Kolkatar Karcha

কলকাতার কড়চা: জীবন গড়ে দিলেন যাঁরা

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৫:১৭
Share:

শিল্প কাকে বলে? রাস্তায় চেয়ার-টেবিল নিয়ে বসে পড়াচ্ছেন মাস্টারমশাই, পাশে অবিরাম গাড়িঘোড়ার শব্দ, মানুষের হইচই, হরেক কিসিমের হট্টগোল। পড়ুয়ারা তবু মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুধুই শুনছে তাঁর কথা, ‘আর্ট অ্যাজ় আর্কাইভ’। পথচলতি লোকেরাও কখনও মুহূর্তের জন্য থমকে যাচ্ছেন সেই জাদু-বক্তৃতার টানে। তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক আব্দুল কাফি— ছাত্রদের প্রিয় ‘কাফিদা’। তাঁর মতোই, ‘মৃণাল মাস্টার’-এর শিকড়ও কলকাতায় নয়, দূরের এক জেলায়। ‘চালচিত্র অ্যাকাডেমি’-র সম্পাদক, শিল্পী মৃণাল মণ্ডলের হাত ধরে ঝাড়গ্রামের লালবাজার আজ ‘খোয়াবগাঁ’— স্বপ্ন সম্ভবের গ্রাম। ডালপালা বিক্রি, খেতমজুরি বা ভিন্‌জেলায় খেটে যাঁদের জীবন কাটত, তাঁরাই তুলির টান দিয়েছেন মাটির বাড়ি গায়ে, শিকড়বাকড় কেটেকুটে গড়ছেন কুটুম-কাটাম, বা মাটির পুতুলও। মকর আহির, পিন্টু মল্লিকদের কথা, লোধা সম্প্রদায়ের হতদরিদ্র গ্রামকে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের গন্তব্য করে তুলেছেন এই আশ্চর্য শিক্ষক। কচিকাঁচারা এমন ভাবেই ঘিরে থাকে বাঁকুড়ার কুশমুড়ি গ্রামের নির্মল ধাড়াকেও। স্যর এখন বিধায়ক, পুরো অঞ্চলেরই দায়িত্ব, নিয়মিত কলকাতা-যাত্রায় ব্যস্ত। পড়ুয়ারা তবু বড় নাছোড়— এই অজ পাড়াগাঁয়ে এত ভাল মাস্টার কাকেই বা আর পাবে তারা? তাদের বাবা-মা’ই বা এত কম বেতনের শিক্ষক জোগাড় করবেন কী করে? সে গ্রামে কলেজে পড়াও একটা বিরাট খবর। এমএ পাশ নির্মল সবার জন্য অবৈতনিক টিউটোরিয়াল সেন্টারের বন্দোবস্ত করছেন।

Advertisement

আরও হাজারও শিক্ষক যে লকডাউনে বিকল্প ক্লাসঘরের ব্যবস্থা করলেন, স্কুলছুট পড়ুয়াদের প্রকৃতি চেনালেন আর মানচিত্র দেখালেন, পড়ার আগ্রহটুকু বাঁচিয়ে রাখতে প্রাণপাত করে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, ছাত্রছাত্রীদেরই দুয়ারে পৌঁছে গেলেন নানা বৃত্তির তথ্য জোগাড় করতে, তাঁদের ক’জন পান প্রচারের আলো? মনে রাখতে পেরেছি কি সেই যুবকদের নাম, যাঁরা কেবল প্রতিবেশী পড়ুয়াদের পাশে দাঁড়াবেন বলে নিজেদের খরচে গ্রামে ওয়াইফাই বসিয়ে দিয়েছিলেন? আসলে, উদয়ন পণ্ডিতের পাঠশালা যে কোনও দিন বন্ধ হয় না। রাতারাতি রাজফরমান জারি হয়ে যায়, কিন্তু তাঁরা শিক্ষার সারটুকু ভুলতে দেন না। নিজেরাও ভোলেন না। লড়ে যান। দীর্ঘ অতিমারি-পর্বে লেখাপড়া যখন ঠিকমতো হয় না, অনলাইনে কিছু হলেও বাদ পড়ে যায় অনেকেই, তখনও তাঁরা জেগে থাকেন সব ছাপিয়ে। জীবনের শিক্ষা দেন, আপন শিক্ষায় ভর করে। তাঁদের সদাসতর্ক নজর থাকে, কারও শেখা কম হয়ে যাচ্ছে না তো? কেউ ছিটকে গেল না তো? তাঁরা মানুষ গড়ে চলেন নিজের মতো করে, দুনিয়াকে পাত্তাও না দিয়ে। সঙ্গী বলতে একটাই দৃঢ় প্রত্যয়— পাঠশালা এক দিন খুলবেই! তা না হলে যে কী বিপদ, তাঁরা জানেন। আগামী কাল শিক্ষক দিবস, ভরসা থাকুক এই স্যর-দিদিমণিদের ঘিরে। ছবিতে বছর বারো আগের শান্তিনিকেতন, শিক্ষক দিবসে বসেছে ক্লাস।

তদ্গত

Advertisement

‘ঝনন ঝনন বাজে’, ‘ভাঙনের তীরে’ বা ‘গয়া গঙ্গা প্রভাসাদি’, বহু স্মরণীয় গানের রূপকার তিনি। সমনৈপুণ্যে গেয়েছেন আধুনিক, চিত্রগীতি, ভক্তিগীতি, রবীন্দ্র-নজরুলের গান। মেলোডি-ভিত্তিক, রাগনির্ভর বা বিদেশি সুর-ছন্দের গান সবেতেই সমান সাবলীল, বোঝা যায় সুবল দাশগুপ্ত, সলিল চৌধুরী, সুধীন দাশগুপ্ত, নির্মল ভট্টাচার্য প্রমুখের সুরে আধুনিক গানে। ভক্তিগীতি মুখ্যত ছবিতে, রাইচাঁদ বড়াল, অনিল বাগচীর সুরে তিনি এক তদ্গত সাধক। রাজেন সরকার, পঙ্কজকুমার মল্লিক প্রমুখের সুরেও বহু গান। সলিল চৌধুরীর সুরে ‘ঝিরঝির বরষায়’ গাওয়ার সঙ্গে করেছেন অভিনয়ও। নতুন শিল্পীদের পাশে থাকতেন সতত। ১০ সেপ্টেম্বর, শুক্রবার ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের (১৯২২-১৯৯২) (ছবিতে) জন্মশতবর্ষ-সূচনা, ‘ধনঞ্জয় গীতিমন্দির’ ফেসবুক-পরিসরে তাঁকে স্মরণ করবে সন্ধে ৬টায়, ‘হারমোনিকা’ সংস্থার অনুষ্ঠানও ফেসবুকে দেখা যাবে সকাল থেকেই।

মহাজীবন

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের (১৮৭০-১৯২৫) জন্মসার্ধশতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে গত বছর, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মের ১২৫ বছরের সূচনা হয়েছে এই জানুয়ারিতে। ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছরে দুই দেশনায়কের জীবন ও কীর্তিকে ফিরে দেখতে চেয়েছে রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দির। গতকাল ও আজ, ৩ ও ৪ সেপ্টেম্বর দুই দিন ব্যাপী আন্তর্জাল-আলোচনাচক্রের উদ্বোধন করেছেন রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সাধারণ সম্পাদক স্বামী সুবীরানন্দ। গতকাল ছিল দেশবন্ধুকে নিয়ে সাতটি আলোচনা, আজ দ্বিতীয় দিনে নেতাজিকে নিয়েও তাই। বিশিষ্ট গবেষক-অধ্যাপক-শিক্ষা প্রশাসক ও প্রাবন্ধিকদের ভাবনায় দুই মহাজীবনের মূল্যায়ন। বিদ্যামন্দিরের ইউটিউব চ্যানেলে, সকাল ১০টা থেকে।

নাটকের বর্ষকথা

জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর অবধি বাংলার নাট্যজগতের নানা সংঘটনগুলি গুছিয়ে লেখা। আছে বহু নাট্যদল ও নাট্য প্রতিষ্ঠানের জেলাভিত্তিক তালিকা, নাম-ঠিকানা, ফোন নম্বর, ইমেলের মতো জরুরি তথ্য; বিকল্প নাট্যধারা-সহ মূকাভিনয়-শ্রুতিনাট্য-পুতুলনাটকের চর্চা করেন যাঁরা, তাঁদের স্বতন্ত্র তালিকাও। প্রয়াত হলেন যে নাট্যব্যক্তিত্বেরা, নাট্য-সম্মান ও পুরস্কার পেলেন যাঁরা, বাংলায়, বহির্বঙ্গে ও বহির্ভারতেও যেখানে যা নাট্যাভিনয়, নাট্য-উৎসব, কর্মশালা হল, এমনকি চাগিয়ে উঠল যে বিতর্ক, সব কিছুই আছে ইলোরা নাটকের বর্ষকথা ২০২০ পত্রিকায় (সম্পাদক: মলয় ঘোষ)। তেরো বছর ধরে যত্নে এ কাজ করে যাচ্ছে পত্রিকাটি, নাট্য-পরিসরে যার গুরুত্ব অতুলন।

