রাজু পাল।
মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে জীবনটা আমূল বদলে গিয়েছে টবিন রোডের বাসিন্দা বছর ছত্রিশের রাজু পালের।
অন্য পাঁচ জনের মতো স্বাভাবিক ভাবে মলত্যাগ করতে এখন আর পারেন না তিনি। রাজুর পেটের বাঁ দিকে কোলোস্টোমি (বিশেষ ধরনের অস্ত্রোপচার) করে একটি ব্যাগ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। সেখানেই শরীরে একটি ফুটো করা হয়েছে। যেখান থেকে মল বেরিয়ে ওই ব্যাগে জমা হয়। কত দিন রাজুকে এ ভাবে থাকতে হবে, আদৌ সারা জীবনে এই যন্ত্রণা থেকে তিনি মুক্তি পাবেন কি না, জানাতে পারেননি চিকিৎসকেরা।
অভিযোগ, সামান্য ‘পেরিনিয়াল অ্যাবসেস’ বা মলদ্বারের ফোড়ার অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে চিকিৎসা-গাফিলতির জেরে ওই যুবকের এমন পরিণতি। এই ঘটনায় কাঠগড়ায় উত্তর শহরতলির সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ। সেখানেই গত ২১ জুলাই অস্ত্রোপচার হয় রাজুর। কিন্তু তার পরপরই ওই যুবকের অবস্থা এমন সঙ্কটজনক জায়গায় পৌঁছয় যে, প্রাণ বাঁচাতে বেসরকারি হাসপাতালে আরও দু’টি অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে তাঁকে। ভবিষ্যতে আরও একটি অস্ত্রোপচার করতে হবে বলে চিকিৎসকেরা জানিয়ে দিয়েছেন।
গত কয়েক মাস শারীরিক কারণেই ঘরবন্দি ছিলেন রাজু। প্রথমে ‘দিদিকে বলো’য় সাগর দত্ত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানান। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ঠিক করেন, আইনি পথে যাবেন। এর পরেই গত ৩ মার্চ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে, সেখানকার সার্জারি বিভাগে এবং বেলঘরিয়া থানায় চিকিৎসায় গাফিলতির লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, তাঁরা বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন।
রাজুর অভিযোগ, প্রথম বার অস্ত্রোপচারের পরেও যন্ত্রণা কমছিল না। তখন ফের সাগর দত্তে তাঁর ড্রেসিং হয়। সে সময়ে তিনি দেখেছিলেন, আপনাআপনি পুঁজ ও মল বেরিয়ে শয্যা ভরে যাচ্ছে। রাজুর দাবি, তা সত্ত্বেও চিকিৎসকেরা জানান অস্ত্রোপচার ঠিক আছে। এক দিন পরেই, ২২ জুলাই তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তার পরপরই তিনি সেপ্টিসেমিয়ায় আক্রান্ত হন। এমআরআই করে রাজুর মলনালিতে ফুটো ধরা পড়ে। ২৫ জুলাই এক বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক পার্থ সরকারের কাছে ফের অস্ত্রোপচার করে তাঁর দেহ থেকে পুঁজ ও মল বার করা হয়। তার পরে বেলেঘাটার এক নার্সিংহোমে কোলোস্টোমি করে রাজুর শরীরের বাইরে ব্যাগ বসান চিকিৎসক দেবকুমার রায়।
সাগর দত্ত হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের প্রধান মানস গুমটার কথায়, ‘‘অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত হবে। তবে মনে হচ্ছে, আমাদের হাসপাতালে হয়তো পুঁজ সম্পূর্ণ বার করা হয়নি। এই ধরনের অসমাপ্ত অস্ত্রোপচারে মলনালি ফুটো হয় না। সেটা পরবর্তী অস্ত্রোপচারে হয়েছে কি না, দেখতে হবে।’’ কিন্তু রোগী তীব্র যন্ত্রণার কথা বলা সত্ত্বেও কেন তাঁকে এক দিন পরেই ছেড়ে দেওয়া হল? যন্ত্রণার কারণ জানতে তখনই কেন এমআরআই করা হল না? মানসবাবুর উত্তর, ‘‘হয়তো চিকিৎসকদের কথা বলা বা বোঝানোয় কোনও ফাঁক থেকে গিয়েছে।’’
রাজুর দ্বিতীয় অস্ত্রোপচার করেছিলেন যে চিকিৎসক, সেই পার্থবাবু বলেন, ‘‘এমআরআই রিপোর্টে স্পষ্ট বলা আছে, ওই রোগীর মলনালি ফুটো (মিউকয়জাল টিয়ার) হয়ে গিয়েছে। যে কোনও চিকিৎসকই এটা বুঝতে পারবেন। তখনই অস্ত্রোপচার করে মল আর পুঁজ বার করা না-হলে সেপ্টিসেমিয়ায় তাঁর মৃত্যু হতে পারত।’’ ওই যুবকের কোলোস্টোমি যিনি করেছিলেন, সেই চিকিৎসক দেবকুমার রায় অবশ্য গোটা ঘটনা প্রসঙ্গে কিছু বলতে চাননি।
আর রাজু শুধু বলছেন, ‘‘আমার পরিবারে স্ত্রী, মেয়ে, বৃদ্ধ মা-বাবা রয়েছেন। আমিই একমাত্র রোজগেরে। সুস্থ হতে গিয়ে যা অবস্থা, তাতে কাজ করে সংসার চালানোই দুষ্কর হয়ে উঠছে। যাঁরা আমার এই অবস্থার জন্য দায়ী, তাঁদের শাস্তি চাই।’’