Kolkata Municipal Election 2021

Kolkata Municipal Election 2021: দখলদারির কাঁটায় সরকারি উন্নয়নের নাম জপ

এমনিতেই এলাকায় ঘিঞ্জি রাস্তা ও গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকা বাড়ির মাঝে শ্বাস নেওয়ার পরিসর নেই।

Advertisement

প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায়, নীলোৎপল বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০২১ ০৬:৫৮
Share:

বেহাত: দখলদারির ঠেলায় উধাও রাস্তার ফুটপাত। মানিকতলা থানা এলাকার ক্যানাল ওয়েস্ট রোডে। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।

শোভাবাজার মোড়ের কাছে রবীন্দ্র সরণিতে দাঁড়িয়ে এক উর্দিধারীর সঙ্গে কথা হচ্ছে এলাকার দাদার স্নেহধন্য দুই যুবকের। উর্দিধারী জানতে চাইছেন, আগামী মাস থেকে এলাকার কোথায়, কী ভাবে পার্কিং করানো হবে! অভিযোগ, সেই পার্কিং ব্যবসা সরকারি নয়, পুরোটাই নিয়ন্ত্রিত হয় এলাকার দাদার নির্দেশে। দুই যুবকের মধ্যে এক জন বললেন, ‘‘ভোট আসছে। কয়েক দিন রাস্তা দখলমুক্ত রাখতে হবে। দাদা বলে দিয়েছেন, টাকা একটু কম উঠলেও সমস্যা নেই। এখন ভাবমূর্তি তৈরি করা বেশি জরুরি।’’ তাঁর সঙ্গী যুবকটি বললেন, ‘‘দাদা বলেন, ওয়ার্ড কোঅর্ডিনেটর হলেন টেন্ডার পাওয়া ব্যবসায়ীর মতো। ভাল দর দিতে না পারলে অন্য কেউ টেন্ডার পেয়ে যাবেন। দাদা টেন্ডার না পেলে কিন্তু আপনারাও থাকবেন না।’’

Advertisement

কলকাতায় পুর নির্বাচনের তিন সপ্তাহ আগে দু’নম্বর বরোর ন’টি ওয়ার্ড ঘুরে কানে এল কোনও কোনও কোঅর্ডিনেটরের ‘ঘর গোছানোর’ এমনই টুকরোটাকরা মন্তব্য। জিতলে কেউ রাতারাতি নিজের ওয়ার্ডকে ‘লন্ডন’ করে দেওয়ার কথা বলছেন। কেউ বলছেন, পুরসভার ইংরেজি মাধ্যম স্কুল করবেন। কেউ আবার এক মাসের মধ্যেই জলের সমস্যা সম্পূর্ণ মিটিয়ে ফেলার আশ্বাস দিচ্ছেন। কিন্তু এ সবের মধ্যেও কাঁটা হয়ে বিঁধছে এলাকার লোকজনের প্রশ্নবাণ। যাঁদের অধিকাংশই জানতে চান, পাঁচ বছরের বেশি সময় পেয়েও কাজ সম্পূর্ণ করতে না পেরে এখন কেন সমাজমাধ্যমে ‘লাইভ’ করে কাজ দেখাতে হচ্ছে? কেনই বা রাস্তার দখলমুক্তি এবং পুরনো বাড়ির সমস্যার সমাধান নিয়ে একটি বাক্যও খরচ করা হচ্ছে না?

এলাকা ঘুরে দেখা গেল, সব চেয়ে বড় সমস্যা দখলদারি। এমনিতেই এলাকায় ঘিঞ্জি রাস্তা ও গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকা বাড়ির মাঝে শ্বাস নেওয়ার পরিসর নেই। তার মধ্যেই গত কয়েক বছরে রাস্তার সিংহভাগ চলে গিয়েছে হয় ফুটপাত ব্যবসায়ী, নয়তো দাদার স্নেহধন্যদের হরেক দখলদারির ব্যবসায়। কোথাও ফুটপাত আটকে চলছে ভাতের হোটেল। কোথাও ফুটপাত দিয়ে চলতে গেলে পায়ে লোহার পাতের খোঁচা লাগার উপক্রম। রেহাই পায়নি শোভাবাজার এলাকার একাধিক রাজবাড়ির মতো হেরিটেজ স্থাপত্যের সামনের অংশও। ১০ নম্বর ওয়ার্ডের এই জায়গাটিকে পর্যটকদের কাছে তুলে ধরে রাজ্য সরকার। কিন্তু ওই রাজবাড়ি, নাটমন্দিরের সামনের রাস্তায় দেদার বেআইনি পার্কিং। ইতিউতি তারের জঙ্গল। রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিট থেকে সামান্য দূরে আনন্দ লেনেও দখলের এক চিত্র। উত্তর কলকাতার রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিটে দাঁড়িয়ে এক জন পথচারী অনায়াসেই বলতে পারেন, ‘‘আমি কোন পথে যে চলি!’’

