প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের লেটার বক্স। ছবি: সারমিন বেগম।
তাঁর অন্যতম প্রিয় লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ়। যাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’।
তিনিও তো এক সময়ে ‘কর্নেল’ই ছিলেন। বামফ্রন্টের ‘কর্নেল’। সিপিএমের ‘কর্নেল’। বাংলার ‘কর্নেল’। ‘কর্নেল’ হিসাবেই তিনি যুদ্ধ জিতেছিলেন। তখন তিনি ব্যস্ত, সক্রিয়, সুস্থ। তখন তাঁর কাছে, তাঁর টেবিলে জমত চিঠির পাহাড়। মহাকরণে এবং বাড়িতে। ২০১১ সালের যুদ্ধে তিনি পরাজিত। ক্রমে অবসৃত, নিষ্ক্রিয়, অসুস্থ। তাঁকে আর কেউ চিঠি লেখে না।
১১ দিন পর হাসপাতাল থেকে বুধবার বাড়ি ফেরার কথা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের। অপেক্ষায় পাম অ্যাভিনিউয়ের ফ্ল্যাট। অপেক্ষায় অনেক ইতিহাসের সাক্ষী থাকা আবাসনের ১ নম্বর ফ্ল্যাটের লেটার বক্সটাও।
এই লেটার বক্স শুধু বুদ্ধদেবের নয়, চিঠির অপেক্ষাতেও রয়েছে। যদি কেউ চিঠি পাঠায়! অনেক দিন যে কোনও চিঠি আসেনি তা তার চেহারায় স্পষ্ট। চিঠি এসেছে কি না দেখার জন্য কাচের ‘চোখ’ থাকলেও সেটি ধুলোয় ঝাপসা। ধুলোর আস্তরণ বাক্সের উপরে। আর চিঠি ফেলার জন্য বাক্সের যে মুখ, তাতে কবেই যেন জাল বুনে রেখেছে মাকড়সা। আর সেই বাক্সের গায়ে একটা তালাও রয়েছে। তবে সেটি লাগানো নেই। এমনিই ঝুলছে। চাবিটা কোথায় কে জানে!
কিছু দিন আগেই এই সরকারি আবাসন রং হয়েছে। নীল-সাদা ভবনের সাদা রং গড়িয়ে পড়েছে লেটার বক্সের গায়েও। তবে তা ইতিহাসকে ঢেকে দিতে পারেনি। আসলে এই লেটার বক্সই তো বুদ্ধদেবের মন্ত্রী থেকে মুখ্যমন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রী থেকে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সাক্ষী হয়ে রয়েছে। এখন যে তালাটা হেলায় ঝুলছে সেটিই এক দিন অনেক গুরুত্বপূর্ণ চিঠি পাহারা দিয়েছে।
৫৯, পাম অ্যাভিনিউ। এই সরকারি আবাসনের এক তলায় ফ্ল্যাট বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের। ছবি: সারমিন বেগম।
রাজনীতিক বুদ্ধদেব আগে থাকতেন এন্টালি বাজারের কাছে হরলাল দাস স্ট্রিটে। ৫৯, পাম অ্যাভিনিউয়ের সরকারি আবাসন তৈরি হয়েছিল বাংলায় বামেরা ক্ষমতায় আসার পরে পরে। বুদ্ধদেব ‘এ’ ব্লকের এক তলার বাসিন্দা হন ১৯৮০ সাল নাগাদ। তখন তিনি রাজ্যের মন্ত্রী। ১৯৭৭ সালে প্রথম বার ভোটে জিতেই জ্যোতি বসুর মন্ত্রিসভায় তথ্য সংস্কৃতি দফতর পেয়েছিলেন। দীর্ঘ দিনের লেটার বক্সের গায়ে লেখা রয়েছে সেই সময়টা। খয়েরি রঙের বাক্সের গায়ে সাদা রঙে বাংলায় লেখা হয়েছিল, ‘শ্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, মন্ত্রী, তথ্য ও সংস্কৃতি দফতর’। সেই লেখাটা এখন আর পুরোপুরি দেখা যায় না। তবে বর্তমান পরিচয়ের সাদা স্টিকারের পিছন থেকে এখনও উঁকি মারে অতীত। বর্তমান স্টিকারে তিনি যে ‘প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী’ তার উল্লেখ নেই। স্ত্রী মীরা ভট্টাচার্যের সঙ্গে এখন তাঁর ‘কমন’ লেটার বক্স এটা। সাদা কাগজে ইংরেজিতে ‘শ্রী অ্যান্ড শ্রীমতী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য’।
১৯৯৯ সালে উপমুখ্যমন্ত্রী হন বুদ্ধদেব। সরকারি ‘লেটারহেড’ বদলালেও লেটার বক্সের লেখা বদলায়নি। সেই পরিচয়ের উল্লেখ নেই লেটার বক্সে। তখনও সম্ভবত নিজের হাতেই থাকা ‘প্রিয়’ তথ্য সংস্কৃতি দফতরের উল্লেখ রাখতে চেয়েছিলেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাইপো বুদ্ধদেব। এক বছর পরে তিনি যখন মুখ্যমন্ত্রী হন তখনও তথ্য ও সংস্কৃতি দফতর তাঁর হাতেই ছিল। ফলে তখনও মোছা হয়নি। বরং, অনেক ছোট হরফে ছোট একটা স্টিকার পড়েছিল লেটার বক্সের নীচে বাঁ দিক ঘেষে। সেই স্টিকারটা এখনও রয়ে গিয়েছে। লেখা, ‘বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, অনারেবল চিফ মিনিস্টার’।
এই আবাসনে বুদ্ধদেবের পাশের ফ্ল্যাটটা প্রয়াত সিপিএম নেত্রী শ্যামলী গুপ্তের। তাঁর লেটার বক্সটাও রয়েছে। তবে দীর্ঘ সময় সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য থাকা শ্যামলীর পরিচয় লেখা নেই। এখানেই ফ্ল্যাট রয়েছে কংগ্রেসের রাজ্যসভা সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্যের। বুদ্ধদেব বা শ্যামলীর লেটার বক্সের মতো ‘ধুলোমাখা’ দশা নয় প্রদীপেরটা। তবে তালাটি খোলা। আসলে সময়ের প্রতীক হয়ে তিন লেটার বক্সের না-বলা কথা একই— প্রাক্তন বা বর্তমান কারও কাছেই চিঠিরা আর আসে না। মানুষের জন্য অপেক্ষা থাকলেও লেটার বক্স আর চিঠির পথ চেয়ে থাকে না।
অবসৃত, নিষ্ক্রিয়, অসুস্থ এবং অশক্ত ‘কর্নেল’কে আর কেউ চিঠি লেখে না।