জাতীয় নাট্যমেলা-ই শুরু করেছিলাম আমরা। থিয়েটার যে একমাত্র বাঙালিরাই করে না, সারা দেশের মানুষ, প্রত্যন্ত প্রদেশের মানুষজনও করে, কলকাতার মানুষের মনে সে-আবহ তৈরির জন্যেই এ-উৎসবের শুরু। এ এমন এক প্ল্যাটফর্ম যেখানে নানান প্রদেশ থেকে জড়ো-হওয়া নাট্যকর্মীরা পরস্পরের কাজ দেখতে পারবেন। আর দর্শক দেখতে পাবেন সারা ভারতের থিয়েটার।’’— বলছিলেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, নান্দীকার-এর কর্ণধার। এ বার তাঁদের ৩৬তম ‘ন্যাশনাল থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল’ (আরম্ভ হয়েছিল ১৯৮৪-তে), অ্যাকাডেমিতে ১৬-২৫ ডিসেম্বর। ঝাড়খণ্ড, পটনা, দিল্লি... নানা জায়গা থেকে আসছে নাট্যদল। ‘‘যখন শুরু করেছিলাম, তখন আমাদের মধ্যেই কেউ কেউ বলেছিলেন যে বাঙালির থিয়েটারকে নাকি ছোট করা হচ্ছে’’, বলতে-বলতে হেসে ফেলেন রুদ্রপ্রসাদ, ‘‘উল্টো দিকটাও ছিল, শম্ভুদা (মিত্র) আশীর্বাদ করেছিলেন।’’ এ-মুহূর্তে সারা দেশের যা পরিস্থিতি তাতে বোধ হয় আরও বেশি ভাবেই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে এই জাতীয় নাট্যমেলা।
এই নাট্যোৎসবের প্রথম বছর থেকেই সারা দেশের এবং অবশ্যই এ-রাজ্যের থিয়েটারের বিশিষ্ট শিল্পী ও কর্মীদের সংবর্ধনা দেওয়ার প্রথা চালু হয়। বিজয় তেন্ডুলকর, তৃপ্তি মিত্র থেকে হাবিব তানভির, বিভি করন্থ হয়ে সাবিত্রী হেইস্নাম, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়... বেশ দীর্ঘই এই সংবর্ধিত শিল্পীর তালিকা। কিন্তু নান্দীকার-এর কাউকে সংবর্ধিত করা হবে না, বরাবর সেটাই ঠিক ছিল। এ বারে তার ব্যত্যয় ঘটিয়ে স্বয়ং রুদ্রপ্রসাদকেই সংবর্ধিত করা হচ্ছে, কারণ তিনি শুধু নান্দীকার কিংবা বাংলা থিয়েটারেরই নন, সারা দেশের থিয়েটার চর্চায়ও অন্যতম কান্ডারি, নিজেকে নাটকের কাছে নিঃশর্তে সমর্পণ করেছেন, তাও প্রায় ষাট বছর হতে চলল। দলের সম্পাদিকা সোহিনী সেনগুপ্ত জানালেন ‘‘নান্দীকার সমগ্র বাঙালির হয়ে সম্মাননা জ্ঞাপন করবে এই মহীরুহকে। তাঁর থেকে আমরা প্রতিনিয়ত প্রাণিত হই, নিয়মিত শিল্পচর্চার রসদ পাই। অনিন্দিতা, অয়ন, অর্ঘ্য, সপ্তর্ষি-র মতো যে ছেলেমেয়েরা এখন মূল শক্তি দলের, তারাই ওঁকে এই প্রতীকী সম্মাননায় ভূষিত করতে অত্যন্ত আগ্রহী। এই গুরুদক্ষিণা দিয়েই সূচনা হবে ৩৬তম নাট্যমেলার।’’ একটি প্রদর্শনীও থাকছে রুদ্রপ্রসাদ অভিনীত ও নির্দেশিত নাটকের স্থিরচিত্রাবলির (সঙ্গে তারই একটি, ‘নাট্যকারের সন্ধানে ছ’টি চরিত্র’ থেকে)। অশীতিপর তরুণ রুদ্রপ্রসাদ এখন রীতিমতো আনন্দ পান নতুন কোনও কিছু শুরু হতে দেখলেই, ‘‘তবে সবচেয়ে আনন্দ পাই বাচ্চাদের সঙ্গে কাজ করে, যখন দেখি তারা আনন্দ পাচ্ছে নাটক করে। চেষ্টা করি তালিম দিয়ে ওদের শক্তিশালী করে তুলতে, যাতে ওরা পায়ের তলায় জমি খুঁজে পায়।’’
শতবর্ষে
‘ক্ষুদিরামের মা আমার কানাইলালের মা—/ জননী যন্ত্রণা আমার জননী যন্ত্রণা’— একটা সময়ে পাঠকের মুখে মুখে ঘুরত ‘জননী যন্ত্রণা’ কবিতার এই পঙ্ক্তিদ্বয়। স্রষ্টা কবি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় (১৭ জুন ১৯২০-২০ এপ্রিল ২০০৩)-এর স্কুলজীবনে কবিতাচর্চায় হাতেখড়ি হলেও ১৯৪৪-এ ‘পরিচয়’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘মেঘবৃষ্টিঝড়’ কবিতাটি তাঁকে কবিখ্যাতি এনে দেয়। এ ছাড়াও লিখেছেন ‘কবিতা’, ‘সীমান্ত’, ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য়। দীর্ঘদিন সম্পাদনা করেছেন ‘পরিচয়’ পত্রিকা। প্রগতি প্রকাশনে অনুবাদকের কাজে যুক্ত হয়ে সত্তর দশকে মস্কো প্রবাসী। স্নায়ু, মনপবন, কটি কবিতা ও একলব্য, বৈরী মন তাঁর উল্লেখযোগ্য কবিতার বই। অনুবাদ করেছেন পাবলো নেরুদার কবিতা, রাশিয়ার গল্পসংগ্রহ, জীবনজয়ের পথে ইত্যাদি। গদ্যগ্রন্থের শিরোনাম কঠিন সবিতাব্রত। ডাক্তারি পড়ছিলেন, তিন বছরের মাথায় ছেড়ে দিলেন। অভিভাবকদের ইচ্ছে ছিল ইঞ্জিনিয়ার হবেন, কিন্তু তিনি আঁকড়ে ধরলেন বামপন্থার স্বপ্নলালিত কবিতাময় নবজীবন। চল্লিশের দশকের এই কবির জন্মশতবর্ষের অর্ধেক পথ পেরিয়ে গেল, তবু চোখে পড়ল না কোনও স্মরণ আয়োজন! ছবি সৌজন্যে: অশোকনগর মানবজমিন।
বুদ্ধচেতনার গল্প
বুদ্ধ বা তাঁর অনুষঙ্গে সাহিত্যকৃতির কথা ভাবলেই মনে পড়ে চর্যাপদ আর জাতকের কাহিনি। বাংলা কথাসাহিত্যেও বুদ্ধের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উপস্থিতি বড় কম নয়। কিন্তু অভাব ছিল এমন একটি বইয়ের, দু’মলাটের মধ্যে যা বুনবে বাংলা ভাষার লেখকদের বুদ্ধভাবনা। কলকাতার ১ বুদ্ধিস্ট টেম্পল স্ট্রিটের বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর সভা সেই শূন্যস্থানটুকুই ভরিয়ে দিল, ‘বুদ্ধচেতনার গল্পগুচ্ছ’ (সম্পা: হেমেন্দুবিকাশ চৌধুরী) প্রকাশ করে। সূচিপত্র দেখে বিস্ময় জাগে— বৌদ্ধবিদ্যাচর্চার অগ্রণী গবেষক শরৎচন্দ্র দাস, ‘সাহিত্য’ পত্রিকা-খ্যাত সুরেশচন্দ্র সমাজপতি থেকে বিভূতিভূষণ-তারাশঙ্কর-শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রভাবতী দেবী সরস্বতী, প্রমথনাথ বিশী, সুকুমার সেন, নারায়ণ সান্যাল, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, মণীশ ঘটক, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আল মাহমুদ, রমাপদ চৌধুরী, বাণী বসু, সেলিনা হোসেন, কে নেই লেখক-তালিকায়? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের শিক্ষক সুমিত বড়ুয়ার দীর্ঘ অবতরণিকায় সমৃদ্ধ বইটি সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে প্রকাশিত হল, উদ্বোধন করলেন সেলিনা হোসেন।
মানবতাবাদী
যাঁর প্রথম কবিতার বই পড়ে প্রশংসা করে চিঠি লেখেন (১৯৬০) সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, প্রথম প্রবন্ধগ্রন্থ ‘দান্তে গ্যেটে রবীন্দ্রনাথ’ পড়ে দীর্ঘ আলোচনা লেখেন (১৯৬৬) স্বয়ং অন্নদাশঙ্কর, সেই মানবতাবাদী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রসারে আজীবন নিবেদিতপ্রাণ সুরজিৎ দাশগুপ্ত (জন্ম ১৯৩৪) সম্প্রতি প্রয়াত হলেন মুম্বইয়ে। জীবনানন্দ দাশের সান্নিধ্যধন্য কর্মমুখর এই মানুষটি সারা জীবন কোনও বাঁধাধরা চাকরি করেননি। দীর্ঘকাল (১৯৭১-৮৮) চলচ্চিত্রশিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর ‘দি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইমেজেস অব ওড়িশা’ ছবিটি জাতীয় পুরস্কার লাভ করে। ‘দ্য সাইলেন্ট আর্ট’ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রোৎসবে প্রদর্শিত হয়। ‘জলার্ক’ পত্রিকা ও নানা গ্রন্থ সম্পাদনা, কবিতা গল্প উপন্যাস স্মৃতিকথা প্রবন্ধগ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর ‘ভারতবর্ষ ও ইসলাম’, ‘মৌলবাদ: এক নতুন সংজ্ঞা’, ‘প্রসঙ্গ সাম্প্রদায়িকতা’ বইগুলি উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া তিনি অন্নদাশঙ্কর রায়কে নিয়ে চারটি বই লেখেন। মৌলিক কাজ করেছেন প্রেমেন্দ্র মিত্রকে নিয়েও। তিনি লিখে রেখে গিয়েছেন তাঁর মায়ের লড়াকু জীবনের ইতিকথা ‘অশ্রুবালা’।
মায়ার খেলা
রবীন্দ্রনাথ ‘নলিনী’ আলেখ্যটিকে ‘মায়ার খেলা’ গীতিনাট্যে রূপদান করেন সরলা রায়ের অনুরোধে। বেথুন কলেজে এটি মঞ্চস্থ হয়। তরুণ কবি এটিকে অপেরার ভাবধারায় রচনা করেন, যা স্বভাবতই তার অভিনবত্বের জন্য সমাদৃত হয়। মঞ্চাভিনয়ের ক্ষেত্রেও কবি অনেক বৈচিত্র এনেছিলেন। এ দিকে ‘মোহর’ গোষ্ঠীর গঠনের মূলেই রয়েছে রাবীন্দ্রিক চিন্তাভাবনা। কবি নিজে বাঁধাধরা গণ্ডির বিরোধী ছিলেন, তাই ‘মোহর’ও তাঁর দেখানো নতুন পথের সন্ধানী। ‘মায়ার খেলা’ও বেরিয়ে এসেছে তার চেনা ঘেরাটোপের বাইরে। মুখ্য চরিত্রের প্রত্যেকে ছাড়াও বৃন্দশিল্পীদের মধ্যেও অনেকেই জন্মসূত্রে বাংলা ভাষাভাষী নন, তবু রবীন্দ্রভাবনায় আত্মস্থ হয়েছেন শুধু তাঁর রচনার গুণে। কবির মূল রচনা একটুও সংক্ষিপ্ত না করে ‘সম্পূর্ণ মায়ার খেলা’ উপস্থাপন করছে ‘মোহর’, ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর জিডি বিড়লা সভাঘরে।
গোড়ার কথা
ভারতীয় রাগসঙ্গীতের সঙ্গে সঙ্গীতরসিকরা সকলেই অল্পবিস্তর পরিচিত। কিন্তু তার অনেক খুঁটিনাটিই সাধারণের কাছে দুরধিগম্য ঠেকে। রাগসঙ্গীতের গোড়ার কথাগুলি বুঝিয়ে দেওয়ার জন্যই এ বারের তরুণ মিত্র স্মারক বক্তৃতায় থাকছেন সেনিয়া শাহজাহানপুর ঘরানার বিশিষ্ট সেতারশিল্পী পণ্ডিত সুগত নাগ। আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ান স্টাডিজ় এবং সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস, কলকাতার যৌথ আয়োজনে তিনি বলবেন ‘ইন্ট্রোডাকশন টু দি ইন্ডিয়ান ক্লাসিক্যাল মিউজ়িক— ডেভেলপমেন্ট অব দ্য রাগাজ়’ শীর্ষকে। ১৩ ডিসেম্বর ৫টায়, লেক টেরাসের যদুনাথ ভবনে। আলোচনায় আসবে রাগসঙ্গীত বিষয়ে সাধারণ পরিচিতির সঙ্গে রাগের সংজ্ঞা ও বিস্তারের পদ্ধতি, সেতার ও তবলার কথা, মঞ্চানুষ্ঠানের গঠন ইত্যাদি।
স্বপ্নের ফেরিওয়ালা
এক স্বপ্নের ফেরিওয়ালা এসেছিলেন ইরান থেকে। ভারতীয় ফুটবলে প্রথম বিশ্বকাপার। চোখ গিয়েছিল ঝলসে। মজিদ মানে ম্যাজিক, মজিদ মানে মায়াজাল। বছর ৪০ পরেও, কোনও বিদেশি এলে উৎসুকের প্রশ্ন, ‘ভাল, কিন্তু কতটা? মজিদের মতো?’ অথচ, খেলেছিলেন সে-অর্থে একটাই মরসুম। কেল্লা ফতে তাতেই। শুরুতে ইস্টবেঙ্গলের ‘আশির বাদশা’, নব্বইয়ে রাস্তার ফকির। খোমেইনির দেশ থেকে দশ বছরের অঘোষিত নির্বাসন, ভালবাসায় প্রত্যাখ্যাত হয়ে খেলা ছেড়ে কলকাতার দুয়ারে-দুয়ারে পদপিষ্ট, যেন নিজেই ফুটবল। তবু, ২৯ বছর পর তিনি এলে আবেগের সুনামি হুগলি-তীরবর্তী শহরে। মজিদ-ম্যাজিকে মজে ম ম ভারতীয় ফুটবলের মক্কা। কাশীনাথ ভট্টাচার্যের মজিদ (৯ঋকাল) ধরে রাখল সব প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, সযত্ন। পাতায়-পাতায় মতি নন্দী, অজয় বসু, অশোক দাশগুপ্ত। ৯ ডিসেম্বর বিকেল ৪টেয় প্রকাশিত হবে স্পোর্টস জার্নালিস্ট ক্লাবে তাঁর সতীর্থদের হাতে। উপস্থিত থাকছেন সুভাষ ভৌমিক, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, গৌতম সরকার ও জামশিদ নাসিরি। প্রতিকৃতি: দীপ্তীশ ঘোষদস্তিদার
শালওয়ালা
নভেম্বর থেকে মার্চ। টালা থেকে টালিগঞ্জ। শীত জুড়ে ঘুরে বেড়াতেন তাঁরা। ছ’ফুটের কাছাকাছি উচ্চতা। গাত্রবর্ণ দুধে-ঘিয়ে বা দুধে-আলতায়। কেশ ও শ্মশ্রুরাজি কালচে বাদামি বা ঈষৎ পিঙ্গল। কারও পরনে পাঠান স্যুট, কারও শার্ট-প্যান্ট। পিঠে কাপড়ে মোড়া আয়তাকার ডিব্বা। নাম রশিদ বা আলতাফ বা ইউসুফ। কিন্তু আশ্চর্য ভাবে আলিভাই বা খানভাই নামেই বেশি পরিচিত। হাসি মাখা মুখ, বিনয়ী ভঙ্গি। এঁরাই শীতে কাশ্মীর থেকে আসা ‘শালওয়ালা’। হায়! এ বার এখনও কলকাতায় তাঁদের শাল, ফিরহান, পশমিনা নিয়ে ঘুরতে দেখা গেল না! সংশয়বাদী বলছেন, ‘‘কাশ্মীরের নয়, বড়বাজারেরই জিনিস। ফড়ে ব্যবসায়ীরা ওঁদের কাশ্মীর থেকে ভাড়া করে আনে।’’ তবু, কোনও কোনও পরিবারের সঙ্গে শালওয়ালাদের আত্মিক সম্পর্ক জুড়েছিল। কিস্তিতে পোশাক কেনার খাতা চলত বছরের পর বছর। এঁদের পরিচিতির সূত্রে ব্যবসা বাড়ত। শালওয়ালারা ধর্মতলা-খিদিরপুর এলাকায় মেসের মতো থাকতেন। বিশেষ ক্রেতাদের জন্য ভালবেসে নিয়ে আসতেন আখরোট-পেস্তা। অথচ, এই ২০১৯-এ শহরের বুক থেকে তাঁরা ‘শিশিরের শব্দের মতন’ মিলিয়ে গেলেন। কল্লোলিনী এতটাই নির্মম!
মেয়েদের ভাষা
চলতি শতকের নারীরা যতখানি সহজ ও সাবলীল ভাবে কবিতায় নিজেদের ব্যক্ত করতে পারছেন, পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর বছর আগেও কি ছবিটি তেমনই ছিল? প্রতিটি দশকেই স্মরণীয় মহিলা কবির সংখ্যা, পুরুষ কবির সংখ্যার তুলনায় উল্লেখযোগ্য ভাবে কম। কেন এই বৈষম্য? কবিতার কোনও জেন্ডার হয় না, কিন্তু কবির তো হয়। আর, তার প্রতিফলন ফুটে ওঠে কবিতার অক্ষরে। ফেলে আসা শতাব্দীর মহিলা কবিদের লেখাকে, লেখার মধ্যে দিয়ে তাঁদের যাপনচিত্রকে তুলে ধরতে পরম্পরার উদ্যোগে আয়োজিত হয়েছে ‘মেয়েদের কবিতার ভাষা’ বিষয়ক অনুষ্ঠান। মেয়েদের কবিতার স্বতন্ত্র স্বর বিষয়ে বলবেন যশোধরা রায়চৌধুরী। তরুণ কবি অবন্তিকা পাল বিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট কিছু নারীর লেখা পাঠ করবেন, সঙ্গে থাকবে তাঁর নিজের লেখারাও। প্রধান অতিথি জয় গোস্বামী উদ্বোধন করবেন অবন্তিকার কাব্যগ্রন্থ ‘একটি দুটি আদরকাড়া চোখ’ (পরম্পরা)। সঞ্চালনায় বাচিক শিল্পী ও কবি অমিত চক্রবর্তী। ১৪ ডিসেম্বর দুপুর তিনটেয়, জীবনানন্দ সভাঘরে।