সূচনা

রামমোহন রায়ের জন্মের সার্ধদ্বিশতবর্ষে শহর পেল নতুন এক বিদ্যাচর্চার প্রতিষ্ঠান— রামমোহন রায় ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল স্টাডিজ়। প্রথাগত রামমোহন-গবেষণা তো বটেই, উনিশ শতকের নবজাগরণ ও বঙ্গমনীষার জাতীয়তা-চর্চাও এর উদ্দেশ্য। রামমোহন-অনুরাগীদের উদ্যোগে এই প্রতিষ্ঠান শুরু হল গত ২৩ অগস্ট, ৬ ভাদ্র রামমোহনের ব্রহ্মসভা প্রতিষ্ঠাদিনের স্মরণে। বিধান সরণির যে বাড়িতে প্রতিষ্ঠানের সূচনা, সেটি প্রশান্তচন্দ্র মহলাবিশের ঠাকুরদা গুরুচরণ মহলানবিশের বাড়ি, এখান থেকেই আগে পরিচালিত হত ব্রাহ্ম এডুকেশন সোসাইটি। ৭ সেপ্টেম্বর সন্ধে ৬টায় প্রতিষ্ঠানের প্রথম অনুষ্ঠান শ্রীঅরবিন্দ ভবনের সঙ্গে যৌথ ভাবে, সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ গ্রন্থাগারে, ‘ঋষি রাজনারায়ণ থেকে শ্রীঅরবিন্দ: ভারতে জাতীয়তা চর্চার ধারা’ নিয়ে। দেখা যাবে ফেসবুক ও ইউটিউবেও।

অতি উত্তম

“জিঘাংসা দেখার পর আপনার সঙ্গে কাজ করার বাসনা প্রবলভাবে জেগেছিল,” উত্তমকুমার বলেছিলেন অজয় করকে, তাঁর লেখা থেকে উত্তমের পছন্দের অভিনয়জগতের একটা আন্দাজ পাওয়া যায়। মেট্রোয় রোনাল্ড কোলম্যান-এর র‌্যানডম হারভেস্ট দেখে হারানো সুর প্রযোজনার প্রেরণা পান উত্তম। আবার আন্দ্রে ওয়াজ়দার পোলিশ ছবিতে চিবুলিস্কির অভিনয়ের অনুরক্ত ছিলেন তিনি। বিচিত্রপত্র-র (সম্পাদক: সৌরদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, অয়ন চট্টোপাধ্যায়, সৌম্যকান্তি দত্ত) অতি উত্তম সংখ্যায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা তো বটেই, আছে উত্তমের মা চপলা দেবী ও পুত্র গৌতমের লেখাও। বিশেষ আকর্ষণ উত্তম-অভিনীত ছবির পোস্টার, পরিমল রায়ের সৌজন্যে। বড় আকর্ষণ সন্দীপ রায়ের সৌজন্যে নায়ক ও চিড়িয়াখানা-র সত্যজিতের খেরোর খাতা থেকে বাছাই পাতা, স্কেচ, পোস্টার; নায়ক নিয়ে সত্যজিতের অপ্রকাশিত ও অগ্রন্থিত রচনা, ধন্যি মেয়ে-র সম্পূর্ণ চিত্রনাট্য।

