বর্ণপরিচয় মার্কেটে মিটার বক্সের সামনেই জমে জল ও আবর্জনা। ছবি: সুমন বল্লভ।
দাঁত বার করে খিঁচিয়ে রয়েছে ইটের কাঠামো। অর্ধনির্মিত পাঁচতলা বহুতলের মাথায় বেরিয়ে থাকা লোহার রড যেন কাঁটার মুকুট। অথচ কথা ছিল, সমগ্র বহুতলের দেওয়াল হবে কাচের। থাকবে লিফট, চলমান সিঁড়ি। কিন্তু ‘কেউ কথা রাখেনি’। তাই অর্ধনির্মিত ভবনের ভিতরে জমে থাকে জল। প্রবেশপথে আবর্জনা আর আগাছার জঙ্গল। মানুষের শৌচকর্মের নিশ্চিন্ত জায়গা এই বহুতলের আশপাশ। ২০০৭ সালে কলকাতা পুরসভার ডাকে ব্যবসায়ীদের যা যা স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল, সেই স্বপ্নভঙ্গ বুঝি একেই বলে। মধ্য কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে খণ্ডহর হয়ে থাকা ‘বর্ণপরিচয়’ বাজারের সেই হাল দেখে অনায়াসে মেহের আলি ‘সব ঝুট হ্যায়’ বলে আবারও চিৎকার করতে পারতেন।
শনিবারের দুপুর। পায়ে ব্যথা নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠে প্রৌঢ়া ক্রেতা হাসতে হাসতে এক শাড়ির দোকানদারকে প্রশ্ন করলেন, ‘‘লিফট বসাবেন কবে? বয়স বাড়ছে তো। এর পরে তো আর আসতে পারব না।’’ বাজার ঘুরে জানা গেল, এমন হাজারো প্রশ্ন সারা বছরই ক্রেতাদের থেকে শুনে ক্লান্ত ব্যবসায়ীরাও। তাঁদের অভিযোগ, বাজারের উপরের অংশ খোলা। অঝোরে বৃষ্টির জল পড়ে। সেই জল জমে থাকে বাজারের ভিতরে। এখন বর্ষাকাল নয়। তবু দেখা গেল, দোতলার একাংশে জল জমে রয়েছে।
তেতলায় বইয়ের দোকানের এক বিক্রেতার প্রশ্ন, ‘‘ক্রেতারা আসবেন কেন? আমরা কতটুকু তাঁদের স্বাচ্ছন্দ্য দিতে পারি? বর্ষায় বাজার চত্বরে জল জমে ঘিনঘিনে পরিস্থিতি হয়। মশার উপদ্রব বাড়ে।’’ বাজার ঘুরে দেখা গেল, তেতলা থেকে উপরে যাওয়ার সিঁড়ি অ্যাসবেস্টস দিয়ে বন্ধ করে রেখেছে পুরসভা। ব্যবসায়ীদের দাবি, অর্ধনির্মিত বাজারের ছবি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ যাতে না হয়, তাই পুরসভার এই পদক্ষেপ।
২০১৩ সালে ওই বাজারে জায়গা পেয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁদের অভিযোগ, প্রোমোটার ও কলকাতা পুরসভার জটে আজও বেহাল দশায় পড়ে মধ্য কলকাতার ওই বিরাট বাজার কমপ্লেক্স। বাজারের সম্পাদক তথা শাড়ির ব্যবসায়ী শুভাশিস দে জানান, বর্তমানে ৯৩০ জন ব্যবসায়ী রয়েছেন এই বাজারে। তাঁর দাবি, বাজার হিসাবে হগ মার্কেটের পরেই এটি পুরসভার দ্বিতীয় সর্বাধিক আয়ের উৎস। এ দিকে পুর পরিষেবা বলতে কিছুই নেই। এক রাশ ক্ষোভ উগরে শুভাশিস বলেন, ‘‘নিরাপত্তাকর্মীর অভাবে মাঝেমধ্যে বাজারে চুরি হয়। লিফট কিংবা চলমান সিঁড়ি না থাকায় ক্রেতাদের সমস্যা হয়। ব্যবসায়ীরা খরচ করে শৌচাগার পরিচ্ছন্ন রাখেন।’’
শিয়রে যখন কলকাতা পুরসভার ভোট, তখন পুরসভা পরিচালিত বাজারগুলির পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বিশেষ সন্তুষ্ট নন শহরবাসী। ওই দুপুরেই গড়িয়াহাটে পুরসভা পরিচালিত বাজারে এসে ক্রেতা জয়িতা ভট্টাচার্যের ক্ষোভ, ‘‘শহরে একের পর এক শপিং মল হচ্ছে। অথচ পুরসভার এই সব বাজার পড়ে রয়েছে অন্ধকারেই। এমনকি সুরক্ষার দিকটিও প্রতিদিন উপেক্ষিত হচ্ছে।’’ তাঁর ক্ষোভের কারণ বোঝা যায় বাজারে ঘুরে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বললেই।
