Satyajit Ray

কলকাতার কড়চা: ‘ক্লাসিক’ যে ভাবে হয়

তখনও ঘরে-বাইরে তৈরি হয়নি, আশির দশকের শুরু, তবে অচিরেই যে ছবিটি করবেন তত দিনে স্থির করে ফেলেছেন।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৬:২৫
Share:

আমি মাঝে মাঝে ক্লাসিকসে যেতে চাই... আমার বিশ্বাস আজকের অনেকেই যারা সিনেমাটা দেখবে, তারা ঘরে-বাইরে পড়েনি... নামটুকু শুধু শুনেছে। পড়ার অভ্যাস এমনিতেই কমে আসছে লোকের। ফিল্মের মাধ্যমে তাদের অন্তত জানিয়ে দেওয়া যাবে লেখাটা কী ছিল বা কী আছে... একটা ক্লাসিক রচনাকে দর্শকের সামনে ফিল্ম দিয়ে তুলে ধরাটা একটা বড় কর্তব্য,” এক সাক্ষাৎকারে নির্মল ধরকে বলেছিলেন সত্যজিৎ রায়।

Advertisement

তখনও ঘরে-বাইরে তৈরি হয়নি, আশির দশকের শুরু, তবে অচিরেই যে ছবিটি করবেন তত দিনে স্থির করে ফেলেছেন। অবশ্য রবীন্দ্রনাথের এই উপন্যাস থেকে যে ছবি করবেন তা ভেবে আসছিলেন পথের পাঁচালী করারও আগে থেকে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ঘরে-বাইরে’র সন্দীপ, চিত্রভাষ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, “আমি যত দিন এই ছবির জগতে এসেছি, প্রায় সেই অপুর সংসার-এর পর থেকেই ঘরে-বাইরে হবার কথা হয়েছে। মানিকদা অনেক বারই ভেবেছেন... প্রথম দিকে উনি নিখিলেশ হিসেবে আমাকে ভেবে রেখেছিলেন...পরে আমাকে সন্দীপ চরিত্রেই ভাবতে শুরু করলেন... কথার উপর দক্ষতা আছে এমন লোক ছাড়া সন্দীপ করানো যাবে না, এটা মানিকদা ক্রমশই বুঝতে পারছিলেন। কারণ বিমলা তো মুগ্ধ হচ্ছে... সন্দীপের বাকচাতুর্যেই।”

সত্যজিতের ঘরে-বাইরে’কে স্মৃতিধার্য করে তোলার উদ্যোগ করেছেন নির্মল ধরই, সজল দত্তের সঙ্গে যুগ্ম তত্ত্বাবধানে, প্রকাশ করছেন সত্যজিতের হাতে লেখা ঘরে-বাইরে’র চিত্রনাট্য, ১৯৮১তে লেখা। ফ্যাক্সিমিলি এডিশন, পুরোটাই রঙিনে ছাপা, পাতার মাপও এক, অর্থাৎ ফুলস্ক্যাপ সাইজ়ের। “আশা করি বাবার হাতের লেখা ও তাঁর করা কারেকশনগুলি কারুর পড়তে অসুবিধা হবে না,” জানিয়েছেন সন্দীপ রায়, “ফ্যাক্সিমিলি অংশের শেষে... থাকল বাবার খেরোর খাতা ও আবহসঙ্গীতের নোটবই থেকে বাছাই কিছু পাতা, ছবির পোস্টার, বুকলেট, সাক্ষাৎকার ও দেশে বিদেশে বেরনো সমালোচনা।” প্রকাশনায় ওয়েস্ট বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্টস অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লুবিএফজেএ), সঙ্গে প্রযোজক সংস্থা ‘সিনেমাওয়ালা’। ৩৭ বছর আগে, ১৯৮৫-র জানুয়ারিতে কলকাতায় মুক্তি পেয়েছিল ঘরে-বাইরে, আগামী কাল সন্ধ্যা ৭টায় প্রিয়া সিনেমাহলে এই প্রকাশনাটির উন্মোচন করবেন ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়, ঘরে-বাইরে’র নিখিলেশ। ডব্লুবিএফজেএ-র এই ‘সিনেমার সমাবর্তন’ অনুষ্ঠানে সন্দীপ রায়ের হাত দিয়ে সত্যজিৎ-নামাঙ্কিত ‘সারা জীবনের সম্মান’-এ ভূষিত হবেন ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায় ও সত্যজিতের প্রিয় আর এক অভিনেতা দীপঙ্কর দে। সমগ্র আয়োজনটি সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধার্ঘ্য। ছবিতে বিমলা চরিত্রে স্বাতীলেখা সেনগুপ্তের মেক-আপ স্কেচ ও ডান দিকে নিখিলেশের বাড়ির বৈঠকখানার স্কেচ, সত্যজিতের আঁকা— বই থেকে নেওয়া।