আত্মজীবন

ধান রুইছেন চাষিরা, দূরে তন্দ্রাচ্ছন্ন শহরের বহুতলরাজি (ছবিতে)। ছায়াবাস্তব নয়, কায়াবাস্তব। কিংবা সেই হর্ম্যসারির প্রেক্ষাপটেই মাটির ঢিপিতে আনন্দে খেলে চলা বালক, ভ্যানোয় বসে বা দাঁড়িয়ে যাত্রারত শ্রমিককুল, ব্যস্তসমস্ত রাজপথে শিশু-কোলে মা, পুরু চশমার ও পার হতে তাকিয়ে থাকা নাগরিক বৃদ্ধ। টুকরো এ সব ছবি জুড়েই মহানগরের জীবন-উদ্‌যাপনের মালা গেঁথেছেন এ শহরের আলোকচিত্রী রাজীব দে। এপ্রিলে কলকাতার কনসুলেট জেনারেল অব ইটালি-র উদ্যোগে হয়েছিল আলোকচিত্র প্রদর্শনী ফ্রম কলকাতা টু ইটালি: অব প্লেসেস ইন ডায়ালগ, তারই দ্বিতীয় পর্ব অব সোলস ইন সেলিব্রেশন এ বার ললিত গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের বেকারিতে। কলকাতার রাজীব, ইটালির আলেসান্দ্রো রোসানি, গিউসেপ্পে ইয়ালুনা ও রোসানা কোসলাভির তোলা যে মুখচ্ছবিগুলি দিয়ে প্রদর্শনী সাজিয়েছেন কিউরেটর ফ্রান্সেসকা রোসানি, তা উচ্চকিত নয়, চকিত জীবনমুহূর্তের; বাস, বাজার, নির্জনতা, খেলা, একাকিত্ব, দেবমূর্তি— সবই সেখানে সাধারণ্যের জীবনচিত্রের ক্যানভাস। আগের পর্বে প্রকাশিত হয়েছিল স্থানিক মাহাত্ম্য, এ বার সাদা-কালো ছবিতে আত্মজীবনের রং। প্রদর্শনী ৫-১২ সেপ্টেম্বর, সকাল ১১টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত।

বিজ্ঞানশিল্পী

চিনেমাটির কাপ, কাচ-স্টিলের গ্লাস একের উপর আর এক অদ্ভুত ভাবে কাত হয়ে দাঁড়িয়ে (উপরে ছবিতে)। চেয়ার, টেবিল, আলমারি, সোফা, গ্যাস সিলিন্ডার, টিভি— একটা ইটের টুকরো বা কাচের বোতলের উপর দাঁড়িয়ে এরাও! জাদু বা বিভ্রম নয়, বিজ্ঞান। ঘর্ষণ বলের সাহায্য নিয়ে অতি ক্ষুদ্র ভূমিতে ছোট থেকে বড়, একাধিক বস্তুকে এক সঙ্গে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার বিদ্যায় সিদ্ধহস্ত রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ কলেজের ইলেকট্রনিক্সের শিক্ষক, বিজ্ঞান-গবেষক প্রিয়দর্শী মজুমদার। নাগেরবাজারের বাড়িতেই চলে তাঁর এই ‘পয়েন্ট ব্যালান্সিং আর্ট’ বা ভারসাম্য শিল্পের চর্চা। শুধু ঘরেই নয়, রাস্তাতেও বোতলের উপর ব্যালান্স করেছেন কাঠের চেয়ার। এখনও পর্যন্ত তৈরি করেছেন প্রায় ১২৫টি ‘ভারসাম্য শিল্পবস্তু’, তাঁর কৃতিত্ব জায়গা করে নিয়েছে ‘ইন্ডিয়া বুক অব রেকর্ডস’-এও। নিরন্তর অভ্যাস তো বটেই, অখণ্ড ধৈর্য ও দৃঢ় মনস্তাত্ত্বিক শক্তি এই শিল্পের চাবিকাঠি— মত এই বিজ্ঞানশিল্পীর।

যা গেছে

শহরে নন-এসি মেট্রো মুড়োল। ফেসবুক কেঁদে আকুল: আহা, সেই সব ঘেমো দিনরাত্তির, মাঝে মাঝে ঘটাং ঘটাং দাঁড়িয়ে যাওয়া এমনকি পোড়া গন্ধও, সব শেষ? নস্ট্যালজিয়া খুব ছুটেছে। বিশ্বের আর ক’টা শহরে এই একুশ শতকেও নন-এসি মেট্রো চলে, সব ক’টা রেক এসি করতে তিন দশক লেগে যায় কী করে, থরথর অতীতবিলাসের বাজারে সে সব প্রশ্ন করলে লোকে বলবে বেরসিক। তা বলুক, তবু বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা পাঠশালায়, পুরনো রেক— ইতিহাসে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement