ফের চালু হল শহরের মেট্রো পরিষেবা। দেখা গেল না অফিস টাইমে ভিড়ের পরিচিত চিত্র। সোমবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
ঘাট থেকে ছেড়ে যাওয়া নৌকোয় লাফ দিয়ে ওঠার মতোই অফিসের ব্যস্ত সময়ে দরজা বন্ধ হওয়ার আগের মুহূর্তে মেট্রোর কামরায় শরীরটাকে ছুঁড়ে দিতে দেখেছি অনেককেই। মাস ছয়েক আগেও। কবি সুভাষ স্টেশনে।
করোনা আবহে বাসে যেমন হুড়োহুড়ি দেখেছি, দূরত্ববিধির তোয়াক্কা না করে, সোমবার কি তা চোখে পড়বে মেট্রোতেও? না কি হাজার কড়াকড়ির মধ্যে স্টেশনে ঢোকার জন্য লম্বা লাইন দেখব? যেমনটা দেখছি সরকারি বাসের স্ট্যান্ডে। এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই গোটা দুয়েক অটো বদলে সোমবার সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ কোনও মতে পৌঁছলাম কবি সুভাষ স্টেশনে। মেট্রো চালু হওয়ার খবরে কিছুটা খুশি অটোচালকেরা। যদি আরও কিছু যাত্রী মেলে।
স্টেশনে গিয়ে দেখি, কোথায় কী! যাত্রীর ভিড়ই নেই।
তৎপরতা পুলিশ, রেলরক্ষী বাহিনী, মেট্রোর সাফাই কর্মীদের। রবিবার রাতে বিস্তর কাঠ-খড় পুড়িয়ে কোনও মতে বুক করা ই-পাস বার করে দেখাতেই অনুমতি মিলল প্ল্যাটফর্মে ঢোকার। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নির্দেশের ভঙ্গিতে হাত পরিষ্কারের জন্য স্যানিটাইজ়ার ডিসপেন্সার দেখিয়ে দিলেন রেলরক্ষী বাহিনীর উর্দিধারী। হাত স্যানিটাইজ় করে তবেই ভিতরে যাওযার অনুমতি মিলল। প্রায় খালি এস্ক্যালেটর দিয়ে প্ল্যাটফর্মে উঠে মেট্রোর অপেক্ষা।
আরও পড়ুন: মেট্রোর অ্যাপ নিয়ে বিভ্রান্তি ও ভোগান্তিতে বিরক্ত যাত্রীরা
যাত্রী বলতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আট-ন’জন। মিনিট দশেকের মধ্যেই মেট্রো এল। প্রায় ১৭৫ দিন পরে দেখা!
দেখছি, ছুটছে মেট্রো। মাটি ছেড়ে উড়াল পথ বেয়ে উঠছে উপরের দিকে। পাশ দিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে শরতের মেঘভাঙা রোদের দিকে নিষ্পলক চেয়ে থাকা দোতলা-তেতলা বাড়ির ছাদ।
সোমবার মেট্রোতে যাত্রী সংখ্যা
• সোমবার নোয়াপাড়া-কবি সুভাষ মেট্রোতে ই-পাস বুক করেছিলেন প্রায় ৫২ হাজার যাত্রী।
• মেট্রোতে সফর করেছেন প্রায় ২০ হাজার যাত্রী।
• মেট্রোর আয় ১১ লক্ষ ১৯ হাজার ২৫৫ টাকা।
• ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোতে সারা দিনে মোট ৭২টি ট্রেনে যাত্রী সংখ্যা ছিল মাত্র ৮৩। ট্রেন পিছু এক জনের সামান্য বেশি। আয় হয়েছে ৬৬১০ টাকা।
মিনিট কয়েকের মধ্যেই শহিদ ক্ষুদিরাম মেট্রো স্টেশন। যাত্রী উঠলেন সাকুল্যে তিন জন। কবি নজরুল স্টেশনে সংখ্যাটা হল জনা ১৫। টালিগঞ্জ পৌঁছতে অবশ্য মেট্রোর খালি কামরাগুলোয় কিছু লোকজন চোখে পড়ল।
উল্টো দিকে এসে বসলেন এক প্রৌঢ়। কিছুটা দূরে মহিলাদের আসনে আরও দু’জন। মহিলাদের কনুই পর্যন্ত হাত-আবরণ। মাথায় স্কাল ক্যাপ আর মুখে মাস্ক। লোকজন মাঝে মধ্যে মোবাইলে চোখ রাখলেও কারও মুখে কথা নেই। নীরবতা ভাঙছিল শুধু মেট্রোর ঘোষণা।
আরও পড়ুন: ই-পাস না পেয়ে দুর্ভোগ, বাস ধরতে গেলেন অনেকেই
এ ভাবেই যাত্রীরা কেউ উঠলেন, কেউ নামলেন। রবীন্দ্রসদন, পার্ক স্ট্রিট কিংবা বেলগাছিয়ায়। দমদম পৌঁছতেই ট্রেন পুরো খালি। এমন মেট্রো যাত্রা শেষ কবে দেখেছি?
এক সঙ্গে পাস মিলবে কি না তার ঠিক নেই। তাই আগে যাঁরা দল বেঁধে মেট্রোয় যেতেন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সব পড়ুয়া, স্কুল থেকে কচিকাঁচাদের নিয়ে বাড়িফেরা মা, অফিসযাত্রী, মেট্রোয় একই সময়ে যেতে যেতে বন্ধু হয়ে যাওয়া নাগরিক, কারও এ দিন দেখা মেলেনি। তাই অনেকে থাকলেও নতুন মেট্রোর এই সফরে আমরা প্রত্যেকে একা।
কিছু ক্ষণের মধ্যে নোয়াপাড়া পৌঁছে আমিও কামরা থেকে নেমে এলাম একলাই।
প্ল্যাটফর্ম, সিঁড়ি, এস্ক্যালেটর সব পেরিয়ে যেতে দেখলাম কাছাকাছি কেউ নেই। দূরে কয়েক জন মেট্রো কর্মী যাত্রীদের ই-পাস কী ভাবে বুক করতে হবে তা দেখাচ্ছেন। আর সাফাই কর্মীরা দ্রুত মুছে ফেলছেন স্টেশনের মেঝে, রেলিং, চারপাশ। জীবাণুর ভয়ে।
অতিমারি-আতঙ্কে প্রথম মেট্রো সফরের স্মৃতিও কি মুছে যাবে এ ভাবে?
হয়তো।