বিধি উড়িয়ে তৃণমূল সমর্থকদের উল্লাস। মঙ্গলবার। নিজস্ব চিত্র।
বৌবাজারের মুখটায় সবুজ আবির আকাশে উড়িয়ে দলের নামে, দলনেতার নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছিলেন একদল যুবক। মুখে কেন মাস্ক নেই, প্রশ্নের উত্তরে জয়ধ্বনি দেওয়ার ফাঁকেই এক জন বললেন, ‘‘আজকের দিনে আবার মাস্ক কী? ও সব মাস্ক-ফাস্ক আজকের দিনে পরা যাবে না।’’ পাশ থেকে আর এক যুবক বললেন, ‘‘আজ নো-মাস্ক ডে।’’ তার পরে একটু থেমে পুরনো গানের সুরে বললেন, ‘‘এ শুধু জেতার দিন, এ লগন আবির খেলার...’’। হাসতে-হাসতে অন্যেরাও সেই গানে গলা মেলালেন।
বৌবাজারের এই দৃশ্যই মঙ্গলবার কলকাতা পুরসভার নির্বাচনের ফল বেরোনোর পরে শহরের সর্বত্র দেখা গেল। মাস্কহীন, দূরত্বহীন, নিয়ম ভাঙা জয়োল্লাস চলল শহর জুড়ে। যা দেখে মনে হচ্ছিল, ‘কোথাও কোনও অপঘাত নেই’, আর ওমিক্রনের আতঙ্ক নেই দিগন্ত অবধি!
অথচ করোনাভাইরাসের নতুন স্ট্রেন ওমিক্রনের সংক্রমণ-ক্ষমতা নিয়ে বার বার সতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞেরা। যে হারে নতুন স্ট্রেনের সংক্রমণ ছড়াচ্ছে, তা নিয়ে একাধিক বার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও (ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজ়েশন বা ডব্লিউএইচও)। ডব্লিউএইচও-র পরামর্শদাতা তথা ‘সেন্টার ফর ডিজ়িজ়, ডায়নামিক্স, ইকনমিক্স অ্যান্ড পলিসি’-র ডিরেক্টর রামানন লক্ষ্মীনারায়ণ বলছেন, ‘‘জমায়েতের কারণে গত বছর কী হয়েছিল, সেটা যেন আমরা ভুলে না যাই। সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি করলে কিন্তু পরিস্থিতি জটিল হয়ে যাবে।’’
প্রাক্তন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ‘অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল’ প্রতিরোধ নিয়ে গঠিত ‘ইউ এস প্রেসিডেন্সিয়াল অ্যাডভাইজ়রি কাউন্সিল’-এর প্রাক্তন ওই সদস্যের কথায়, ‘‘প্রতিষেধকের দু’টি ডোজ় নেওয়ার পরেও দেখা যাচ্ছে, ওমিক্রন দ্রুত সংক্রমণ ছড়াতে সক্ষম। দু’টি ডোজ় নেওয়া রয়েছে এমন ক্ষেত্রে হয়তো সংক্রমণের তীব্রতা কম হবে। তবে ওমিক্রনের সংক্রমণ গুরুতর প্রভাব ফেলেছে, এমনও অনেক উদাহরণ রয়েছে।’’
অবশ্য এমনটা যে হবে, তা কিছুটা প্রত্যাশিতই ছিল বলে আক্ষেপ অনেকের। কারণ, এমনিই করোনা-বিধি পালনে অনীহা রয়েছে নাগরিকদের একটা বড় অংশের। সেখানে রাজনৈতিক ক্ষমতায় ‘ক্ষমতাবান’ সমর্থকেরা যে নিয়মকানুনের ধার ধারবেন না, সেটাই যেন অলিখিত দেওয়াল লিখন ছিল এ দিনের।
শহরের এক সংক্রামক রোগের চিকিৎসকের কথায়, ‘‘খারাপ লাগে এটা দেখে যে, কোনও রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধির মুখে করোনা-বিধি মেনে চলার কথা তেমন ভাবে শোনা গেল না। অথচ রাজনৈতিক দলগুলো যদি কড়া বিধি জারি করত সমর্থকদের উদ্দেশে, তা হলে কি তাঁরা সাহস পেতেন এই ভাবে উৎসব পালনের?’’
সরকারি হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের এক চিকিৎসক আবার বলছেন, ‘‘আসলে বিষয়টা কেমন গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে অনেকের কাছে। অবশ্য, সেটা বরাবরই ছিল। সমস্যাটা হল, এই দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ স্বাস্থ্য পরিষেবার উপরে চাপ বাড়ায়। তখন চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা দম ফেলার সময় পান না।’’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘সাউথ-ইস্ট এশিয়া রিজিয়ন অফিস’-এর কমিউনিকেব্ল ডিজ়িজ় বিভাগের প্রাক্তন ডিরেক্টর রাজেশ ভাটিয়াও জানাচ্ছেন, প্রতিষেধকের দু’টি ডোজ ওমিক্রনকে রুখতে পারবে, তার পক্ষে বৈজ্ঞানিক কোনও তথ্যপ্রমাণ মেলেনি এখনও। ‘‘ফলে অকারণে ভিড় না করা, জমায়েত এড়িয়ে চলা, মাস্ক পরা-সহ যাবতীয় কোভিড-বিধি মেনে চলতে হবে’’— বলছেন রাজেশবাবু।
কিন্তু ভোটের শহর, জয়োল্লাসের শহরে সেই সতর্কবার্তা আর কে শোনে! সব সতর্কতাই দলবদ্ধ যুবকদের ‘এ শুধু জেতার দিন, এ লগন আবির খেলার...’ চিৎকারে হারিয়ে গেল!