Advertisement

অম্লান

মৃত্যুর চার দশক পরেও অম্লান তাঁকে নিয়ে চর্চা। তাঁর বক্স অফিসের রেকর্ড অধরা। তাঁকে নিয়ে অনায়াসে কবিতার বইও লিখে ফেলেন কবি। উত্তমকুমারকে নিয়ে এ বার একটি গদ্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছে ‘আচমন’, পত্রিকা ও বইয়ের পাশাপাশি নতুন ‘ছোটো বই’ সিরিজ়ের প্রথম প্রকাশনা— উত্তম নিশ্চিন্তে চলে (সম্পাদনা: সোমনাথ শর্মা)। অনেকগুলি লেখায় ফুটে উঠেছে ১৯৪৮ থেকে ১৯৮০, তিন দশকেরও বেশি সময়ে মহানায়কের ‘হয়ে ওঠা’র অভিযাত্রা। গায়ক, নায়ক, সঙ্গীত পরিচালক-সহ নানা সত্তার মূল্যায়ন কুড়িটি সুচয়িত বিষয় আলোচনার মধ্য দিয়ে। বাংলা ও বাঙালি চলচ্চিত্র-সংস্কৃতির ‘আইকন’ হিসেবে উত্তমকুমারের স্থায়ী একটা চিত্রকল্পও তৈরি হয়ে যায় পাঠকমনে। মুদ্রিত হয়েছে উত্তমকুমারের বহু ছবি, সিনেমার পোস্টার। এলোমেলো চুলে সিগারেট-মুখে স্বপ্নপুরুষের প্রচ্ছদ- প্রতিকৃতিটি চন্দ্রিল গোস্বামীর আঁকা।

ছৌ-ছন্দে

প্রাচীন অষ্টভূম জনপদের জনজাতি সমাজভাবনাতেই জন্ম ছৌ নৃত্যশৈলীর। চৈত্র সংক্রান্তিকে ঘিরে জনজাতি সমাজ মেতে ওঠে নানা উৎসবে, ছৌ তেমনই এক উৎসব। আসলে এ এক রণনৃত্য, সামরিক যুদ্ধকৌশল ক্রমে রূপান্তরিত হয়েছে ছৌ নাচে। ময়ূরভঞ্জ, সেরাইকেলা ও পুরুলিয়া, প্রচলিত তিন ধারার ছৌ নৃত্যের মধ্যে একদা সিংভূম জেলায় অবস্থিত, এখন ঝাড়খণ্ডের অন্তর্গত সেরাইকেলার ছৌ অনন্য শিল্পবৈশিষ্ট্যে ভাস্বর। প্রায় তিনশো বছর ধরে ক্রমে পরিশীলিত রূপ নিয়েছে এই নাচ। সেরাইকেলা ছৌ নৃত্যের প্রচার-প্রসারেই এ বার কর্মশালা শহরে, নৃত্যশিল্পী শেলী পাল ও ‘ক্রিয়েটিভ ডান্স ওয়ার্কশপ কলকাতা’র উদ্যোগে। সহযোগিতায় ইজ়েডসিসি, কর্মশালাও সেখানেই, ১৪-২০ ফেব্রুয়ারি। কর্মশালা পরিচালনা করবেন সেরাইকেলা ছৌ নৃত্যের বিশিষ্ট শিল্পী, পদ্মশ্রী শশধর আচারিয়া।

মঞ্চে আবার

আবার উৎপল দত্তর ব্যারিকেড। আজ ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হল-এ, সন্ধ্যা ৬টায়। ১৯৭৩-এ প্রথম অভিনয়। তখন উত্তাল সময়, অস্থির রাজনীতি, শাসকের পীড়ন... প্রকাশ্য দিবালোকে হেমন্ত বসু নিহত হওয়ার ঘটনায় কোণঠাসা কমিউনিস্টরা। সেই সন্ধিক্ষণে ব্যারিকেড হয়ে উঠেছিল এক আন্দোলনের নাম। আজও দেশ জুড়ে এই অস্থির সময়ে চাকদহ নাট্যজন মঞ্চে ফিরিয়ে আনছে সেই ব্যারিকেড-কেই। নির্দেশনা দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের, তাঁর মতে এ নাটক আজও জনমানসে একই রকম অনুরণন সৃষ্টি করতে সক্ষম, তাই আজকের প্রতিবাদের কণ্ঠ হিসাবে এই নাটককেই বেছে নেওয়া: “আজ শুধু কমিউনিস্টরা নয়, দেশের সমস্ত মুক্তচিন্তার মানুষ ও জনসাধারণ কোণঠাসা, বিপর্যস্ত! এই জনজীবনেরই ভাষা হয়ে উঠতে পারে ব্যারিকেড।”

শৈল্পিক

ছোটবেলায় সিউড়ির বাড়ির কাছে মালাকারপাড়ায় কারিগরদের শৈল্পিকতা নজর কেড়েছিল। স্কুলে নতুন আসা আর্টের শিক্ষকের সঙ্গে রবিবারে ছবি আঁকতে বেরোতেন। বাবার ইচ্ছে কমার্স নিয়ে পড়ুক ছেলে, তা না করে কলকাতায় আর্ট কলেজে ভর্তি হন লালুপ্রসাদ সাউ। ষাটের দশকের শহরজীবনে দারিদ্র আর অস্বাচ্ছন্দ্য থাকলেও মালিন্য স্পর্শ করেনি কখনও, মাস্টারমশাইদের ক্লাস আর ক্লাসের বাইরে শিয়ালদহ স্টেশন, গঙ্গার ঘাটও দিয়েছে শিল্পশিক্ষা। কলাভবনে শিক্ষকতা, ছাপচিত্র গুয়াশ টেম্পেরার কাজ আর ভাস্কর্য, এই সবই এক শিল্পজীবনের অভিজ্ঞান। বিড়লা অ্যাকাডেমিতে ১১-২০ ফেব্রুয়ারি লালুপ্রসাদ সাউয়ের ছবি ও ভাস্কর্যের একক প্রদর্শনী করছে আর্ট অলিন্দ, সোমবার বাদে, রোজ ৩টে থেকে ৮টা।

ধ্রুপদী

শহর ফিরছে সুরছন্দে, ১১-১৩ ফেব্রুয়ারি সঙ্গীতের আসরে। আয়োজনে ‘সঙ্গীত পিয়াসী’। বিশিষ্ট তবলাশিল্পী পণ্ডিত সমর সাহার তত্ত্বাবধানে সংস্থাটি ১৯৯১ সাল থেকে মার্গসঙ্গীতের প্রসারে কাজ করছে। বছরে দু’বার সাঙ্গীতিক বাসরের আয়োজন করে তারা। এ বারের অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য অতিমারিকালে প্রয়াত শিল্পীদের স্মরণ এবং তাঁদের সুযোগ্য সন্তানদের প্রতিভার সঙ্গে সকলের পরিচয় করিয়ে দেওয়া। ১১ ফেব্রুয়ারি পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদারের সরোদবাদ্য, ১২ ফেব্রুয়ারি অন্যতম আকর্ষণ পণ্ডিত অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের তবলাবাদন। পালিত হবে পণ্ডিত অমিয়রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৯৬তম জন্মদিন, ১৩ ফেব্রুয়ারি তাঁরই কণ্ঠে রাগসঙ্গীত। সেতার, তবলা, হারমোনিয়াম, বাঁশিতে নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা। অনুষ্ঠান দাগা নিকুঞ্জে, রোজ সন্ধ্যা সাড়ে ৫টা থেকে। শোনা যাবে ফেসবুক, ইউটিউবেও।