বাজারের ভিতরের রাস্তা অপরিসর, মাথার উপরে ঝুলছে তারের জট।
গোটা বাজারে তারের জঙ্গল। অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকার মতোই, দাবি ব্যবসায়ীদের। রয়েছে জল এবং শৌচাগারের সমস্যা। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ২০১৯ সালে পুরসভা বাজারের তিন জায়গায় পানীয় জলের ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু এক মাসেই সব বিকল হয়ে গিয়েছে। সেই থেকে বাজারে পুরসভার জলের সরবরাহ বন্ধ! বাবলু প্রধান নামে এক দোকানকর্মীর দাবি, ‘‘প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ আসেন। শৌচাগারে লম্বা লাইন পড়ে। অপরিষ্কার শৌচাগার নিয়ে বিরক্ত ক্রেতারা।’’
বেহাল দশার ছবিটা আলাদা কিছু নয় পুরসভা পরিচালিত বেহালা ম্যান্টন সুপার মার্কেটেও। স্থানীয় মানুষের অভিযোগ, বছর দুই আগে ডায়মন্ড হারবার রোড উঁচু করার পর থেকেই ঘণ্টাখানেকের বর্ষণে বাজারে হাঁটু-সমান জল জমে যায়। ক্রেতা না আসায় ওই সময়ে ব্যবসা মার খায়। নিয়মিত নিকাশি নালাও পরিষ্কার হয় না বলে অভিযোগ ক্রেতাদের। ব্যবসায়ীদের দাবি, পুরসভার ‘টক টু মেয়র’ অনুষ্ঠানে বার বার জানিয়েও কাজ হয়নি।
বর্ণপরিচয় হোক বা গড়িয়াহাট বাজার কিংবা বেহালার ম্যান্টন অথবা মানিকতলা-কাঁকুড়গাছির মিউনিসিপ্যাল বাজার— সর্বত্র অসন্তোষের সুর ধরা পড়েছে ব্যবসায়ী থেকে ক্রেতা, সবার কথায়। কলকাতা পুরসভার বাজার বিভাগের দায়িত্বে থাকা, বিদায়ী প্রশাসকমণ্ডলীর সদস্য আমিরুদ্দিন ববির অবশ্য দাবি, সব পুর বাজারেই প্রচুর কাজ হয়েছে। এমনকি বর্ণপরিচয় বাজারের সমস্যা কাটিয়ে ফেলা পুরসভার বড় সাফল্য বলে দাবি তাঁর। আমিরুদ্দিনের কথায়, ‘‘পুরসভার যে যে বাজারে কাজ বকেয়া ছিল, সে সব সাফল্যের সঙ্গে শেষ করা গিয়েছে।’’
যদিও উল্টো ছবিটাই উঠে আসছে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বললে। পুর পরিষেবা নিয়ে বিস্তর অভিযোগ করেছেন পার্ক সার্কাস, সন্তোষপুর-সহ একাধিক বাজারের ব্যবসায়ীরা। পুরসভায় রেজিস্ট্রিকৃত ৪৯টি বাজারের সিংহভাগ থেকেই উঠে এসেছে ঝুড়ি ঝুড়ি অভিযোগ।
মানিকতলা-কাঁকুড়গাছি মিউনিসিপ্যাল বাজারে গিয়ে দেখা গেল, ভিতরে ছড়িয়ে আবর্জনা। ব্যবসায়ীদের বড় অংশের অভিযোগ, নিকাশির সমস্যা থাকায় ভারী বৃষ্টি হলেই ফলের বাজারে গোড়ালি-ডোবা জল জমে যায়। তখন ক্রেতারা ফল কিনতে আসেন না। নষ্ট হয় অবিক্রীত কাঁচা বাজার। তাঁদের দাবি, শৌচাগারে জল থাকে না। মাঝেমধ্যেই বাজারের বিদ্যুৎ চলে যায়।
যদিও ‘ট্রেডার্স অব কলকাতা মিউনিসিপ্যাল মার্কেট’-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক তাপস মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, ম্যান্টন বাজারে জল জমার সমস্যা সমাধানে পুরসভা ই-দরপত্র ডেকেছে। তিনি বলেন, ‘‘এটা ঠিক যে পুর প্রশাসনের নিচুতলার কাজে খামতি রয়েছে। কোনও বাজারে সমস্যা থাকলে সেখানকার ব্যবসায়ী সংগঠনকে পুরসভার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানোর পাশাপাশি ব্যবসায়ী সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গেও যোগাযোগ করতে হবে। তা হলে বিষয়টি প্রশাসনের উপর মহলে জানাতে পারি।’’ তবে আগের
তুলনায় বাজারের পরিবেশ এখন অনেক উন্নত বলে তাঁর দাবি।