ফাইল ছবি
এসএসকেএম হাসপাতালে পার্থ চট্টোপাধ্যায় ভর্তি হওয়ার পরেই বিরোধীদের অভিযোগ ছিল, জিজ্ঞাসাবাদ এড়াতে ওই সরকারি হাসপাতালকে ‘প্রভাবশালী’রা ‘নিরাপদ আশ্রয়’ হিসেবে বেছে নিচ্ছেন। সোমবার ভুবনেশ্বর এমসের চিকিৎসকেরা পার্থকে ভর্তি রাখার প্রয়োজন নেই বলে জানিয়ে দেওয়ার পরে চিকিৎসকদের মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে, বার বার ‘নিরাপদ আশ্রয়স্থল’ হয়ে ওঠায় পূর্ব ভারতে চিকিৎসার উৎকর্ষ কেন্দ্র বলে পরিচিত এই হাসপাতালের গরিমাহানি হচ্ছে না তো?
এ দিন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য বলেন, ‘আমার লজ্জা লাগছিল। বলে কি না, ওড়িশায় এমসে নিয়ে যেতে হবে চিকিৎসা করতে! সারা ভারতে পিজি এক নম্বরে।...কেন বাবা? কেন্দ্রীয় সরকারের যেখানে ছোঁয়া আছে,... এমস-ওড়িশায় নিয়ে যেতে হবে!’’
মুখ্যমন্ত্রী ভারতসেরার তকমা দিলেও পিজিকে ঘিরে সাম্প্রতিক অভিযোগের ঝড়ে বিরক্ত ও হতাশ অনেক চিকিৎসকই। যদিও ওই হাসপাতালের কোনও চিকিৎসক মুখ খুলতে রাজি হননি। রবিবার হাই কোর্টের বিচারপতি বিবেক চৌধুরীও ওই হাসপাতালকে ‘প্রভাবশালীদের নিরাপদ স্থান’ বলে মন্তব্য করেন। রায়ে তিনি লেখেন, সম্প্রতি রাজ্যের শাসকদলের একাধিক নেতা তদন্তকারীদের তলব পেয়েই সেখানে ভর্তি হয়েছেন ও জিজ্ঞাসাবাদ থেকে ছাড় মেলার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পরে বেরিয়েছেন। এমসের মন্তব্যের পরে এসএসকেএমকে ঘিরে আরও বেশি প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার হাতে কিংবা অন্য কিছুর জন্য গ্রেফতার হওয়ার পরই রাজ্যের মন্ত্রী, ‘প্রভাবশালী’দের এসএসকেএমে ভর্তি হয়ে যাওয়ার নজির বিরল নয়। অনুব্রত মণ্ডল, মদন মিত্র, আরাবুল ইসলামেরা সেখানে একাধিক বার ভর্তি হয়েছেন।
অভিযোগ, বহু নেতাই জরুরি বিভাগে চিকিৎসককে না দেখিয়েই উডবার্ন ব্লকে ঢুকে পড়তেন। বিষয়টিকে যে সকলে ভাল ভাবে নিতেন, তা নয় বলেই জানাচ্ছেন চিকিৎসকদের একাংশও। যদিও পার্থর ক্ষেত্রে এ বার উডবার্ন ব্লক হয়নি। কারণ, সরাসরি সেখানে তিনি ভর্তি হতে পারবেন না বলেই আগেই মন্তব্য করেছিল হাই কোর্ট। সেই মতো জরুরি বিভাগে আসার পরে কার্ডিয়োলজি বিভাগে ভর্তি করা হয় পার্থকে। কিন্তু এ দিন এমসের চিকিৎসকেরা যখন ভর্তির প্রয়োজনীয়তা নেই বলে জানান, তখন স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, তা হলে পিজিতে কেন সেটা করা হয়েছিল? শহরের এক সরকারি চিকিৎসকের কথায়, “বহু ক্ষেত্রেই আমরা ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রশাসনের শীর্ষ স্তরের চাপের কাছে হেরে যাই।” তবে কিছু চিকিৎসকের এটাও দাবি, সব জায়গার চিকিৎসা পদ্ধতি এক নয়। পিজিতে যখন পার্থ এসেছিলেন, তখন তাঁর শারীরিক অবস্থার নিরিখে ভর্তির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলেই মনে করেছিলেন চিকিৎসকেরা।
সরব হয়েছেন বিরোধীরাও। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেন, “পিজি ছিল রাজ্যের সম্পদ। ভাল চিকিৎসকদের বদলি করা হয়েছে। চোরদের বিভিন্ন কমিটির মাথায় বসানো হয়েছে। রাজ্যের সম্মান ধুলোয় মিশে গিয়েছে। এখন বিচারপতিরাও সেই কথা বলছেন। হাসপাতালের তথ্য আদালতে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না।” অনেক দিন ধরেই এসএসকেএমের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করা হয়েছে বলে অভিযোগ রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীরও। এই ঘটনায় চিকিৎসক সমাজের ভাবমূর্তির অবনতি হওয়ার আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন চিকিৎসক সংগঠনগুলিও। সার্ভিস ডক্টর্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক, চিকিৎসক সজল বিশ্বাসের কথায়, “বার বার সরকার ও শাসকদলের চাপে এক দল চিকিৎসক আদর্শ বিরোধী কাজ করে চলেছেন। এর ফলে চিকিৎসকদের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে।” আবার ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টর্স ফোরামের তরফে কৌশিক চাকী বলছেন, “খুবই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। তবে আমলা, পুলিশের অনেকেই যখন যে ক্ষমতায় থেকেছেন, তাদের সঙ্গে চলেছেন। আর ওই নেতারা প্রশাসনকে নিজেদের সুবিধার্থে ব্যবহারের চেষ্টা করেন। যাঁরা সায় দেন না, তাঁদের বিপদে ফেলার উদাহরণও প্রচুর রয়েছে।”
বিজেপির রাজ্য যুব সভাপতি, চিকিৎসক ইন্দ্রনীল খানের মন্তব্য, “যেখানে সঙ্কটজনক রোগী শয্যা চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হচ্ছেন, সেখানে তৃণমূলের যে মন্ত্রীর ভর্তির প্রয়োজন নেই, তিনিও হাসপাতালে থেকে পাঁচতারা হোটেলের সুবিধা পাচ্ছেন।” যদিও পিজির চিকিৎসকদের বড় অংশের দাবি, তাঁদের কাছে সব রোগীই সমান। কোনও মন্ত্রী বা নেতা রোগী হিসেবে এলে তাঁকেও একই পরিষেবা দেওয়া হয়। তাঁদের আরও দাবি, পার্থর ক্রনিক রোগ রয়েছে। সেগুলির বাড়াবাড়ি হয়েছিল বলেই ভর্তি করা হয়েছিল। এক বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক কুণাল সরকারের কথায়, “উৎকর্ষ কেন্দ্র পিজিতে লক্ষাধিক মানুষ চিকিৎসার জন্য আসছেন। সেখানে মুষ্টিমেয় কিছু রাজনৈতিক নেতা চোর-পুলিশ খেলায় লুকোনোর জন্য এর অপব্যবহার করছেন। যা হতাশাজনক হয়ে যায়। অদূর ভবিষ্যতে যদি শুনতে হয় চিকিৎসকেরাও রাজনৈতিক দলের অনুগত, তা হলে সব কিছু এক ধাক্কায় নষ্ট হয়ে যাবে।”