২০২৩ সালের ৮ অগস্ট ক্যামেরাবন্দি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের লেটার বক্স। ছবি: সারমিন বেগম।
বৃহস্পতিবারের তারিখ ছিল ৮/৮ (৮ অগস্ট)। শূন্য ফ্ল্যাটের মতোই শূন্য হয়ে গেল ৫৯ নম্বর পাম অ্যাভিনিউয়ের লেটার বক্স। যাঁর নামে চিঠি আসত, তাঁর জন্য নির্দিষ্ট লেটার বক্সের অপেক্ষাও চিরতরে শেষ হয়ে গেল বৃহস্পতিবার। পাম অ্যাভিনিউয়ের সরকারি আবাসনের ‘এ’ ব্লকের এক তলা ঘর ছেড়ে শেষ বারের মতো বেরিয়ে গেলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
ঠিক এক বছর আগে ২০২৩ সালের ৮/৮ (৮ অগস্ট) এই ফ্ল্যাটের বাইরে লেটার বক্সের ছবি প্রকাশিত হয়েছিল আনন্দবাজার অনলাইনে। ঘটনাচক্রে, সে দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন বুদ্ধদেব। তার পরদিন তিনি বাড়ি ফিরেছিলেন। বছর ঘুরতে ঘুরতে না ঘুরতে প্রয়াত একটা সময় পর্যন্ত সিপিএম, বামফ্রন্ট এবং বাংলার ‘কর্নেল’ বুদ্ধদেব। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ারও অবকাশ হল না।
স্প্যানিশ লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ় বুদ্ধদেবের অন্যতম প্রিয় ছিলেন। নোবেলজয়ী মার্কেজ়ের বিখ্যাত উপন্যাস ‘নো ওয়ান রাইট্স টু দ্য কর্নেল’। কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না। ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পর বুদ্ধদেব নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। এমনিতেও তখন মোবাইলের যুগ শুরু হয়ে গিয়েছে। চিঠি লেখার রেওয়াজ ক্রমশ কমছে। আর হোয়াট্সঅ্যাপের যুগ শুরু হওয়ার পর তো চিঠি লেখা বন্ধ! আশ্চর্য নয় যে, বুদ্ধদেবের নামাঙ্কিত লেটার বক্সে ধুলো জমেছিল।
ক্ষমতায় থাকার সময় অবশ্য এই লেটার বক্সের ঠিকানায় চিঠি আসত। মহাকরণের মতো বাড়ির টেবিলেও জমত সে সব চিঠি। বুদ্ধদেবের মন্ত্রী থেকে মুখ্যমন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রী থেকে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সাক্ষী ছিল এই লেটার বক্স। ২০১১ সালের পরে রাজনীতির নিয়মেই কমে গিয়েছিল চিঠি আসা। লেটার বক্সের কাচের ‘চোখ’ ধুলোয় ঝাপসা। ধুলোর স্তর দিন দিন বেড়েছে বাক্সের উপরেও। চিঠি ফেলার মুখে জাল বুনেছে মাকড়সা। কোনও মতে ঝুলছিল ছোট তালা। চাবির খোঁজ ছিল না তার!
সরল, সাধাসিধে জীবনযাপনের জন্য বরাবর সম্মান পেয়েছেন বুদ্ধদেব। বাম জমানায় দক্ষিণ কলকাতার এই ফ্ল্যাটে এলেও বুদ্ধদেব আগে থাকতেন এন্টালি বাজারের কাছে হরলাল দাস স্ট্রিটে। পাম অ্যাভিনিউয়ের এই সরকারি আবাসনটি তৈরি হয়েছিল বামেরা ক্ষমতায় আসার পরে। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী আবাসনের বাসিন্দা হন ১৯৮০ সাল নাগাদ। তখন তিনি মন্ত্রী। ১৯৭৭ সালে প্রথম বার ভোটে জিতেই জ্যোতি বসুর মন্ত্রিসভায় তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। ঠিক এক বছর আগে তোলা ছবি বলছে, লেটার বক্সের গায়ে লেখা রয়েছে সেই সময়টাও।
খয়েরি রঙের বাক্সের গায়ে সাদা রঙে বাংলায় লেখা, ‘শ্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, মন্ত্রী, তথ্য ও সংস্কৃতি দফতর’। সেই লেখাটি পুরোপুরি দেখা না গেলেও সর্বশেষ পরিচয়ের সাদা স্টিকারের পিছন থেকে উঁকি মারে। ১৯৯৯ সালে উপমুখ্যমন্ত্রী হন বুদ্ধদেব। তখন অবশ্য লেটার বক্সের পরিচয় বদলায়নি। তখনও সম্ভবত নিজের অধীন তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের পরিচয়ই রাখতে চেয়েছিলেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাইপো। এক বছর পরে তিনি যখন মুখ্যমন্ত্রী, তখনও তথ্য ও সংস্কৃতি দফতর তাঁর হাতেই। ফলে তখনও পরিচয় বদলায়নি। শুধু তুলনায় ছোট হরফে লেখা ছোট স্টিকার সাঁটা হয়েছিল লেটার বক্সের নীচে বাঁ দিক ঘেঁষে। ‘বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, অনারেবল চিফ মিনিস্টার’।
রাজ্যে পালাবদলে সেই স্টিকারও প্রাক্তন হয়ে গিয়েছিল। এর পরে লাগানো স্টিকারে আর ‘প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী’ বলে উল্লেখ থাকেনি। স্ত্রী মীরা ভট্টাচার্যের সঙ্গে ‘যৌথ’ নামে ছিল লেটার বক্স। সাদা কাগজে ইংরেজিতে লেখা ‘শ্রী অ্যান্ড শ্রীমতী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য’।
বৃহস্পতিবার থেকে শুধু মীরা ভট্টাচার্যের নামে হয়ে যাবে প্রাচীন লেটার বক্স! ইহলোকের ঠিকানা হারানো ‘কর্নেল’কে চিঠি লেখা বন্ধ হয়েছিল আগেই। এখন তো কর্নেলই আর রইলেন না। সময়ের সঙ্গে বিস্মৃতির ধুলো আরও পুরু হবে চিঠির বাক্সে।