নতুন নাটক
শিল্পের ক্যানভাস কেমন দ্বন্দ্ব ঘনিয়ে আনে, তা নিয়েই চিত্রকলা ভাষ্য আবহ ও চলচ্চিত্রের সন্নিবেশে কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্র’র নতুন নাটক ‘ঈর্ষা’। দ্বন্দ্ব কেবল নারী-পুরুষের নয়, শিল্পের সঙ্গে শিল্পীরও। নাটকটি আদতে সৈয়দ শামসুল হক রচিত একটি কাব্যনাট্য, কিশোর সেনগুপ্তের নির্দেশনা ও অভিনয়ে কল্যাণী-র ঋত্বিক সদনে অভিনীত হবে ২৪ ডিসেম্বর সন্ধে সাড়ে ৬টায়। সেখানেই (১৫-২৫ ডিসেম্বর) এ-রাজ্যের একগুচ্ছ শিল্পসম্মত নাটক নিয়ে এ বারের পঁচিশতম নাট্যোৎসব। কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্র আয়োজিত দীর্ঘকালের এ-উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে কল্যাণী ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের নাট্যমোদী দর্শকের প্রশ্রয়ে। অন্য দিকে অনীক-এর আয়োজনে এ বার দ্বাবিংশ গঙ্গা যমুনা নাট্যোৎসব। সাতটি পর্যায়ে অনুষ্ঠিতব্য এই আন্তর্জাতিক উৎসবে দেখা যাবে সারা দুনিয়ার বিভিন্ন নাট্যদলের নাটক। উৎসবের শুরু কলকাতায়, ১৫ ডিসেম্বর তপন থিয়েটারে, শেষ হবে ১ মার্চ। অভিনয় হবে বিভিন্ন জায়গায়। নতুন যে-ক’টি নাটক মঞ্চস্থ হবে তার মধ্যে আছে অনীক-এর নতুন নাটকটিও: ‘ব্রাহ্মণ’, দিব্যেন্দু পালিতের গল্প অবলম্বনে রজত ঘোষের নাটক, ২৮ ডিসেম্বর সন্ধে সাড়ে ৬টায় অ্যাকাডেমিতে।
অচিন পটুয়া
বিশিষ্ট শিল্পীদের শিল্পকর্মের সঙ্গে নবীন শিল্পীদের সেতুবন্ধন ও তাঁদের সৃজনকে তুলে ধরতে ১৯৮১-তে প্রথম শিল্পকলার মুক্ত প্রদর্শনী-সহ বিক্রির আয়োজন করে ‘অচিন পটুয়া’ শিল্পীদল। কালীঘাট মেট্রো স্টেশনের বাইরের দেওয়ালে বা অ্যাকাডেমি রবীন্দ্র সদন নন্দন চত্বর-সহ বিভিন্ন জায়গায় প্রদর্শনীতে সাধারণের নাগালের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয় শিল্পসামগ্রীর বিনিময় মূল্য। অতীতে সোমনাথ হোর, বিজন চৌধুরী, প্রকাশ কর্মকার, পরিতোষ সেন, রেবা হোর, শানু লাহিড়ী প্রমুখ তাঁদের শিল্পসৃজন দিয়েছেন এই মুক্ত প্রদর্শনীতে। শিল্প কর্মশালা, বার্ষিক প্রদর্শনী, প্রবীণ নবীন শিল্পীদের মধ্যে মতবিনিময়-সহ হরেক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত এই শিল্পীদল। এ বার তাদের ৩৭তম বার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনী বিড়লা অ্যাকাডেমিতে। ১০-১৫ ডিসেম্বর, ৩-৮টা।
চোখের বালি
পেঁয়াজ। বঙ্গভূমির চোখের বালি। এ প্রসঙ্গে সাহিত্যিক-শিল্পী মহল যা বললেন— শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়: ‘আমি তো সেই ষাটের দশকে পেঁয়াজের স্পর্শ ছেড়েছি। দাম বাড়ল কি কমল তা দিয়ে কিছু যায় আসে না।’ সমরেশ মজুমদার: ‘সোনার ভরি কত? তা নিয়ে চিন্তিত নই, পেঁয়াজ নিয়েও নয়। ডাল-ভাত-আলুসেদ্ধ খেয়ে কাটাতে পারি। সমস্ত পশ্চিমবঙ্গবাসী যদি মনে করে কাল থেকে পেঁয়াজ খাব না, তবে যারা কালোবাজারি করছে ২০ টাকা কেজিতে পেঁয়াজ বেচবে।’ দেবশঙ্কর হালদার: ‘জানতাম, আদার ব্যাপারীর জাহাজের খোঁজে কী দরকার? এখন দেখছি, পেঁয়াজের খোঁজের কী দরকার? বড় কঠিন সমস্যা!’ শিবাশিস মুখোপাধ্যায়: ‘কবিতার মধ্যে পেঁয়াজের ঝাঁজ দিয়েছি অনেক, কিন্তু বাজার সেই ঝাঁজেই আমাকে কাত করেছে।’ শোনা গেল গৃহিণীরা কম পেঁয়াজ দিয়েই রান্না সারছেন। কালিন্দীর অরবিন্দ হাজরা অবশ্য জামাইকে ‘গাঁ’ থেকে এক বস্তা পেঁয়াজ কিনে আনতে বলেছেন। কিন্তু কলকাতার সত্তর শতাংশ তেলেভাজার দোকানের কী হবে? সেখান থেকে তো পেঁয়াজি নিরুদ্দেশ হয়ে গেল!
অদেখা সোমনাথ হোর
শিল্পী সোমনাথ হোরের জন্ম ১৯২১-এ। এ বার তাই দেবভাষা-র আয়োজনে তাঁর প্রাক্-জন্মশতবার্ষিক প্রদর্শনী ‘শান্তিনিকেতন ও অন্যান্য’। একক এই প্রদর্শনী দেবভাষা বই ও শিল্পের আবাস জুড়ে শুরু হবে ১৪ ডিসেম্বর সন্ধে ৬টায়। শিল্পকাজের সংখ্যা শতাধিক, এর আগে কখনও এই সব কাজ প্রদর্শিত হয়নি। শিল্পীর মধ্যজীবনের কাজ যেমন রয়েছে, তেমনই থাকছে শিল্পীজীবনের সন্ধ্যামুহূর্তের কাজও। সাদাকালোর কাজের সঙ্গে থাকছে রঙিন কাজ। আবার একটি অংশ জুড়ে থাকছে লিথোগ্রাফ এচিং উডকাট স্টেনসিল। নিজের জীবনের প্রতি, গার্হস্থ্যের মেদুরতার প্রতি এই সব ছবির রং-রেখা যেমন কথা বলে তেমনই পরিপার্শ্ব জগৎচরাচর সমাজ ইতিহাসের প্রতি এদের সমান দৃষ্টি। সূচনাদিনে প্রকাশিত হবে সোমনাথ হোরের বই ‘ক্ষতচিন্তা, ভাঙন’— যে ক্ষত ছিল তাঁর সমগ্র শিল্পীজীবনের গর্ভগৃহ সেই ‘ক্ষত’কে নিয়ে শিল্পী নিজস্ব ভাবনা বিধৃত করে গিয়েছেন এক দীর্ঘ লেখায়, তা এই প্রথম গ্রন্থাকারে দেবভাষা থেকে প্রকাশিত হতে চলেছে। উদ্বোধনী সন্ধ্যায় থাকবেন গণেশ হালুই, লালুপ্রসাদ সাউ ও যোগেন চৌধুরী। প্রদর্শনীর শেষ দিন, ৯ জানুয়ারি সন্ধে ৬টায় বলবেন তাঁরই ছাত্র শিল্প-ঐতিহাসিক রামন শিবকুমার।