শীতের অতিথি

শরীরচর্চাকে জাতীয় সংস্কৃতির অঙ্গ করে তুলতে বাঙালিকে সার্কাসের প্রতি আকৃষ্ট করেন নবগোপাল মিত্র। সেই ধারাতেই তৈরি প্রিয়নাথ বসুর আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ‘প্রফেসর বোসে’স সার্কাস’ কোম্পানি। ক্রমে গড়ে ওঠে এস কে গুহর রিংলিং সার্কাস, বি এন বসুর লায়ন সার্কাস, গোপাল তরফদারের নটরাজ সার্কাস, সুবোধ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইন্টারন্যাশনাল সার্কাস ও তাঁর উত্তরসূরিদের তৈরি অলিম্পিক ও ফেমাস সার্কাস। বিশ্বযুদ্ধের বছরগুলি বাদে বিশ শতকে সার্কাসের খুব কদর ছিল। কলকাতায় শীতে আসত নানা কোম্পানি। দুঃসময় শুরু শতকের শেষ থেকেই, ১৯৯৮ থেকে নিষিদ্ধ বন্য প্রাণীর খেলা দেখানো। তবু এ বারের শীতে সিঁথির মোড়ে তাঁবু ফেলেছে আবদুল আজিজের অজন্তা সার্কাস। বিকেল ৪টে ও সন্ধ্যা ৭টার শোয়ে জাগলিং, আক্রোব্যাটিক্স, ম্যাজিক, মোটরবাইক, দারুণ ব্যালান্সের খেলা (ছবিতে), জোকারের মজা, ট্রাপিজ় দেখতে জমায়েতও মন্দ নয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি এ বারের মতো তাঁবু গোটানো। ছবি: তথাগত সিকদার

ইতিহাস উৎসব

সিন্ধু সভ্যতা আবিষ্কারের একশো বছর, দুষ্প্রাপ্য, ঐতিহাসিক প্রত্নবস্তুর প্রদর্শনে তারই উদ্‌যাপন। আবার তার পাশাপাশিই এশিয়া ইউরোপ আফ্রিকা ও দুই আমেরিকা— পাঁচটি মহাদেশের পুতুলের নির্বাচিত সম্ভার। আগামী কাল, ১৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব বেতার দিবস— ভারতে প্রথম রেডিয়োর আগমন কী করে পাল্টে দিয়েছিল জনজীবন, সেই সব আশ্চর্য তথ্য ও ঘটনার পরিবেশন। গায়ক সুরকার সঙ্গীত পরিচালক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ‘বম্বে’-বিজয়, খ্যাতনামা ব্যক্তির রেট্রোস্পেক্টিভে রবি ঘোষকে নিয়ে প্রদর্শনী (সঙ্গের ছবিতে অভিনেতার পাওয়া পুরস্কার)। এই সব চমৎকার সংগ্রহ নিয়েই ‘সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবার পরিষদ’ আয়োজিত ষোড়শ আন্তর্জাতিক ইতিহাস উৎসব শুরু আগামী কাল, বড়িশার সাবর্ণ সংগ্রহশালায়। ‘থিম কান্ট্রি’ শ্রীলঙ্কা ও ফ্রান্স, থাকবে দুই দেশের হস্তশিল্প, মুদ্রা, ডাকটিকিট, বই-সম্ভার, ইতিহাসচিত্র। কুইজ়, হেরিটেজ ওয়াক, আলোচনা, কী নেই! প্রকাশিত হবে পরিবারের ঐতিহ্যবাহী হাতে লেখা পত্রিকা সপ্তর্ষি। ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা।

বিরহী

আনন্দমঠ ছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে ‘বন্দে মাতরম্‌’ নিখুঁত রেকর্ড করলেন একুশ বারের চেষ্টায়। আবার মান্না দে-র অনুরোধে জ্বর গায়ে এসে সুধীন দাশগুপ্তর ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’ প্রথম টেকেই ওকে! এইচএমভি শারদ অর্ঘ্য-য় কিশোর গাইলেন তাঁর সুরে, ‘আমি নেই’, ‘তারে আমি চোখে দেখিনি’; তিনিও কিশোরের সুরে— ‘কী লিখি তোমায়’, ‘ভালবাসার আগুন জ্বেলে’। উত্তমকুমার-হেমন্তর মহালয়া-সকালের বেতার অনুষ্ঠানেও ‘তুমি বিশ্বমাতা’ গানে তিনি। এই শহরের সুরের ইতিহাস আর স্মৃতির কথকতা লতা মঙ্গেশকর বিহনে বিষণ্ণ, বিরহী।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement