তাণ্ডব: পুলিশকর্মীর উর্দি ধরে টানাটানি করছেন মহিলারা। রবিবার রাতে, টালিগঞ্জ থানায়। নিজস্ব চিত্র
প্রাণে বাঁচতে টেবিলের নীচে ফাইল মাথায় লুকোতে হয়েছিল পুলিশকে!
২০১৪-র নভেম্বর মাসে দুষ্কৃতীদের হাতে আক্রান্ত আলিপুর থানার সেই দৃশ্য সাড়া ফেলে দিয়েছিল পুলিশ মহলে। অনেকটা সে ভাবেই থানার ভিতরে ঢুকে ফের পুলিশকে ঘিরে ধরে মারধরের অভিযোগ উঠল শাসক দলের এক প্রভাবশালী নেতার অনুগামীর বিরুদ্ধে। এ বারের ঘটনাস্থল টালিগঞ্জ থানা।
রবিবার রাতের ওই ঘটনায় পুলিশকে ধরে বেধড়ক মারধরের পাশাপাশি তাঁদের অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করারও অভিযোগ উঠেছে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে। সেই রাতে পুলিশ অভিযুক্তদের ছেড়ে দিলেও সোমবার সকালে টালিগঞ্জ থানার কনস্টেবল বিমানকুমার দাসের অভিযোগের ভিত্তিতে অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করেছে তারা। যদিও ওই ঘটনায় সোমবার রাত পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। যুগ্ম কমিশনার মুরলীধর শর্মা সোমবার বিকেলে বলেন, ‘‘পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা রুজু করেছে। অভিযুক্তদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।’’ কিন্তু এর পরেও প্রশ্ন উঠেছে, রবিবার রাতেই কেন অভিযোগ দায়ের করে ব্যবস্থা নিল না পুলিশ?
পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনার সূত্রপাত রবিবার রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ। তখন রবীন্দ্র সরোবর লাগোয়া টালিগঞ্জ থানা এলাকার এক সিনেমা হলের কাছে মত্ত অবস্থায় কয়েক জন যুবক গোলমাল করছেন বলে খবর আসে। থানা থেকে দু’জন পুলিশকর্মী সেখানে গিয়ে রণজয় হালদার-সহ তিন মত্ত যুবককে গ্রেফতার করে আনে। তবে তাঁদের বিরুদ্ধে লঘু ধারায় মামলা রুজু করে পুলিশ।
ধৃতদের থানায় আনতেই পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়ে ওঠে। অভিযোগ, চেতলার ১৭ নম্বর বস্তির শ’খানেক বাসিন্দা টালিগঞ্জ থানার বাইরে এসে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। তাঁদের দাবি ছিল, রণজয়-সহ তিন যুবককেই ছেড়ে দিতে হবে। এর পরেই বিক্ষোভকারীদের কয়েক জন থানার ভিতরে ঢুকে পড়েন। অধিকাংশই মহিলা। তাঁরা রণজয়কে পুলিশের হাত থেকে ছাড়িয়ে আনার চেষ্টা করেন। তাতে বাধা দিলে থানার এক মহিলা কনস্টেবল ও এক পুরুষ কর্মীকে ধাক্কাধাক্কি করা হয় বলে অভিযোগ। থানার বাইরে থাকা এক কনস্টেবলকে চড়-থাপ্পড় মারতে থাকেন রণজয়ের লোকজন। শুধু তা-ই নয়, মহিলা কনস্টেবলের উর্দি ধরে টানাটানিও করতে দেখা যায় তাঁদের।
এরই মধ্যে বিক্ষোভকারীদের কয়েক জন সোজা দোতলায় উঠে থানার অফিসার ইন-চার্জের ঘরে ঢুকে তাঁকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করেন বলে অভিযোগ। থানার উপরে থাকা পুলিশের মেসে ঢুকেও তাণ্ডব চালানো হয় বলে দাবি পুলিশের। ভাঙচুর চালানো হয় থানাতেও। ছোড়া হয় ইট-পাটকেল। পুলিশেরই একাংশের আবার দাবি, থানায় ধরে আনার পরেই পুলিশ জানতে পারে, ধৃত রণজয় তৃণমূলের এক বড় মাপের নেতার ঘনিষ্ঠ। সম্ভবত সেই কারণেই ধৃতদের বিরুদ্ধে লঘু ধারায় মামলা দায়ের করে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়। ছাড়া পেলেও রণজয় ‘বদলা’ নিতেই এলাকা থেকে লোকজন নিয়ে এসে থানায় ঢুকে হামলা চালান বলে অভিযোগ।
অভিযুক্ত রণজয়ের দাবি, তিনি লেক লাগোয়া ওই হলের সামনে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছিলেন। সেই সময়ে কয়েক জন পুলিশকর্মী এসে তাঁদের সেখান থেকে চলে যেতে বলেন। রণজয় স্বীকার করেছেন যে, তিনি সেই সময়ে মত্ত অবস্থায় ছিলেন। রণজয় বলেন, ‘‘মত্ত বুঝতে পেরে পুলিশ আমাকে হেনস্থা করতে থাকে ও টাকা চায়। আমি টাকা দিতে অস্বীকার করলে ওরা আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। আমাকে টালিগঞ্জ থানায় নিয়ে গিয়ে মারধর করে। আমার মোবাইল ফোন ভেঙে দেয়। তার মধ্যেই আমি আমার পাড়া, চেতলার ১৭ নম্বর বস্তির কয়েক জনকে ফোন করে ঘটনাটি জানাই।’’
রণজয়ের ফোন পেয়েই সেই রাতে চেতলার ১৭ নম্বর বস্তির বেশ কিছু বাসিন্দা টালিগঞ্জ থানায় চলে আসেন। তাঁদের অধিকাংশই মহিলা। রণজয়ের মা ঝর্না হালদার বলেন, ‘‘আমার ছেলেকে কেন আটকে রাখা হয়েছে জিজ্ঞাসা করাতেই পুলিশ আমাদের মারধর শুরু করে। তার প্রতিরোধ করতে গিয়েই আমাদের কয়েক জন পুলিশের উপরে চড়াও হয়। পুলিশই প্রথমে আমাদের মারধর করে।’’ নিশা নস্কর নামে ওই বস্তির এক তরুণীর অভিযোগ, বেশ কয়েক জন মহিলাকে লাঠিপেটা করে পুলিশ। লাঠির আঘাতে অনেকের পিঠে, হাতে, কোমরে কালশিটে পড়ে যায়। দীপঙ্কর সিংহ নামে এক যুবকের মাথা ফেটে যায় বলেও অভিযোগ। লালবাজারের এক কর্তা জানিয়েছেন, লাঠি চালানোর কোনও ঘটনা আদৌ ঘটেছে কি না, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। সিসিটিভি ফুটেজও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।