বিশ্বজিৎবাবুর সঙ্গে আদ্রিকা। নিজস্ব চিত্র
রক্তে প্রোটিন-সির মারাত্মক ঘাটতি নিয়ে মে মাসে জন্মেছিল আদ্রিকা দাস। বিশ্বে প্রতি ৪০ লক্ষ জনসংখ্যায় মাত্র এক জনের এই অতি বিরল শারীরিক সমস্যা হয়। এ দেশেও হাতে গোনা কয়েক জনেরই এই সমস্যা রয়েছে। যকৃৎ প্রতিস্থাপনই ছিল বাগুইআটির বাসিন্দা ওই শিশুটির সেরে ওঠার একমাত্র পথ। গত ২১ অক্টোবর চেন্নাইয়ের এক হাসপাতালে ওই শিশুর শরীরে প্রতিস্থাপিত হয়েছে তার মেসোমশাই বিশ্বজিৎ মজুমদারের যকৃতের অংশ। আপনজনের থেকে এই ‘বিরল’ উপহার পেয়ে সুস্থ জীবনে ফিরছে পাঁচ মাসের আদ্রিকা। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, যকৃতের দাতা এবং গ্রহীতা দু’জনেই ভাল আছেন।
রক্তে প্রোটিন-সির ঘাটতির মতো যে অতি বিরল রোগ নিয়ে জন্মেছিল আদ্রিকা, চিকিৎসার পরিভাষায় তার নাম ‘প্রোটিন-সি ডেফিশিয়েন্সি’। এই প্রোটিন তৈরি হয় যকৃতে। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, শরীরের কোথাও রক্ত জমাট বাঁধলে প্রোটিন-সি, প্রোটিন-এসের মতো উপাদানগুলি তা প্রতিরোধ করে রক্তকে তরল রাখে। কিন্তু উপাদানগুলির অভাব থাকলে ধমনীর মধ্যে রক্ত জমাট বাঁধতে থাকে। এক-দু’দিন অন্তর তখন রোগীকে প্লাজমা দিতে হয়। এর স্থায়ী সমাধান হচ্ছে যকৃৎ প্রতিস্থাপন। কিন্তু আদ্রিকার বাবা-মা, ডিফেন্স-অডিট কর্মী দীপাঞ্জন দাস ও তাঁর স্ত্রী মৌমিতার জিন পরীক্ষা করে জানা যায় যে, তাঁরা দু’জনেই এই রোগের বাহক বা ‘কেরিয়ার’। ফলে রক্তের সম্পর্ক রয়েছে, এমন কারও যকৃতের অংশই আদ্রিকাকে দেওয়া সম্ভব ছিল না। তখন পাঁচ মাসের শিশুকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন বিশ্বজিৎবাবু।
চেন্নাইয়ের পেডিয়াট্রিক হেপাটোলজিস্ট জগদীশ মেনন এই যকৃত প্রতিস্থাপন করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘রোগটি অত্যন্ত বিরল বলে রোগ সম্পর্কে চিকিৎসকদের ধারণাও কম। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ডাক্তারেরা এটি ধরতে পারেন না। সাধারণ জনসংখ্যায় এই রোগ নির্ণয়ের হার মাত্র ০.১-০.৪ শতাংশ। আদ্রিকার ভাগ্য ভাল, কলকাতার চিকিৎসকেরা রোগটা ধরতে পেরেছেন এবং ও এক জন যকৃৎদাতাকে পেয়েছে। এত ছোট শিশুর দেহে প্রতিস্থাপন করাটাও বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।’’
হেপাটোলজিস্ট অভিজিৎ চৌধুরীর মতে, ‘‘প্রোটিন-সি ঘাটতি সত্যি অতি বিরল শারীরিক অবস্থা।’’ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ‘ইমিউনো হেমাটোলজি অ্যান্ড ব্লাড ট্রান্সফিউশন’ বিভাগের প্রধান প্রসূন ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘যকৃৎ খারাপ হলে সাধারণত প্রতিস্থাপন হয়। সেই সংখ্যাটাই যথেষ্ট কম। সেখানে রক্তের সমস্যায় যকৃৎ প্রতিস্থাপন, তা-ও এত ছোট শিশুর শরীরে, সত্যিই অভাবনীয়।’’ আদ্রিকার শরীরে এই রোগ নির্ণয়কারী, কলকাতার শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ বিক্রমজিৎ দাস জানাচ্ছেন, শিশুটির রক্তনালীতে রক্ত জমাট বাধার কারণ হিসেবে প্রথমে সংক্রমণ, ট্রমা বা আঘাত, পোড়া রয়েছে কি না তা দেখেছিলেন। তার পরে প্রোটিন-সির ঘাটতি খতিয়ে দেখেন। তখনই রোগের কথা জানা যায়।
আদ্রিকার যকৃৎ-দাতা, দমদমের জপুরের বাসিন্দা বিশ্বজিৎবাবুও পেশায় চিকিৎসক। চেন্নাইয়ের হাসপাতাল থেকে ফোনে বললেন, ‘‘আমারও চার মাসের ছেলে আছে। আদ্রিকাও আমার সন্তানের মতোই। শুধু যকৃৎ প্রতিস্থাপন হবে না বলে সে অকালে ঝরে যাবে, এটা মানতে পারিনি। তাই সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করিনি।’’ বিশ্বজিৎবাবুকে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা হারিয়েছেন আদ্রিকার বাবা-মা। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, পরিবারের সদস্যেরা এই ভাবে দাতা হিসাবে এগিয়ে এলে সিংহভাগ সমস্যা মিটে যায়। যেমন, গত ৪ অক্টোবর কলকাতারই এক চিকিৎসক ব্রিজমোহন ভালোটিয়া তাঁর যকৃতের অংশ দান করেছেন নিজের ভায়রাভাইকে।