েক বছর আগে তাঁদের ছেলে নিখোঁজ হয়ে যায়। এর কয়েক বছর পরে মারা যান রমেশ। জীবনে এই জোড়া ধাক্কায় রানি মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। যে ঘাটের সিঁড়িতে বসে তাঁরা ফুল বিক্রি করতেন, সেই ঘাট এখন আর নেই। রানি এখনও ওই চত্বরে ফুল বিক্রি করেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর ঘর-সংসার সামলান মেয়ে।
অম্বরীশবাবু জানিয়েছেন, রানির মতো যাঁরা ঘুরে ঘুরে ফুল বিক্রি করেন, তাঁদের নাম নথিভুক্ত থাকে না ব্যবসায়ী সমিতির কাছে। তাই খুঁজে পেতে সমস্যা হয়। মিশ্রজি নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি রানিকে খুঁজে বার করতে সাহায্য করেন। অম্বরীশবাবু বলেন, “রানি ছেলের খোঁজ পেয়ে, তার ছবি দেখে কেঁদে অস্থির। ছেলের আগের ছবির সঙ্গে এখনকার ছবির অমিল অনেকটাই। এ দিকে, মায়ের ছবি দেখেও চিনতে পারেনি ছেলে। আমরা দু’জনের কথা বলিয়ে দিয়েছি। এখন সরকারি সিদ্ধান্তের উপরে নির্ভর করতে হবে।”