সত্যজিৎ তখন নিতান্তই বালক, একটা কাগজে হিজিবিজি কিছু এঁকে নিয়ে রামদহিনের হাতে দিয়ে বলতেন: ‘রামদহিন, এটা সন্দেশে বেরোবে।’ রামদহিন তক্ষুনি মাথা নেড়ে বলে দিত, ‘হাঁ খোখাবাবু, হাঁ।’ তার পর তাঁর ছবিটাকে ক্যামেরার নীচের দিকে মুখ-করা লেন্সের তলায় বিছিয়ে রেখে তাঁকে কোলে তুলে ক্যামেরার পিছনের ঘষা কাচে দেখিয়ে দিত সে ছবির উল্টো ছায়া। ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী তাঁর তৈরি ছাপাখানায় ছোটদের জন্য ১৯১৩-র মে মাস থেকে যে সন্দেশ পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশ করতে শুরু করেছিলেন, সেখানেই কাজ করত রামদহিন। সত্যজিৎ রায়ের জন্মের ছ’বছর আগে মারা যান উপেন্দ্রকিশোর, আর তাঁর বয়স যখন আড়াই তখন অকাল-প্রয়াত হন পিতা সুকুমার, তাঁর প্রয়াণের পরেও বছর দুয়েক বেরিয়েছিল সন্দেশ। ১০০ নম্বর গড়পার রোডের বাড়িতে একতলার ছাপাখানায় সন্দেশ আর তার তিন রঙের মলাট ছাপা হত, দুপুরবেলায় সেখানে ঢুঁ মারতেন তিনি। দোতলার ঘরে সারি দিয়ে বসে কম্পোজ়িটররা, খোপকাটা হরফের বাক্সের উপর ঝুঁকে পড়ে হরফ বেছে পর পর বসিয়ে লেখার সঙ্গে মিলিয়ে লাইন তৈরি করছেন, তাঁদের পাশ কাটিয়ে চলে যেতেন ঘরের পিছন দিকে: “আজও তারপিন তেলের গন্ধ পেলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ইউ রায় অ্যান্ড সন্সের ব্লক মেকিং ডিপার্টমেন্টের ছবি।” এই স্মৃতি আর গড়পার রোডের বাড়িটিও কখনও পিছু ছাড়েনি সত্যজিতের, যখন ছোট ছিলাম-এ (আনন্দ) লিখেছেন, “গড়পার রোডের মতো এমন একটা অদ্ভুত বাড়িতে আর কখনো থাকিনি।”
২৯ বছর হল, সত্যজিৎ রায় (১৯২১-১৯৯২) আমাদের সঙ্গে নেই, ২৩ এপ্রিল ছিল মৃত্যুদিন, ২ মে জন্মদিনে তাঁর শতবর্ষ পূর্ণ হবে। জীবৎকালে পরম মুগ্ধতায় পিতামহ আর পিতার উত্তরাধিকারের কথা বলতেন, রায় পরিবারের সাহিত্যিক ঐতিহ্য মিশে গিয়েছিল তাঁর সত্তায়। ঠাকুরদার লেখার জাদু ও আঁকা ছবির কথা বলার সঙ্গে সত্যজিৎ জানাতে ভোলেন না যে বাবাকেও তিনি চিনেছিলেন তাঁর লেখা আর আঁকা থেকেই। ১৯৬১, রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষে সন্দেশ পত্রিকার পুনরুজ্জীবন ঘটানোর পাশাপাশি নিয়মিত লেখক-জীবনও শুরু করলেন সত্যজিৎ, সন্দেশ-এর প্রয়োজনেই: ‘Since then I have been writing and illustrating regularly…’
সত্যজিৎ-সুকুমার-উপেন্দ্রকিশোর, তিন প্রজন্মের সাহিত্য-পরম্পরাকে এক সুতোয় গাঁথার অভিনব আয়োজন— কলকাতার ‘সত্যজিৎ রায় সোসাইটি’-র সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে পেঙ্গুইন বুকস প্রকাশ করছে বই থ্রি রেজ়/ স্টোরিজ় ফ্রম সত্যজিৎ রায় (ছবিতে উপরে বাঁ দিকে তার প্রচ্ছদ)। সত্যজিতের অনুবাদে উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার আর তাঁর নিজের গল্পের সঙ্কলন। সত্যজিতের আঁকা এমন কিছু ইলাস্ট্রেশন আছে এ বইতে যা এখনও অগ্রন্থিত, যেমন শারদীয়া সন্দেশ-এর প্রচ্ছদ (১৩৯৭), ১৯৭২ সালের আনন্দমেলা-য় কর্ভাস-এর অলঙ্করণ (উপরের ছবিতে)। আছে উপেন্দ্রকিশোর-সুকুমারের ইলাস্ট্রেশনও। পূর্বসূরিদের প্রতিভা ও নিজের লেখা নিয়ে প্রাসঙ্গিক ভূমিকাও সত্যজিতের। বইটির সম্পাদক সন্দীপ রায় জানালেন: “বাবা চেয়েছিলেন রায় পরিবারের এই অনন্য সাহিত্য পরম্পরাকে অ-বাংলাভাষী সর্বভারতীয় পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে, তাই অবকাশ পেলেই অনুবাদ করতেন। সে ইচ্ছা বজায় রাখতেই শতবর্ষের এই শ্রদ্ধার্ঘ্য।”
আড্ডা শেষ
বন্ধুরা আর মাতবে না তরজায়! ফি রবিবার সকালে তাঁর উল্টোডাঙার বাড়িতে আর জড়ো হবে না কয়েক প্রজন্ম। সেখানে চা-মিষ্টির ফাঁকে ভূমেন গুহকে কেউ হাসতে হাসতে বলবে না, জীবনানন্দের কোনও ট্রাঙ্ক নেই, অপ্রকাশিত গল্প-উপন্যাসগুলি আসলে আপনার লেখা। ভূমেনবাবুও মিটিমিটি হেসে আর এক জনকে দেখিয়ে দেবেন, জানি তো এগুলি উৎপল রটায়। কবি উৎপলকুমার বসু আড্ডাতেই দুষ্টু হাসবেন। উৎপল বসু, সুধীর চক্রবর্তী, বাংলাদেশ থেকে বেড়াতে-আসা হাসান আজিজুল হকের পাশে সেই আড্ডাতেই হাজির তরুণ কবি জয়দেব বসু, ‘স্যর, বাংলাদেশে দেখলাম টাকে চুল গজানোর ওষুধ বেরিয়েছে, ভেবেছিলাম আপনার জন্য কিনব। কিন্তু কেনা হল না।’ গৃহকর্তার সকৌতুক প্রশ্ন, কেন? ছাত্রের উত্তর, ‘ভাবলাম, কানের পিছনে ওই দু’গাছিও যদি ঝরে যায়!’ ত্রৈলোক্যনাথের গল্পের মতো তিনি প্রধান আড্ডাধারী নন, নয়ানচাঁদের ব্যবসার গল্প ফেঁদে বসবেন না। অন্যরা বলবে, তিনি স্মিত হাসিতে দু’চারটি মন্তব্যে সবাইকে উস্কে দেবেন। এক তরুণ গল্পকারকে ভরদুপুরে বললেন, খেয়ে যেয়ো। সে লজ্জায় বলল, ‘না খাব না।’ গৃহকর্তার প্রশ্ন, ‘সে কি, তুমি খাও না না কি?’ এ সবের মাঝেই কোনও তরুণ কবিকে ডেকে তার কবিতার খাতা নিয়ে চলে যাবেন আড়ালে। চলবে কবিতা সংশোধন। শঙ্খ ঘোষের (ছবিতে) কবিতা, গদ্যসমগ্র সবই থেকে যাবে, থাকবে না ‘চল বেঁধে বেঁধে থাকি’র ওই আড্ডা। শেষ দিকে অশক্ত শরীরের ওপর চাপ পড়ত, কিন্তু তাঁকে দমায় কে! গত বছর করোনাকালের শুরুতেও চলেছে আড্ডা, এক দিকে নিজের শরীর খারাপ, অন্য দিকে তাঁর সুহৃদ আনিসুজ্জামান, অশ্রুকুমার সিকদার বা সুধীর চক্রবর্তীর মৃত্যুর খবরে বিষণ্ণ। তবু রবিবাসরীয় গল্পগুজবের মানসিকতা হারাননি। এত লোককে এত সময় দেন কেন? উত্তরে বলতেন, ওই সাহচর্যের উত্তাপটুকু তাঁর দরকার। শহর হারাল সেই উষ্ণতা।
কিংবদন্তি
বাংলার গানের আকাশে যখন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সূর্যের মতো উজ্জ্বল, হিন্দি ছবির স্বর্ণযুগে তুঙ্গে বিরাজ করছেন মহম্মদ রফি-কিশোরকুমার, সেই সময়েও রাগাশ্রয়ী কঠিনতম গান গাইতে ডাক পড়ত সিমলা পাড়ার প্রবোধচন্দ্র দে-র। কৃষ্ণচন্দ্র দে-র প্রিয় ভাইপো মানা সুখ-দুঃখের আখর হৃদয়ে লিখে দিতেন সুরে সুরে। তিনিই যশস্বী মান্না দে (১৯১৯-২০১৩) নামে। বহু ভাষায় গান গেয়ে মুগ্ধ করেছেন, তাঁর কণ্ঠলাবণ্যে সপ্রাণ আধুনিক গান, ভক্তিগীতিও। ১ মে শিল্পীর ১০২তম জন্মদিন উদ্যাপন করবে আর পি গ্লোবাল মিউজ়িক অ্যাকাডেমি। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের শিল্পীদের নিয়ে অনুষ্ঠান আয়োজন করে কলকাতার এই সাঙ্গীতিক মঞ্চ, সংস্থার ফেসবুক পেজে শনিবার রাত সাড়ে ৮টায় ‘পদ্মভূষণ মান্না দে: শতবর্ষ পেরিয়ে’ লাইভ অনুষ্ঠানে তাঁকে নিয়ে বলবেন, গান শোনাবেন রজত বন্দ্যোপাধ্যায়। দীর্ঘ ত্রিশ বছর শিল্পীর সান্নিধ্যধন্য তিনি।
পথিকৃৎ
আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস আসছে। শিকাগোয় শ্রমিকদের ঐতিহাসিক মিছিলের বহু আগে, ১৮৭০ সালে ‘শ্রমজীবী সমিতি’ গড়ে তোলেন শশিপদ বন্দ্যোপাধ্যায়। ব্রিটিশ ভারতে শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি বুঝে নিতে তাঁদের শিক্ষিত করে তোলাই ছিল উদ্দেশ্য। ১৮৭৪-এ প্রকাশ করেন সচিত্র মাসিক পত্রিকা ভারত শ্রমজীবী, যার প্রথম সংখ্যায় মুদ্রিত হয় শিবনাথ শাস্ত্রীর শ্রমজীবী কবিতা। এ ভাবেই ভারতে প্রথম সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলনের সূচনা করেন শশিপদ। নারীশিক্ষা প্রসারেও ছিলেন অক্লান্ত, বরাহনগরে ১৮৬৫ সালে স্থাপন করেন মহিলা বিদ্যালয়। গ্রামের মানুষদের সঙ্গে থাকবেন বলে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদও হেলায় ত্যাগ করেন। বরাহনগরে তাঁর নামাঙ্কিত একাধিক প্রতিষ্ঠান ও রাস্তা আজও তাঁর স্মৃতিবহ। কেশবচন্দ্র সেনের অনুগামী শশিপদের স্থাপিত ‘দেবালয়’ ভারতে ব্রাহ্ম আন্দোলনের ইতিহাসে স্বতন্ত্র মাত্রা যোগ করেছিল।
ছবিতে, ছড়ায়
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী, পুরনো বন্ধুরা মিলে তৈরি করেছেন ‘অপ্রাসঙ্গিক’। অনেকেই ছড়িয়ে দেশে-বিদেশে, তবু পুরনো সেই দিনের কথা আর সুরে এখনও জড়িয়ে থাকা, জড়িয়ে নেওয়া পরবর্তী প্রজন্মকেও। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলা নববর্ষে একটি ক্যালেন্ডার তৈরি করে আসছেন ‘অপ্রাসঙ্গিক’-এর সদস্যরা। ১৪২৮ বঙ্গাব্দের টেবিল ক্যালেন্ডারটির পাতায় পাতায় ছোটদের আঁকা ছবি ও ছড়ায় তেপান্তরের মাঠ, পক্ষীরাজ ঘোড়া, নাগরদোলা, তালপাতার বাঁশি, মনপবনের নাও, রূপকথার ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী, দেওয়ালে আঁকা আলপনা (ছবিতে), ফেলে আসা ছেলেবেলা। বাঙালির উৎসব, মনীষীদের জন্মদিন, পূর্ণিমা-অমাবস্যা-একাদশী, সবই আছে। এক-একটি পাতায় মিষ্টি ছড়া: ‘নতুন বছর প্রণাম আদাব, শীতলপাটি আম কাঁঠাল/ ঢাল তলোয়ার পুতুল মুখোশ, নৌকো ফানুস রঙিন পাল।’
দুই জীবন
সুন্দরবন গবেষকদের আকর গ্রন্থ সতীশচন্দ্র মিত্র (১৮৭২-১৯৩১) রচিত যশোহর-খুলনার ইতিহাস। অন্য দিকে জঙ্গলসাহিত্যের অন্যতম রত্ন শিবশঙ্কর মিত্রের (১৯০৯-১৯৯২)লেখা সুন্দরবনের আর্জান সর্দার। বাদাবন সংক্রান্ত লেখালিখি, সাহিত্য ও তথ্যপঞ্জিতে এই পিতা-পুত্রের অতুলনীয় অবদান। দীর্ঘ দিন মাটি আঁকড়ে পড়ে থেকে তাঁরা যেমন জলে-জঙ্গলে লড়াই করা মানুষদের সুখদুঃখ অনুভব করেছেন, তেমনই তাঁদের পাশ ঘেঁষে গিয়েছে দক্ষিণ রায়ের থাবা। তাঁদের লেখনী ও জীবন একই সঙ্গে অনুভূতিরসে আর্দ্র ও রোমাঞ্চে ভরা। শুধু সুন্দরবন চর্চা পত্রিকার সাম্প্রতিক সংখ্যায় পিতা-পুত্রের জীবন ও কাজ নিয়ে বিস্তৃত আলোকপাত করা হয়েছে৷ এ বিষয়েই আগামী ১ মে, শনিবার সন্ধ্যা ৭টায় এক আন্তর্জাল-আলোচনাসভার আয়োজন করেছে পত্রিকা কর্তৃপক্ষ। থাকবেন প্রসাদরঞ্জন রায়, শিবশঙ্কর মিত্রের কন্যা ইন্দ্রাণী হক ও আত্মীয়া রীতা রায়, বাংলাদেশের খুলনা থেকে শঙ্করকুমার মল্লিক, সঙ্গে পত্রিকার সম্পাদক জ্যোতিরিন্দ্রনারায়ণ লাহিড়ী৷ অনুষ্ঠানটি দেখা যাবে শুধু সুন্দরবন চর্চা-র ফেসবুক পেজে।
দেশভাগ নিয়ে
পিতৃপুরুষের স্খলন-বিচ্যুতি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার বিস্তারে কি ফিরে পাওয়া যাবে অখণ্ড বঙ্গভূমির মানচিত্র? ফিরে কি পাব আমরা যুগ যুগ ধরে গড়ে ওঠা দুটি ভিন্ন সম্প্রদায়ের ভেঙে পড়া মানসিক বা সামাজিক সেতুপথ? সম্পাদকীয় কথামুখে এ প্রশ্ন দিয়েই শুরু হয়েছে তথ্যসূত্র পত্রিকার সাম্প্রতিক সংখ্যা দেশভাগ: স্মৃতি ও সত্তার বিষাদ (সম্পাদনা: সুব্রত রায়চৌধুরী)। ২৫ বছর হয়ে গেল এই পত্রিকার পথ চলা, ভারতের স্বাধীনতা ও দেশভাগের ৭৫ বছরের প্রাক্কালে বাঙালি মনন ও মানসের নিরন্তর সংগ্রামের আয়নায় ফিরে দেখতে চেয়েছে সাম্প্রতিক সংখ্যাটি। পত্রিকার শুরুতেই ১৯০৫ সালে অবিভক্ত বঙ্গভূমির এবং ১৯৪৭-এ স্বাধীনতাপূর্ব বাংলার মানচিত্র, পঁচিশেরও বেশি নিবন্ধে বঙ্গ-ইতিহাস, রাজনীতি, ধর্মনিরপেক্ষতা, উদ্বাস্তু-জীবন ও নারীমুক্তির আতসকাচে ফেলে দেখা হয়েছে দেশভাগকে। খোয়াবনামা, নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে, এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা, আগুনপাখি-র মতো বাংলা সাহিত্যে দেশভাগের প্রতিনিধিত্বমূলক কয়েকটি সৃষ্টি, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, সুলেখা সান্যাল, সবিতা রায়চৌধুরী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শঙ্খ ঘোষের লেখায় ভাঙা দেশের স্মৃতি ও সত্তার খোঁজ। দেশভাগ ও দাঙ্গা আশ্রিত বাংলা উপন্যাসের সংক্ষিপ্ত তালিকা, দেশভাগ বিষয়ক গবেষণাগ্রন্থের নির্বাচিত তালিকাটি গবেষকদের কাজে দেবে।
শৌভনিক ৬৫
১৯৫৭ সালের ১ মে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কলকাতার নাট্যদল ‘শৌভনিক’। এই শহরের গত ছয় দশকের নাট্য তথা শিল্প-ইতিহাসের শুধু সাক্ষীই নয়, সহযোগীও এই নাট্যদল। দীর্ঘ যাত্রাপথে ছোট-বড় মিলিয়ে ৮০টি নাট্য-প্রযোজনার কৃতিত্ব দলের ঝুলিতে, দর্শকধন্য ও মঞ্চসফল অনেকগুলি নাটকই। আরও বড় কথা, কেবল নাট্য-নির্মাণ ও প্রযোজনাতেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেনি এই নাট্যদল, তাদের প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত ‘মুক্ত অঙ্গন’ রঙ্গালয় হয়ে উঠেছে বাংলা থিয়েটারের অন্যতম পীঠভূমি, শহরের নাট্যচর্চার উজ্জ্বল অভিজ্ঞান। কলকাতা ও মফস্সলের বহু দল নিয়মিত ‘মুক্ত অঙ্গন’ ব্যবহার করে থাকে, ভাড়ার ন্যূনতম অর্থমূল্যকে বহুগুণে ছাপিয়ে যায় নাট্যানুশীলনের অক্সিজেন। ৬৫ বছরের জন্মদিনে, আগামী ১ মে শনিবার সন্ধে সাড়ে ৬টায় মুক্ত অঙ্গন-এই মঞ্চস্থ হবে শৌভনিক-এর ৮০তম প্রযোজনা, চলতি নাটক দর্পণম— কোভিড-বিধি মেনে। সেই সন্ধেতেই ইউটিউবে আনুষ্ঠানিক প্রকাশ ঘটবে দলের ৭৯তম প্রযোজনা, কাকতালীয় নাটকের ভিডিয়ো চিত্ররূপ, জানালেন সম্পাদক ও নির্দেশক চন্দন দাশ।
কল্পজাগতিক
২০০৫ সালে নিউ ইয়র্কের বিখ্যাত সংস্থার নিলামে রেকর্ড দামে বিক্রি হয়েছিল বার্ডস ইন আ কেজ-সহ তাঁর প্রথম দিকের চিত্রকৃতি। শিল্পবিশ্বে রাতারাতি ছড়িয়ে পড়ে তাঁর নাম, সেই সঙ্গে তাঁর ছবিতে পশ্চিমি আধুনিক শিল্পকৃতি আর ভারতীয় বা দেশীয় আঙ্গিকের অনন্য, নিবিড় সংসর্গও। অথচ শিল্পী কার্তিক চন্দ্র পাইনের (১৯৩১-২০১৭) শিল্পযাত্রার শুরু সেই পঞ্চাশের দশকে। বদলে যাওয়া পৃথিবীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তখন ক্রমে পাল্টাচ্ছে চিত্রশিল্পের তত্ত্ব ও ধারণাগুলিও, তাঁর ছবিতে ধরা আছে সময়োপযোগী সেই সব নিরীক্ষা। তাঁর ছবির আশ্চর্য কল্পজগতের স্বাতন্ত্র্যের গুণবিচারে তাঁর প্রজন্মের সাররিয়ালিস্ট চিত্রশিল্পীদের মধ্যে তিনিই অগ্রণী— অভিমত যোগেন চৌধুরীর। এর আগে শিল্পীর একক প্রদর্শনী হয়েছে কলকাতার অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস ও চিত্রকূট আর্ট গ্যালারিতে, এ বার কার্তিক চন্দ্র পাইনের ছয় দশকেরও বেশি দীর্ঘ শিল্পজীবন থেকে বেশ কিছু কাজ নিয়ে দি (ইন)ভিজ়িবল অ্যান্ড দি (আন)রিভিলড: ইনসাইড দ্য সিক্রেট ওয়ার্ল্ড অব কার্তিক চন্দ্র পাইন নামের চিত্র প্রদর্শনী চলছে ‘ইমামি আর্ট’-এ। শুরু হয়েছে ১৭ মার্চ, চলবে ১২ জুন অবধি। অতিমারির কথা মাথায় রেখে প্রদর্শনী দেখার সুযোগ থাকছে ইমামি আর্ট-এর ওয়েবসাইটেও। ছবিতে শিল্পীর চিত্রকৃতি বুল ফাইট (২০০৮)।
কর্মময়
ক্রিকেটার, পিচ কিউরেটর, আলোকচিত্রী, যন্ত্রশিল্পী, সমাজসেবী— একাধারে বহু পরিচয়। উত্তর কলকাতার ভূমিপুত্র গৌতম সুর স্কটিশ চার্চ স্কুলে পড়াকালীন প্রতিভাবান সুইং বোলার হিসেবে স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন, পান বৃত্তিও, কিন্তু মারাত্মক চোটে ছেদ পড়ে কেরিয়ারে। তবে ময়দান ছাড়েননি, ক্লাব ক্রিকেটে নির্বাচক হিসেবে কাজ করেছেন, সিএবি অনুমোদিত একটি ক্রিকেট ক্লাবের সেক্রেটারি ছিলেন আমৃত্যু। কিউরেটর হিসেবে বারাসতে একটি ক্রিকেট পিচ সাজিয়েছিলেন নতুন করে। ধরাবাঁধা কোনও কাজে অনীহা ছিল চির দিনই। নেশা ছিল ছবি তোলা, ইডেনে সচিন তেন্ডুলকরের ১৯৯তম টেস্টের শেষে বেলুন ওড়ানোর মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন, তাঁর ক্যামেরায় বিখ্যাত উস্তাদ আমজ়াদ আলি খানের ছবিও। রামমোহন রায় সংগ্রহশালায় প্রদর্শিত আছে তাঁর তোলা একটি প্রদীপের ছবি, যা ভারতপথিকের প্রতীক বলে বর্ণনা করেছিলেন তিনি। বেশি বয়সে বেহালা বাজানো শিখেছিলেন, মনের আনন্দেই। গত বছর ১৯ এপ্রিল প্রয়াত হন, এ বছর সেই দিনে স্বজন-বন্ধুদের স্মরণানুষ্ঠান ও সমাজসেবামূলক উদ্যোগে জেগে রইল তাঁর স্মৃতি।
অন্য দ্বারকানাথ
উনিশ শতকে বাঙালির চিন্তা-চেতনা বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল নারী জাগরণের। এ ক্ষেত্রে দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের (১৮৪৪-১৮৯৮) (উপরে ডান দিকের ছবিতে) ভূমিকার কথাও বাঙালির কম-বেশি জানা। শুধু স্ত্রীশিক্ষার প্রচার ও প্রসার বা নারীমুক্তি আন্দোলনেই নয়, সমাজ-সংস্কার, আসামে চা-কুলি আন্দোলনেও অগ্রণী ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। ১৭৭তম জন্মবর্ষে, গত ২০ এপ্রিল তাঁর জন্মদিনে তাঁর নামাঙ্কিত একটি ফেসবুক-গোষ্ঠী তাঁকে নিয়ে প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল। ২৪ এপ্রিল ‘ব্রাহ্ম সমাজ’ আয়োজিত এক আন্তর্জাল-অনুষ্ঠানে উঠে এল তাঁর মানবিক সত্তার কথা। টিভিতে একাধিক ধারাবাহিকের সৌজন্যে দ্বারকানাথকে নিয়ে সাধারণের কৌতূহলের শেষ নেই, তাঁর প্রপৌত্র রাজীব গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায় সে দিন উঠে এলেন ‘মানুষ দ্বারকানাথ’। টিভি ধারাবাহিকে দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের ভূমিকায় চরিত্রাভিনেতা হানি বাফনা জানালেন তাঁর একান্ত অনুভবের কথা। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ও সম্পাদিত অবলাবান্ধব পত্রিকার সৌজন্যে দ্বারকানাথ কলকাতার সমাজে পরিচিতও ছিলেন ‘অবলাবান্ধব’ আখ্যায়, সেই প্রসঙ্গে বললেন বরুণ চট্টোপাধ্যায়।
হালিম-বিলাস
রমজান মাসের কলকাতায় হালিমের বিচিত্র সম্ভার। চাঁদনি চক, কলুটোলা, ওয়েলিংটন, পার্ক সার্কাস বা খিদিরপুর, বিভিন্ন দোকানের হালিমের স্বাদ, বর্ণ, গন্ধও আলাদা। গম, চাল, নানা রকম ডাল, মাংস ও মশলা-সহ পঞ্চাশ-পঞ্চান্নটি উপকরণ দিয়ে তৈরি উপাদেয় এই খাদ্যটি সারা দিন রোজার পর ইফতারের খাবার হিসাবে শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টি জোগাতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। কলুটোলার বিখ্যাত হালিমে মশলা-ঝাল একটু কম, অন্য দিকে চাঁদনির নামকরা হোটেলের হালিমের প্রাণ ওই ঝাল-মশলাতেই। অনেক জায়গায় ডাল একেবারে গলিয়ে ‘গ্রেভি’ হয় একটু গাঢ়, ওয়েলিংটনের জনপ্রিয় হালিমে কিন্তু আস্ত ডালের দানা দাঁতে পড়তেই সুখ। তারতম্য আছে মাংসের ব্যবহারেও— বেশির ভাগ জায়গায় কিমা, কোথাও কোথাও আবার একটু বড় মাংসের টুকরো মেলে। ধনেপাতা ও টুকরো লেবু-সহ পাতে হাজির হলে মন খুশ। ফুটপাতে ঠেলাগাড়ি করেও হালিমের হাঁড়ি নিয়ে আসেন বহু বিক্রেতা, কলুটোলায় এই ঠেলাগাড়ির হালিম মেলে সারা বছরই। এই হালিম খাওয়ার মজা একটু অতিরিক্ত ‘রোগন’ বা স্নেহপদার্থ চেয়ে নেওয়া। অনেকটা ফাউ ফুচকার মতো!
হাত রাখা
শহরে, শহরের বাইরেও, অক্সিজেন সিলিন্ডারের খোঁজ জানাচ্ছেন কেউ। কোভিড থেকে সেরে-ওঠা মানুষের প্লাজ়মা চাই, আছে? আছে— হাত তুলছেন কেউ। ডাক্তার, ওষুধ, অ্যাম্বুল্যান্স, টেলি-মেডিসিন পরিষেবার পঞ্জি তৈরি করে জনে জনে পাঠাচ্ছেন কেউ। কেউ লিখছেন, বাড়িতে একা? অসুস্থ? আমরা আছি, পৌঁছে দেব খাবার, ওষুধ, স্বস্তি। রাতারাতি তৈরি হচ্ছে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ, ফেসবুক পেজ, ওয়েবসাইট— জীবনের জন্য। দুঃখ, মৃত্যু, বিরহদহনের মধ্যেও এ ভাবেই শান্তি, আনন্দ, অনন্তের জেগে থাকা। এ ভাবেই আরও বেঁধে বেঁধে থাকা। হাতের উপর হাত রাখা খুব সহজ নয়, তবু এক বার চেষ্টা করতে ক্ষতি কী!
ঘর, দেওয়াল, আলো, সবই ভাস্কর্য
এই বাড়িতে ঢুকেই ড্রাইভওয়ে, পাশে একটা ছোট্ট সাঁকো। ড্রাইভওয়ে দিয়ে হেঁটে গেলে নজরে আসবে কাঁঠাল গাছ। গাছের ডালে ঝুলন্ত এঁচড়, তার পাশে গাড়ির টায়ারের ফিতে। প্রকৃতি ও যান্ত্রিক অবশেষ দুই-ই স্বকীয়তা নিয়ে পাশাপাশি, নিজস্ব ভাষায়। বাঁ দিকে পরিচারকদের থাকার ঘর, সেখানে ছাদ থেকে ঝুলছে লোহার তারে তৈরি মৌচাক। পিছনের বাগানে এক প্রজাপতি। তার মাথাটা আসলে ফিল্মের ক্যামেরা, অবয়বে পর পর সাজানো অ্যাম্বাসাডর গাড়ির জানলা ও উইন্ডশিল্ড। বাড়ির দরজায় ঢুকতে গেলে চোখ আটকায় সামনে রাখা লেদ মেশিনে। মেশিন নয়, যন্ত্রনির্মিত দুই ঘোড়ার মুখ দু’দিকে। এক জন হয়তো মেশিনটাকে সামনে টানে, অন্য জন পিছন দিকে। অতঃপর জীবন সামনেও ছোটে না, পিছনেও না। এই অতিমারিতে ছোটার ভান করেও সে আসলে অপ্রতিরোধ্য বিপরীতমুখী টানে একই জায়গায় ‘ন যযৌ ন তস্থৌ’ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
বালিগঞ্জের ১২ কুইন্স পার্কে এ ভাবেই চলছে বিভিন্ন ইনস্টলেশন ও ছবি, শব্দপ্রক্ষেপ নিয়ে নারায়ণচন্দ্র সিংহের শিল্প প্রদর্শনী ফায়ারলাইট। চলবে মে মাস অবধি। মৃদু, নরম আলোর শিখা নয়, আগুনের তাতে জ্বলে ওঠা গনগনে আলোই স্বশিক্ষিত এই শিল্পীর উপজীব্য। আলোর এখানে বড় ভূমিকা। কখনও দোতলার একটা ঘরে দেখা যাবে এক গোছা লাল ফুল, সিঁড়িতে ওঠার মুখে ছবি। সেই সিঁড়ির নীচেই ডাঁই বিদ্যুতের পরিবাহী, চিনামাটির ইনসুলেটর (ছবিতে)। একটা বাথটব কাদায় ভর্তি, জানলার তেরছা আলোয় দেওয়ালে তৈরি হয়েছে অজস্র তির আর গরাদের শিক। বাথরুমে শুকনো নির্জলা কমোড, আবহে জলের তিরতির শব্দ। একটা বাড়ির সব ঘর, দেওয়ালকে এ ভাবে ভাস্কর্যের চরিত্র হতে অনেক দিন আগে দেখেছে কলকাতা, ‘সিমা’ আয়োজিত ‘কলকাতা আর্ট ফেস্টিভ্যাল’-এ রামদুলারি পার্ক নামের এক বাড়িতে।
অতিমারি পরিস্থিতিতে এই জাতীয় বড় বাড়ির আনাচ-কানাচে শিল্প প্রদর্শনী দেখা ভাল। সদরে দ্বাররক্ষীরা স্যানিটাইজ়ার দেন, দু’গজ দূরের সোশাল ডিসট্যান্সিং-ও বজায় রাখা যায়। গত বছর কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন নারায়ণবাবু নিজে, তাঁর শিশুকন্যা, বৃদ্ধ বাবাও। বলছিলেন, সেরে ওঠার পরও শরীরে-মনে ছিল সর্বগ্রাসী বিষণ্ণতা, অবসাদ। এক দিন ভাবলেন, আমি না শিল্পী! তখনই কবিতার জন্ম। ট্রাকের টায়ার, মোটর গাড়ির সাইলেন্সার পাইপ, লেদ মেশিন, ইনসুলেটরের যন্ত্রাংশ জুড়ে তৈরি হল শিল্পবস্তু। বাড়ির মালিক স্বাগত উপাধ্যায় বাড়িটা দিলেন নিখরচায়। ইনস্টলেশনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আলোও যাতে চরিত্র হয়ে ওঠে, সে বিষয়ে এগিয়ে এলেন টলিউডের খ্যাতনামা ক্যামেরাশিল্পী প্রেমেন্দুবিকাশ চাকী। তিনি বলছেন, “সিনেমার সঙ্গে তো এর সম্পর্ক নেই, বহু দিন বাদে নিজের আনন্দে কাজ করলাম।” শিল্পী, বিখ্যাত সিনেম্যাটোগ্রাফার ও এক প্রাসাদ-মালিকের নিঃশব্দ জোটে তৈরি করোনাকালের শিল্প প্রদর্শনী। এক টুকরো শিল্পিত কলকাতা।