Advertisement

সব চেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি বরোর একাধিক ওয়ার্ড ছুঁয়ে যাওয়া খালধারের রাস্তার। বাস, লরি, গ্যাস সিলিন্ডার-বোঝাই ট্রাক— কী দাঁড় করানো নেই! অবস্থা এমন যে, বড় কোনও বিপদ ঘটলে খালপাড়ের দমকল কেন্দ্র থেকে ইঞ্জিন বার করতে ঘাম ছুটে যায় দমকলকর্মীদের। খালপাড় দখল হয়ে যাওয়ায় দীর্ঘ দিন খাল সংস্কারেও হাত দেওয়া যায়নি বলে অভিযোগ। স্থানীয়দের দাবি, লাভ হয় না পুলিশে জানিয়েও। একই অভিযোগ ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের যৌনপল্লি ঘিরে। সেখানে দেদার অনৈতিক কাজ চললেও পুলিশ-প্রশাসনের তেমন হুঁশই নেই। এ বারও টিকিট পাওয়া বিদায়ী ওয়ার্ড কোঅর্ডিনেটর সুনন্দা সরকার যদিও বলছেন, ‘‘ঘিঞ্জি এলাকায় যথাসাধ্য সৌন্দর্যায়নের কাজ করা হয়েছে। আমাদের কাছে যৌনপল্লির অভিযোগ এলে পুলিশকে জানানো হয়।’’

সমস্যা রয়েছে আরও বেশ কিছু। যেমন, এই বরোয় রয়েছে বহু পুরনো বাড়ি। মাঝেমধ্যেই কোনও বিপজ্জনক বাড়ি ভেঙে মৃত্যুর খবর আসে। চলতি বছরের পুজোতেই যেমন একটি বাড়ি ভেঙে মৃত্যু হয়েছিল এক বালিকা ও এক বৃদ্ধার। ভাঙা বাড়ির ধ্বংসস্তূপের নীচে চাপা পড়ে কোনও রকমে বেঁচে যান ওই বালিকার অন্তঃসত্ত্বা মা। স্থানীয় পুর প্রতিনিধিদের দাবি, বয়সের ভারে কলকাতার এই এলাকা এতটাই ন্যুব্জ যে, বহু ক্ষেত্রে বাড়ির মালিককে পাওয়া যায় না। বাসিন্দাদের মধ্যে চলতে থাকে শরিকি বিবাদ। অনেক বাড়ি আবার দেবোত্তর সম্পত্তির অধীন। ফলে, প্রাণ হাতে করে বসবাস চলতে থাকলেও কড়া নির্দেশ দেওয়ার মতো কেউ নেই। এক পুর প্রতিনিধির আবার দাবি, ‘‘পুরনো বাড়ি নিয়ে আমরা বেশি কথা বলতে গেলেই বাসিন্দারা ভাবেন, প্রোমোটারের সঙ্গে যোগসাজশ করে বাড়ি হাতাতে চাইছি। তাই তেমন কিছু বলি না।’’

এলাকার বহু জায়গায় জলের সমস্যাও মেটেনি বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। তাঁদের দাবি, একাধিক জায়গায় দিনে তিন বার জল আসে ঠিকই। কিন্তু, পড়ে সরু সুতোর মতো। যদিও পুর প্রতিনিধিরা পাল্টা দাবি করছেন, দফায় দফায় কাজ করিয়েও এই সমস্যা মেটানো যায় না। এক পুর ইঞ্জিনিয়ারের কথায়, ‘‘একটা বস্তিতে ১০টা কল বসানো হচ্ছে। জলের তোড় যাতে বাড়ে, সে জন্য সেই কলই ভেঙে দিচ্ছেন বাসিন্দাদের কেউ কেউ। ফলে চেষ্টা যতই করা হোক, মানুষ না বদলালে কিছু হবে না। এই মানসিকতার জন্যই বার বার রাস্তা সারিয়েও ধরে রাখা যায় না। কলের কাজের জন্য রাস্তা খুঁড়তেই হয়। তবে আলো নিয়ে তেমন অভিযোগ নেই।’’

সমস্যা এমন হাজারো। তার পরেও গত বিধানসভা নির্বাচনে এই বরো থেকে ৯টি ওয়ার্ডেই এগিয়ে ছিল তৃণমূল। বামেদের দখলে থাকা ১০ নম্বর ওয়ার্ডও উল্টো চিত্র তৈরি করতে পারেনি। আসন্ন পুর নির্বাচনেও সব ক’টি ওয়ার্ডই তাঁদের পক্ষে যাবে বলে দাবি করছেন স্থানীয় তৃণমূলকর্মীরা। এই আত্মবিশ্বাস কিসের জোরে?

এ বারে প্রার্থী না হলেও প্রাক্তন বরো কোঅর্ডিনেটর সাধন সাহা বললেন, ‘‘পুরসভার কোনও কাজই সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছে বলে দেওয়া যায় না। কম-বেশি সব ক্ষেত্রে উন্নতি হয়েছে। কিছু কাজ বাকি। কিন্তু তার চেয়েও বড় কারণ, সরকারি ভাবে সার্বিক উন্নয়ন।’’ সেই উন্নয়নের জোরেই কি এই বরো দখলের চেষ্টা? বরোর বাসিন্দা, ঘূর্ণিঝড় আমপানের রাতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত রাহুল অধিকারীর মা বললেন, ‘‘পুরসভার খুঁটির সঙ্গে বিদ্যুতের তার জড়িয়ে পড়েছিল। তাতেই চলে যায় আমার ছেলেটা। ঝড়ের রাতেই বুঝেছিলাম উন্নয়নের চেহারা। ছেলের কথা মনে রেখেই এ বার ভোট দেব।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement