অঘটন: (উপরে) ভেঙে পড়ার পরে পোস্তা উড়ালপুল। চলছে মৃত ও আহতদের উদ্ধারের কাজ। ফাইল চিত্র।
ভোট আসে, ভোট যায়। কিন্তু পোস্তা উড়ালপুলের ছবিটা একই থাকে।
২০১৬ সালের ৩১ মার্চ। দুপুর প্রায় ১২টা। হঠাৎই গণেশ টকিজের কাছে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে বিবেকানন্দ উড়ালপুলের একাংশ। মৃত্যু হয় ২৬ জনের। বছর তিনেক আগের সেই দুর্ঘটনায় কেউ অকালে হারান বাবাকে, কেউ বা ছেলে-বৌমাকে। সেই উড়ালপুল নিয়ে সরকারি মনোভাবে তিতিবিরক্ত হয়ে এ বার তাই ভোট বয়কটের ডাক দিয়েছেন মৃতদের পরিজনেরা।
প্রায় আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ বিবেকানন্দ উড়ালপুল ভেঙে পড়ার তিন বছর পরে এখনও ভগ্নপ্রায়, কঙ্কালসার লোহার খাঁচা হয়েই দাঁড়িয়ে রয়েছে সেটি। স্থানীয়দের অভিযোগ, এখনও মাঝেমাঝে উপর থেকে চাঁই খসে পড়ে। এই অবস্থায় উড়ালপুলের বাকি অংশ দাঁড়িয়ে থাকুক, তা চান না স্থানীয় বাসিন্দারা। চান না উড়ালপুল দুর্ঘটনায় মৃতদের পরিবারেরাও।
শোকার্ত: মৃত তপন দত্তের ছবি নিয়ে তাঁরা বাবা, স্ত্রী ও ছেলে। রবিবার। নিজস্ব চিত্র
বছর তিনেক আগের সেই ‘অভিশপ্ত’ দিনে অটোয় চেপে পোস্তার নতুনবাজারে বাড়ি ফিরছিলেন তপন দত্ত (৫৮)। অটোটি যখন ওই উড়ালপুলের নিচে, তখনই মাথার উপরে ভেঙে পড়ে সেটি। বাড়ি ফেরা আর হয়নি তপনবাবুর। নতুনবাজারে পৈতৃক দোকানটিই তাঁর পরিবারের রোজগারের একমাত্র উৎস ছিল। ওই ঘটনার পরে সেই দোকান বিক্রি করে বৌমা-নাতিকে নিয়ে বেলুড়ে ফ্ল্যাট কিনেছেন তপনবাবুর বৃদ্ধ বাবা কৃষ্ণচন্দ্র দত্ত। তাঁর কথায়, ‘‘আমার ছেলের মৃত্যুর পরেও ওই উড়ালপুলের তলা দিয়ে যাতায়াত করতে আতঙ্ক হত। যার জন্য আমরা বেলুড়ে চলে আসি। কিন্তু দুর্ঘটনার তিন বছর পরেও উড়ালপুলের অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়নি।’’ ওই দুর্ঘটনার পরে অবশ্য তপনবাবুর ছেলে ধীমানকে ত্রাণ বিভাগে অস্থায়ী চাকরি দিয়েছে রাজ্য সরকার। সেই চাকরিই এখন ভরসা এই পরিবারের। তবে বেতন এতই কম যে, সংসার চালানো দায়। ধীমানের আক্ষেপ, ‘‘বাবার মৃত্যুর পরেই সরকারি তরফে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন মাত্র ১১ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করি। বাবার চলে যাওয়া আর মাসে ১১ হাজার কি এক হল? স্বল্প টাকায় সংসার চালানোয় দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।’’
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
এখন তাই ভোটের কথায় আগ্রহ হারিয়েছে তপনবাবুর পরিবার। ক্ষুব্ধ কৃষ্ণচন্দ্রবাবুর সাফ কথা, ‘‘কার জন্য ভোট দেব? নির্মীয়মাণ ব্রিজ ভেঙে ছেলের অকালমৃত্যু হল। প্রথম প্রথম নেতারা এসেছিলেন। কিন্তু তার পরে আর কেউ খোঁজ নেয় না। ওই বিপজ্জনক উড়ালপুলের তলা দিয়ে আজও শত শত মানুষ যাতায়াত করছেন। গাড়ি যাচ্ছে। ব্রিজের বাকি অংশ যে ভেঙে পড়বে না, তার গ্যারান্টি কেউ দিতে পারে! লোকসভা ভোটে আমাদের কোনও আগ্রহ নেই।’’
দুর্ঘটনাস্থলে গোলাপ মালির ছেলে বিকাশ মালি
প্রায় একই সুর ধূপকাঠি বিক্রেতা গোলাপ মালির ছেলে বিকাশের গলায়। তিন বছর আগের সেই দিনটিতে গণেশ টকিজ মোড়ের কাছে ফুটপাতে ধূপকাঠি বিক্রি করছিলেন বছর ষাটেকের গোলাপবাবু। দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর একমাত্র ছেলে বিকাশকে চাকরি দিয়েছে রাজ্য সরকার। যদিও তাতে সংসার চলে না। বিকাশের কথায়, ‘‘যে টাকাটা (১১ হাজার) সরকার দেয়, তার থেকে বাবা ফুটপাতে ধূপ বিক্রি করে আরও বেশি টাকা রোজগার করতেন।’’ উড়ালপুল নিয়ে সরকারি গড়িমসিতে রীতিমতো বিরক্ত তিনিও। পোস্তার নতুনবাজারের বাসিন্দা বিকাশ রবিবার বলেন, ‘‘ব্রিজ সেই ভূতুড়ে অবস্থাতেই পড়ে রয়েছে। লোকসভা ভোট উপলক্ষে কোনও রাজনৈতিক দলই বিবেকানন্দ উড়ালপুল নিয়ে প্রচারে উচ্চবাচ্য করছে না। ওই উড়ালপুল বাবার জীবন কেড়েছে। আমরা চাই না, উড়ালপুল থাকুক। কিন্তু সরকার এখনও এ নিয়ে সিদ্ধান্তেই আসতে পারল না।’’ সাফ জানাচ্ছেন, তিনি ও তাঁর মা, দু’জনের কেউই এ বারে ভোট দিতে যাচ্ছেন না।
দুর্ঘটনায় ছেলে-বৌমাকে হারিয়েছেন বিমলাদেবী ও জগদীশপ্রসাদ কান্দুই।
রিকশা চেপে বাড়ি ফেরার সময়ে পোস্তা উড়ালপুল চাপা পড়ে মারা গিয়েছিলেন অজয়কুমার কান্দুই ও তাঁর স্ত্রী। তিন বছর আগে ছেলে-পুত্রবধূকে হারিয়ে এখন স্ত্রী বিমলাদেবী ও দুই নাতিকে নিয়ে থাকেন অজয়কুমারের বাবা জগদীশপ্রসাদ কান্দুই। রবিবার সকালে টেগোর ক্যাসল স্ট্রিটের বাড়িতে বসে এ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়লেন ওই বৃদ্ধ। তাঁর কথায়, ‘‘তিন বছর কাটলেও এখনও উড়ালপুলের বাকি অংশ আগের মতোই রয়েছে। আমার প্রশ্ন, সরকার কেনই বা উড়ালপুল নিয়ে কোনও সিদ্ধান্তে আসত পারল না? সামনে ভোট। বিভিন্ন দলের নেতারা নানা প্রতিশ্রুতি নিয়ে দরজায় দরজায় ঘুরছেন। কিন্তু কেউ উড়ালপুলের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলছেন না। আমাদেরও তাই ভোট নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।’’
পোস্তা উড়ালপুলের বাকি অংশ সরাতে আন্দোলন করছে ফ্লাইওভার হটাও অভিযান সমিতি। সমিতির সম্পাদক বাপি দাসের অভিযোগ, ‘‘দুর্ঘটনার তিন বছর পরেও উড়ালপুলের বাকি অংশ একই ভাবে ঝুলছে। তিন বছরেও সরকারি তরফে কোনও সিদ্ধান্তে আসতে না পারাটা সরকারি ব্যর্থতা ছাড়া কিছু নয়।’’