পোলবার দুর্ঘটনাগ্রস্ত গাড়ি। —ফাইল চিত্র।
পোলবার দুর্ঘটনাগ্রস্ত স্কুলগাড়িটিতে পড়ুয়া ছিল ১৬ জন। যদিও গাড়ির গঠন অনুযায়ী তাতে চালক-সহ ১৪ জনের বসার আসন রয়েছে। তদন্তে উঠে এসেছে, স্পিড গভর্নর খুলে রাখার পাশাপাশি সর্বাধিক যাত্রী বহনের সংখ্যার ক্ষেত্রেও ওই স্কুলগাড়ি নিয়ম ভেঙে চলছিল।
তবে শুধু পোলবার ওই স্কুলগাড়িই নয়, শহর থেকে শহরতলি, এমনকি গোটা রাজ্যেই নিয়ম ভেঙে অসংখ্য স্কুলগাড়ি চলার অভিযোগের কথা স্বীকার করে নিচ্ছে বিভিন্ন পুলকার সংগঠনও। মালিকদের অনেকেই মেনে নিচ্ছেন, তাঁরা ২০১৫ সালের আগের তৈরি হওয়া গাড়িই স্কুলগাড়ি হিসেবে ব্যবহার করছেন। ব্যক্তিগত গাড়িও ব্যবহার হচ্ছে স্কুলগাড়ি হিসেবে। এক স্কুলগাড়ি মালিকের কথায়, ‘‘সারা রাজ্যে ৫০ শতাংশের বেশি স্কুলগাড়িই ব্যক্তিগত মালিকানার। আমারটাও তা-ই। বাণিজ্যিক গাড়িতে জটিলতা অনেক বেশি।’’
মালিকেরাই জানাচ্ছেন, বাণিজ্যিক গাড়ির ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময় অন্তর ফিটনেস পরীক্ষা করাতে হয়। বাণিজ্যিক গাড়িতে বিমা বাবদ খরচ হয় প্রায় ৪০ হাজার টাকা। ব্যক্তিগত মালিকানার গাড়িতে তা অনেক কম। আবার বাণিজ্যিক গাড়ির জন্য প্রতি বছর প্রায় ৩২ হাজার টাকা কর দিতে হয়। সেখানে ব্যক্তিগত মালিকানার গাড়ির ক্ষেত্রে পাঁচ বছর অন্তর কর দিতে হয়। গাড়ির এই সব কাগজপত্র না থাকলে ফিটনেস পরীক্ষাতেও পাশ করা সম্ভব নয়। তাই অনেকেই ব্যক্তিগত মালিকানার গাড়িকেই স্কুলগাড়ি হিসেবে ভাড়া খাটান।
অভিযোগ, অনেক সময়ই বড় গাড়ির নির্দিষ্ট সিট খুলে দেন মালিকেরা। তার বদলে ভিতরে বেঞ্চের মতো সিট লাগানো হয়। তাতে কমপক্ষে ৩০ জন বাচ্চাকে নেওয়া সম্ভব হয়। এক চালকের কথায়, ‘‘ওই সব গাড়িতে আচমকা ব্রেক কষাও বিপদের। কারণ তাতে বাচ্চারা গাড়ির ভিতরেই এ-দিক ও-দিক ছিটকে পড়ে।’’ তবে এই অনিয়ম চলার পিছনে অভিভাবকদেরও ভূমিকা রয়েছে বলে দাবি স্কুলগাড়ি সংগঠনগুলির। মালিক ও চালকেরা জানান, অভিভাবকদের একাংশ খোঁজ করেন, কম ভাড়ায় কোন স্কুলগাড়ি পাওয়া যাবে। কিন্তু সেই গাড়ির অবস্থা কেমন, তার দিকে কেউ খেয়াল করেন না।
মালিক ও চালকদের অভিযোগ, অনেক সময়েই দেখা যায় এক জন অনেক দিন ধরে কোনও মালিকের স্কুলগাড়ি চালাচ্ছিলেন। বনিবনা না হওয়ায় তিনি কাজ ছেড়ে দিয়ে নিজেই একটি কাটাই (বহু পুরনো, জোড়াতাপ্পি দিয়ে সারানো) গাড়ি কিনে সেটি স্কুলগাড়ি হিসেবে ভাড়া খাটাতে শুরু করলেন। এমনকি, অন্য স্কুলগাড়ি যদি মাসে ১ হাজার টাকা নেয়, তা হলে ওই কাটাই গাড়িটি ছাত্র পিছু ৬০০-৭০০ টাকা নিতে শুরু করে। হাওড়ার একটি পুলকার মালিক সংগঠনের সম্পাদক মদন জানার কথায়, ‘‘সংগঠনের তরফে সরকারি নিয়ম মেনে চলার বিষয়ে জোরাজুরি করলে অনেক সদস্যই সংগঠন ছেড়ে বেরিয়ে যান। তাই সংগঠনের পাশাপাশি অভিভাবক ও স্কুলের তরফেও যদি বিষয়টিতে জোর দেওয়া হয়, তা হলে সুবিধা হতে পারে।’’
তবে সমস্যা সমাধানে সরকারের তরফে স্কুলগাড়ির জন্য কোনও প্রকল্প চালুর দাবি করেছে পুলকার ওনার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনের সম্পাদক সুদীপ দত্ত বলেন, ‘‘আমরাও চাই নতুন গাড়িতে বাচ্চাদের নিয়ে যেতে। সরকার স্কুলগাড়ির জন্য গতিধারার মতো কোনও প্রকল্প চালু করলে নতুন গাড়ি কেনার সুযোগ মিলবে। সরকারি প্রকল্পে গাড়ি কিনলে ঋণের কিস্তির টাকা কম হবে, অন্যান্য কিছু সুযোগ-সুবিধাও মিলবে।’’
তবে এই যুক্তি মানতে নারাজ রাজ্য পরিবহণ দফতর। বরং দফতরের কর্তাদের একাংশের দাবি, নিয়ম মেনে গাড়ি চালানো মালিক ও চালকের একান্ত নিজস্ব বিষয়। এর সঙ্গে নতুন গাড়ি কেনার কোনও সম্পর্ক নেই। পরিবহণ মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী বলেন, ‘‘গতিধারা প্রকল্পে কেউ আবেদন করে নতুন গাড়ি নিতে পারেন। স্কুলগাড়ির জন্য আলাদা কোনও প্রকল্পের পরিকল্পনা নেই। এই সব দাবি অযৌক্তিক। বাচ্চাদের জীবনের মূল্য অনেক। তাই নিয়ম মেনেই স্কুলগাড়ি চালাতে হবে। না হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
বুধবার পুলকার এবং স্কুলবাস সংগঠনগুলির প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন পুলিশ ও পরিবহণ দফতরের আধিকারিকেরা। জানানো হয়, স্কুলে গিয়ে গাড়ির স্বাস্থ্য ও চালকের পরিচয়পত্র সংক্রান্ত নথি পরীক্ষা করবেন আধিকারিকেরা। অনিয়ম মিললে গাড়ি আটক করা হবে। লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশও করা হতে পারে। স্কুল শিক্ষা দফতর গত সোমবারই একটি নির্দেশিকায় পুলকারগুলিকে ফিটনেস সার্টিফিকেট উইন্ড স্ক্রিনে আটকে রাখতে বলেছে।