নন্দনে লরেন্স কার্ডিশ। রবিবার। —নিজস্ব চিত্র।
সিনেমা মানে শুধু সমকাল বা ভবিষ্যৎ নয়। অতীতও বটে, যে ঐতিহ্যের ভিতে মাথা তোলে সমকালের ইমারত। একান্ত আলাপে সে কথাই বলছিলেন নিউ ইয়র্কের মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টের (মোমা) চার দশকের কিউরেটর লরেন্স কার্ডিশ। ‘‘আমেরিকাতেও নির্বাক যুগের কত ছবি বিলুপ্ত। বাংলা ছবিরও সমস্যা আলাদা, আলাদা বেসরকারি প্রযোজক। অযত্নে, অবহেলায় ছড়ানো পুরনো ছবির প্রিন্ট বাঁচাতে সরকারি দায়বদ্ধতা চাই। আর পুণের ফিল্ম আর্কাইভ ছাড়া সিনেমার মিউজিয়াম গোত্রের কিছু তো মনে হয় ভারতে নেই,’’ নন্দনের ভিআইপি লাউঞ্জে বসে বলছিলেন ল্যারি (চলচ্চিত্র জগতে এই নামেই কার্ডিশের পরিচয়)।
মোমা-র কিউরেটরের ভূমিকায় সিনেমা প্রদর্শনী বা শো আয়োজন এবং সেখানকার সিনেমা সংগ্রহের ভাঁড়ার পুষ্ট করাই ল্যারির জীবনব্রত ছিল। ১৯৮১-তে হীরক রাজার দেশে, পিকু পর্যন্ত সত্যজিৎ রায়ের সব ছবি প্রথম বার একসঙ্গে নিউ ইয়র্কে দেখানো, ভারতীয় ছবির ইতিহাস উপস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানেও জড়িয়ে ছিলেন তিনি। সত্যজিতে তাঁর মুগ্ধতা অবশ্য তরুণ বয়সেই। কানাডার অটোয়ায় ফিল্ম সোসাইটির শোয়ে যখন ‘পথের পাঁচালী’ দেখেন।
শনিবার কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে (কিফ) সত্যজিৎ রায় স্মারক বক্তৃতায় ১৯৮১-তে মোমা-য় সত্যজিৎ প্রদর্শনীর গল্প শোনান ল্যারি। বলেছেন, নিউ ইয়র্কের একটি রেল স্টেশনে সত্যজিতের সঙ্গী, বন্ধু তথা শিল্প নির্দেশক বংশী চন্দ্রগুপ্তের আকস্মিক মৃত্যুর ধাক্কার কথাও। নিউ ইয়র্কেই বংশীর শেষকৃত্য সারা হয়। ভারাক্রান্ত মনে বন্ধুর চিতাভস্ম নিয়ে দেশে ফেরেন সত্যজিৎ। ল্যারিকেই সত্যজিতের ‘সিকিম’-এর উদ্ধারকারী বলা যায়। ‘সিকিম’ পছন্দ হয়নি তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের। সিকিমের ভারতভুক্তির পরে ছবিটি চিরতরে হারিয়ে গিয়েছে, ধরে নিয়েছিলেন সত্যজিৎ। কিন্তু মোমা-র প্রদর্শনীর সময়ে কপাল ঠুকে নিউ ইয়র্কে বসবাসকারী সিকিমের রাজকন্যার বাড়িতে খোঁজ করতে গিয়েই বাজিমাত! ল্যারি বলছিলেন, “রাজকন্যা নিরুত্তাপ ভাবে আমাদের বললেন, সিকিম-এর এক কপি ওঁর সঙ্গে আছে বটে! ছবির প্রিন্টটা ওঁর বাড়ির ওয়াশিং মেশিনের উপরে রাখা ছিল।”
নন্দন চত্বরে এখন চলছে শতায়ু মৃণাল সেন, দেবানন্দদের নিয়ে প্রদর্শনী। এর মধ্যে সত্যজিৎকে নিয়ে পুরনো গল্পে আবহ জমজমাট। ল্যারির আর একটি গর্ব, প্রথম বার আমেরিকায় তাঁর প্রিয়তম সত্যজিৎ-সৃষ্টি ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’র শো আয়োজনও। আড্ডার ফাঁকে বলছিলেন, “ছবিটি তো যাকে বলে এক দিনের গল্প। পাহাড়ি শহরে চরিত্রদের কয়েকটি হাঁটার সমষ্টি। এই চলমানতাই সিনেমার মেজাজ।”
প্রবীণ বয়সে আমেরিকার জর্জিয়ার কলম্বিয়া কাউন্টিতে বার্ষিক চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজনে দুনিয়া ঘুরে ছবি খোঁজেন ল্যারি। গোয়ায় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের (ইফি) ফিল্মবাজারেও যান। বলছিলেন, ‘‘বলিউড অতিকায় যুদ্ধজাহাজের মতো। কিন্তু ভারতে কত রকমের ছবি।’’ লুব্ধক চট্টোপাধ্যায়ের ‘হুইস্পার্স অব ফায়ার অ্যান্ড ওয়াটার’ নিয়ে যেমন খুবই আগ্রহী ল্যারি।
উৎসবের রবিবাসরে লুব্ধকের ছবি দেখেছে কলকাতা। ছুটির দিনে বড় পর্দায় এক্সরসিস্ট-এর ভয়াল আমেজ, পোলানস্কি, আলমোদোভারের সাম্প্রতিক ছবি থেকে ‘কেনেডি’ ছবিটি নিয়ে অনুরাগ কাশ্যপের উপস্থিতিতে উৎসব মেনু জমজমাট। ঝরিয়ার খনি এলাকায় এক শহুরে শব্দপ্রযুক্তি শিল্পীর জীবন বদলানো অভিজ্ঞতা নিয়ে লুব্ধকের ছবি কলকাতার আগে লোকার্নো, সাও পাওলো, নেপলস ঘুরেছে। ছবিটি আজ, সোমবার দুপুরে রাধা স্টুডিয়োয় দেখা যাবে। কলকাতার সিনেমার প্রসঙ্গে ল্যারি বললেন, ‘‘পশ্চিম ভারতে মুম্বই আর আমেরিকার পশ্চিমে লস অ্যাঞ্জেলেস হল বিনোদন তীর্থ। কিন্তু আত্মাকে স্পর্শ করা শিল্পের খোঁজে আমি পুবে কলকাতা বা নিউ ইয়র্ককে দেখব।’’ ল্যারির শেষ কথা ছিল, সূর্য তো পুবেই ওঠে!