হারানো রেকর্ডের শব্দস্মৃতি নন্দনে 

সিনেমার ক্যান, ক্যানবন্দি রিলের সঙ্গে-সঙ্গে দেওয়াল জুড়ে শোভা সেই গোলাকার চাকতির। গায়ে পেরেক ঠুকে ঠুকে সূর্য-চন্দ্র-তারার মতো তা বসানো দেওয়ালেরই ক্যানভাসে।

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০১৯ ০৪:১২
Share:

সাজসজ্জা: চলচ্চিত্র উৎসব উপলক্ষে নন্দনের দেওয়াল সেজেছে রেকর্ডে। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

সুখী গৃহকোণের অনুষঙ্গে একদা অব্যর্থ ছিল সেই গোলাকার চাকতির উপস্থিতি। বনবন করে ঘুরে পাক খাওয়ার মাত্রায় তারতম্য হয়েছে, কিংবা চাকতির ওজনে হেরফের ঘটেছে! কিন্তু কয়েক দশক ধরে মধ্যবিত্ত যাপনেরও স্মারক হয়ে থেকেছে ভিনাইল রেকর্ড। অধুনা শহরে চলতি কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের অনুষঙ্গেও আবার সে এসেছে ফিরিয়া!

Advertisement

তবে এই ফিরে আসা কি আদৌ ফিরে আসা, সে প্রশ্নও দানা বাঁধছে। চলচ্চিত্র উৎসবের প্রাণকেন্দ্র নন্দনের মূল ফটক দিয়ে ঢুকতেই ডান দিকের দেওয়ালে চোখে পড়ছে সংস্কৃতিপ্রেমীদের একটি বিশেষ হারানো সময়ের চিহ্ন! সিনেমার ক্যান, ক্যানবন্দি রিলের সঙ্গে-সঙ্গে দেওয়াল জুড়ে শোভা সেই গোলাকার চাকতির। গায়ে পেরেক ঠুকে ঠুকে সূর্য-চন্দ্র-তারার মতো তা বসানো দেওয়ালেরই ক্যানভাসে। শহরের কোনও কোনও পুরনো রেকর্ড সংগ্রাহকের চোখে সেই দৃশ্য যেন খানিকটা অসহনীয় হয়ে উঠেছে।

শ্যামবাজারের শ্যামচাঁদ মিত্র লেনের বাসিন্দা নবতিপর সুশীল চট্টোপাধ্যায় বা নুকুবাবুর ভাঁড়ারে রয়েছে, মানুষের শব্দগ্রহণ চর্চার আদি যুগ থেকে নিরীক্ষার একটা লম্বা বৈচিত্র্যপূর্ণ অধ্যায়। মান্ধাতা আমলের অকেজো রেডিয়ো বা বিদেশি সাউন্ড প্রজেক্টরকে জীবন্ত করে তুলতে নুকুবাবুর জুড়ি নেই। রেকর্ডের যুগের ‘কলম্বিয়ার বাঘের ছাপ্পা, কুকুর শোনে বাংলা টপ্পা’র আমেজে এখনও তিনি মজে। নন্দনের চলচ্চিত্র উৎসবের সাজসজ্জার কথা শুনে নুকুবাবু বলছিলেন, ‘‘এ কিন্তু একটা সময়ের বুকে পেরেক ঠুকে মারা!’’ তাঁর কাছে ১৮৯৮ সালের রেকর্ড পর্যন্ত যত্নে রাখা। ‘অ্যানালগ’ যুগের শব্দের একটা আলাদা আমেজ তিনি বুকে অনুভব করেন। নুকুবাবু বলছেন, ‘‘আমি ঠিক প্রাণে ধরে রেকর্ডের গায়ে এ ভাবে পেরেক ঠুকতে পারব না।’’

Advertisement

চলচ্চিত্র উৎসবের সিইও মিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অবশ্য দাবি, ‘‘এই রেকর্ডগুলি কাটা রেকর্ড। এ আর কখনওই বাজত না!’’ অধুনা এ দেশে নতুন রেকর্ড তৈরি কার্যত বন্ধ। আকাশবাণীর সংগ্রহে থাকা পুরনো রেকর্ড দ্রুত ডিজিটাইজড হয়ে যাচ্ছে। সেখানে রেকর্ড প্লেয়ারে গান বাজানোও এখন উঠে গিয়েছে। তবে শৌখিন কারও কারও বাড়িতে রেকর্ড প্লেয়ার বাজানো একেবারে বন্ধ হয়নি। সঙ্গীতশিল্পী লোপামুদ্রা মিত্র অবশ্য রেকর্ড প্লেয়ার রক্ষণাবেক্ষণের ঝক্কি পোয়ানো সোজা নয় বলে মনে করেন। কিন্তু সাবেক অ্যানালগ প্রযুক্তির শব্দের প্রতি মমতায় তিনিও আচ্ছন্ন। ‘‘এখনকার ডিজিটাল প্রযুক্তির শব্দ বড্ড বেশি নিখুঁত। সবার কণ্ঠই এক ছাঁচে ঢালা। তখনকার রেকর্ডিংয়ে শিল্পীর গায়কীতে দু’-একটা মানুষসুলভ খামতি মিশে থাকত, তার ভিতরেও আলাদা চরিত্র উঠে আসত, তা আর পাওয়া যাবে না!’’ নন্দনে অকেজো রেকর্ড সাজানোর ব্যাপারটা লোপামুদ্রার কাছে তাই এক ধরনের হারানো সময়ের ছাপ বয়ে আনছে। ‘‘যা চলে গিয়েছে, তাকে এ ভাবে ধরে রাখা গেলেও মন্দ কী!’’— বলছেন শিল্পী।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement