ছবি সৌজন্য: গোর্কি সদন
আধুনিক বাংলা নাটকের ইতিহাসের আরম্ভকাল মনে করা হয় ১৭৯৫-৯৬ সালকে। দলের নাম ‘বেঙ্গলি থিয়েটার’, অনূদিত হয়েছিল দু’টি নাটক, রিচার্ড পল জোডরেল-এর দ্য ডিসগাইজ় (বাংলায় কাল্পনিক সংবদল) এবং মলিয়ের-এর লাভ ইজ় দ্য বেস্ট ডক্টর। ১৭৯৫-এর ২৭ নভেম্বর কাল্পনিক সংবদল-এর প্রথম অঙ্ক অভিনীত হয়, পরের বছর ২১ মার্চ তিনটি অঙ্কই। ইংরেজিগন্ধী এক বাংলা অনুবাদে বাংলা থিয়েটারের পথ দেখান যিনি, তিনি বাঙালি বা ভারতীয় নন, এমনকি ইংরেজও নন। তাঁর বাস সুদূর রুশ দেশে, নাম গেরাসিম স্তেপানোভিচ লেবেদেভ (১৭৪৯-১৮১৭) (ছবিতে ডান দিকে)।
লেবেদেভ ছিলেন পরিব্রাজক, ভাষাবিদ, অনুবাদক ও সঙ্গীতকার। তবে স্বশিক্ষিত বেহালাবাদক হিসেবেই খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। কূটনীতিবিদ আন্দ্রেই রাজ়ুমোভস্কির সঙ্গী হিসেবে সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে ভিয়েনা পাড়ি জমান। ইউরোপের নানা দেশ ঘুরতে থাকেন, জমে ওঠে রোজগার। এক সময় পৌঁছন ইংল্যান্ডে। তত দিনে সঙ্গীতকার হিসেবে পরিচিত লেবেদেভ। সরকারি আমন্ত্রণ পেয়ে ১৭৮৫ সালে তাঁর মাদ্রাজে আগমন। দু’বছর পর আসেন কলকাতায়, ছিলেন দশ বছর। বাংলা, সংস্কৃত ও হিন্দি— তিনটি ভাষাই শেখেন। বেহালাশিল্পী হিসেবেও নাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে, টিকিট কেটে অনুষ্ঠানে আসেন শ্রোতারা। তিনিই প্রথম পশ্চিমি বাদ্যযন্ত্রে ভারতীয় সুর বাজান। এর পরেই ভারতে ইউরোপীয় ঢঙে প্রসেনিয়াম নাটকের ভাবনা তাঁর মাথায় আসে। স্থানীয় বিদ্যোৎসাহীদের সঙ্গে মিলে কলকাতায় প্রথম থিয়েটার তৈরি করেন। প্রথম বার প্রসেনিয়াম মঞ্চে অভিনয় করেন বাঙালি অভিনেতা-অভিনেত্রীরা, থিয়েটারে প্রবেশের অধিকার মেলে ভারতীয় দর্শকদের। নাটকের জন্য ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের কথা নিয়ে তাতে সুরারোপ করেন লেবেদেভ। সে সময় কলকাতায় দু’টি বিলিতি নাট্যমঞ্চ ছিল, ‘দি ক্যালকাটা থিয়েটার’ ও ‘দি নিউ প্লে হাউস’। শোনা যায়, লেবেদেভের জনপ্রিয়তায় ইংরেজরা ভয় পেয়েছিল। কিছু দিন পরেই তাঁর সেই তিনশো আসনবিশিষ্ট থিয়েটারে আকস্মিক ভাবে আগুন লেগে ছাই হয়ে যায় সব কিছু!
বাংলা নাটকের ইতিহাসের এই মাইলফলকের ঠিকানা ছিল তৎকালীন কলকাতার ২৫, ডোমতলা; বর্তমানে যা ৩৭, এজরা স্ট্রিট। ২০০৯ সালের ২৭ নভেম্বর কলকাতা পুরসভা এবং কলকাতায় রুশ কনসুলেট জেনারেলের সংস্কৃতি বিভাগের উদ্যোগে সেই স্থানে একটি ফলক স্থাপিত হয় (ছবিতে বাঁ দিকে)। প্রত্যেক বছর ওই তারিখে সেখানে উপস্থিত হন কলকাতার রুশচর্চার প্রাণকেন্দ্র গোর্কি সদনের আধিকারিকেরা। এ বছর পূর্ণ হচ্ছে প্রথম অভিনয়ের ২২৫ বছর। সেই উপলক্ষে ওই দিন ফলকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়, আলোচনা হয় লেবেদেভের কাজ প্রসঙ্গে। এ ছাড়াও গত তিন বছর ধরেই প্রত্যেক মাসে লেবেদেভের স্মরণে একটি করে নাটক মঞ্চস্থ করার আয়োজন করছে গোর্কি সদন। অতিমারির কারণে মার্চ মাস থেকে বন্ধ ছিল সেই উদ্যোগ, আবার তা শুরু হচ্ছে ডিসেম্বরে।
ক্লাসের বাইরেও
ক্লাস শেষে ছাত্রের স্বগতোক্তি, ‘বুঝতে পারলাম না।’ সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি, নিখুঁত ছাঁটা দাড়ি, পুরু চশমার আড়ালে উজ্জ্বল চোখ নিয়ে মাস্টারমশাইয়ের প্রশ্ন, ‘কতটা বুঝতে পারলে না?’ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক স্বপন মজুমদার (ছবিতে) জানতেন, তাঁর বহুমুখী বৈদগ্ধ্যকে ছাত্রছাত্রীর পরীক্ষা পাশের বিদ্যায় আঁটানো মুশকিল। ভক্তি সাহিত্য পড়াতে গিয়ে বলতেন, শুধু শ্রীচৈতন্য নয়, নামদেব থেকে তুকারাম, বুলে শাহ— সব জানতে হবে। পরে ছাত্ররা জেনেছে, স্বপনবাবু শুধু মাস্টারমশাই নন, জবরদস্ত প্রশাসক ও গবেষকও। জ্ঞানপীঠ, সাহিত্য অকাদেমির সদস্য, রবীন্দ্র ভবনের ডিরেক্টর, সাহিত্য অকাদেমির অনুবাদ কেন্দ্রের পরিচালক, যাদবপুরের স্কুল অব কালচারাল টেক্সটস অ্যান্ড রেকর্ডস-এর প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সম্পাদকও তিনি। ফিজিতে ভারতীয় দূতাবাসের সংস্কৃতি বিষয়ক আধিকারিক ছিলেন, তুঘলক নাটক অনুবাদের পাশে ‘বহুরূপী’ দলের ৬০ বছর এবং রবীন্দ্র গ্রন্থসূচি, বাংলা বানান ও বিন্যাস প্রণয়নে সিদ্ধহস্ত। ক্লাসে নয়, আগ্রহী ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে উঠত বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পর্যায়ে। অসুস্থ ছিলেন, ২৫ নভেম্বর চলে গেলেন মনস্বী অধ্যাপক।
স্মৃতিময়
‘এতদিন হাঁটাচলা করে বহু ব্যবহারে তার পা দু’টি কি ক্লান্ত হয়ে গেছে এবার কি ওরা থামতে চাইছে...’ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের শেষ কাব্যগ্রন্থ ভাঙা পথের রাঙা ধুলায়-এর শেষ স্তবক। তাঁর আশ্চর্য জীবনের স্মরণালেখ্যে সঙ্গী হওয়ার আয়োজন আগামী শনিবার ৫ ডিসেম্বর সন্ধে সাড়ে ৫টায় রবীন্দ্র সদনে। ‘শোক নয় আর, উদ্যাপনে রাখি, কান্নাও নয়, ওড়াই স্মৃতির পাখি’, উদ্যোক্তা ‘মুখোমুখি’-র পক্ষে জানিয়েছেন কন্যা পৌলমী ও বিলু দত্ত। চলচ্চিত্র ও নাট্যজগতের বিশিষ্ট জনদের সঙ্গে উপস্থিত থাকবেন সৌমিত্রবাবুর পরিবারের সদস্যরাও। লন্ডন থেকেও সৌমিত্র-স্মরণ ‘বৈঠক ইউকে’-র উদ্যোগে, সঙ্গে এসেক্স-এর ভারতীয়রা, লন্ডন ইন্ডিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল কর্তৃপক্ষ। রবিবার ৬ ডিসেম্বর বেলা ১টায়: ‘রিমেম্বারিং দ্য লেজেন্ড সৌমিত্র চ্যাটার্জি’। তাঁকে নিয়ে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের প্রাক্তনী সংসদও স্মৃতি-সন্ধ্যার আয়োজন করেছিল গত ২৩ নভেম্বর।
রেশমি জয়যাত্রা
‘সূর্যের মতো গনগনে রং, রত্নের ন্যায় মসৃণ’— অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে অসম সিল্কের বর্ণনায় লিখেছেন কৌটিল্য। আহোম রাজবংশের গরিমা, পুরাণ-লোককথার মহিমা জড়িয়ে আছে বয়নশিল্পের বুনোটে। রাজা প্রতাপ সিংহের মন্ত্রীর আদেশে রাজ্যের সমর্থ পুরুষদের বেতের ঝুড়ি তৈরি আর নারীদের সুতো বোনা বাধ্যতামূলক হয়েছিল। এ নির্দেশে রাজদণ্ডের শাসন থাকলেও, এ ভাবেই বুনন আর ফোঁড়াইয়ের কারুকৃতি বুঝি মিশে গিয়েছিল ব্রহ্মপুত্র-তটের উত্তরপ্রজন্মের রক্তে। আর ভূ-ভারত বুঁদ হয়েছিল অসমিয়া গোল্ডেন মুগা, সাদা পাট ও এরি সিল্কের ঐশ্বর্যে। গত চল্লিশ বছর ধরে বিশ্বের সঙ্গে এই পরিধেয় সম্ভারের পরিচয় করাচ্ছেন কলকাতাবাসী উদ্যোগকর্ত্রী শম্পা দাস। স্বাধীনতা সংগ্রামী পূর্বপুরুষদের থেকে এই বাঙালিনি উত্তরাধিকারে পেয়েছেন স্বদেশির অহঙ্কার। তাই অসমের ম্যাঞ্চেস্টার সুয়ালকুচি গ্রামের শিল্পীদের তৈরি সিল্ক ও মেখলা চাদরে আধুনিক ফ্যাশনের ফিউশন মেশাননি কখনও। রঙিন জমিতে সনাতনি নকশার লতাপাতা, চাষি-টুপি, ময়ূর, গন্ডারের মোটিফেই আবারও বিশ্বজয়। অসম সিল্কের রাজসিক ইতিহাস ও তার পুনরুজ্জীবনে শম্পাদেবীর অভিযাত্রার কাহিনি নিয়ে শম্পা দাস: গোল্ডেন মুগা রিভাইভালিস্ট বইটি লিখেছেন ঋতা ভিমানি। ২১ নভেম্বর সন্ধেয় প্রকাশিত হল বেঙ্গল ক্লাবে।
ঊর্ণাময়িক
আপদ্ধর্ম, প্রায়শ্চিত্ত ও পূর্তকর্ম, প্রাচীন এবং আদি মধ্যযুগীয় ভারতে এই তিন রীতির তত্ত্ব এবং প্রয়োগই এ বছরের ‘চিন্তাহরণ চক্রবর্তী স্মারক বক্তৃতা’-র মূল বিষয়। আগামী ৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৭টায় ‘সোসাইটি ফর আন্ডারস্ট্যান্ডিং কালচার অ্যান্ড হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া’ (সুচি) আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে বক্তা ইতিহাসবিদ রণবীর চক্রবর্তী। কোভিড পরিস্থিতিতে গত কয়েক মাস ধরেই বিভিন্ন বিষয়ে বক্তৃতার আয়োজন করছে এই সংস্থা, আন্তর্জাল মাধ্যমে বক্তৃতার বাংলা নামকরণ করা হয়েছে ‘ঊর্ণাময়িক বক্তৃতা’। ইতিমধ্যেই হরবংশ মুখিয়া, ধীমান চট্টোপাধ্যায়, সুচন্দ্রা ঘোষের মতো ইতিহাসবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলেছেন নানা বিষয়ে। সংস্থার ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলে শোনা যাবে আগামী বক্তৃতাটি।
হিমালয়ের পথে
এপ্রিল, ১৯৪২। শান্তিনিকেতনে প্রবল গরম পড়েছে সে বার, মাস্টারমশাই নন্দলাল বসু ঠিক করলেন আলমোড়া যাবেন, সঙ্গে বিনায়ক মাসোজী ও শান্তিদেব ঘোষ। বোলপুর থেকে ট্রেনের থার্ড ক্লাসের যাত্রী তাঁরা, কামরায় ঠাসা ভিড়, শিল্পাচার্য শুধু একটু বসার জায়গা পেয়েছেন, বাকি দু’জন দাঁড়িয়ে। দীর্ঘ যাত্রায় লখনউ, বরেলী, কাঠগোদাম, সেখান থেকে বাসে আলমোড়া। তরুণ শান্তিদেব আগে হিমালয় দেখেননি, শিল্পাচার্যেরও আলমোড়ার এই অঞ্চল অপরিচিত। পাহাড়ি পথে প্রতি দিন বেড়ানো, ইজেল-ক্যানভাস সাজিয়ে মাস্টারমশাইয়ের ছবি আঁকতে বসা ছিল আলমোড়া-পর্বের রুটিন। আলমোড়া রামকৃষ্ণ মিশন ও জগদীশচন্দ্র বসুর শিষ্য বশীশ্বর সেনের বাড়ি আর উদয়শঙ্করের সংস্কৃতি কেন্দ্র দেখতে যাওয়া, শান্তিদেবের কাছে শেষেরটিই সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। মায়াবতী আশ্রমে কয়েক দিন কাটিয়ে টনকপুর হয়ে জুন-শেষে বোলপুর ফেরা। প্রকৃতি, শিল্প ও লোকজীবন-ঋদ্ধ এই অভিজ্ঞতাই শান্তিদেব ঘোষ লিখেছিলেন হিমালয়ের পথে ভ্রমণকথায়, ১৩৪৯ বঙ্গাব্দের দেশ পত্রিকার তিনটি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল তা। একই নামে এ বার সেটি গ্রন্থাকারে বেরোল, সপ্তর্ষি প্রকাশনের নতুন ‘মননসঙ্গী’ সিরিজ়ের দ্বিতীয় বই হিসেবে। পটভূমিকা লিখেছেন দময়ন্তী দাশগুপ্ত, শান্তিদেবের সাবলীল বর্ণনার পাশাপাশি ছিমছাম বইটিতে অনবদ্য প্রাপ্তি নন্দলাল বসুর আঁকা ছবি। সঙ্গের ছবিতে ১৯৪২ সালের ৩ জুলাই তাঁর আঁকা মায়াবতীর নিসর্গ, এই ছবিটিই আছে বইয়ের প্রচ্ছদেও।
বিপ্লবী স্মরণে
মাস্টারদা সূর্য সেনের (১৮৯৪-১৯৩৪) জন্মের ১২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে মিলে গেল দুই বাংলা। কলকাতার ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল স্টাডিজ ও ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজনে গত ২৬ নভেম্বর আন্তর্জাল-আলোচনার বিষয় ছিল ‘উপনিবেশ বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রাম: জালালাবাদের লড়াই থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’। সূর্য সেনের নেতৃত্বে ১৯৩০-এর এপ্রিলে ঐতিহাসিক চট্টগ্রাম অভ্যুত্থানের পর জালালাবাদ পাহাড়ে হয়েছিল রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। বাঙালির স্বাধীনতাস্পৃহা ও শৌর্যের পরম্পরা অব্যাহত ছিল ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও। মূলত এই দুই ঐতিহাসিক ঘটনাকে ঘিরেই সশস্ত্র আন্দোলনে বাঙালির বীরত্বগাথার কথা উঠে এল দুই বাংলার বিশিষ্টজনের আলোচনায়। ছিলেন বাংলাদেশের অধ্যাপক মহম্মদ সেলিম, মালেকা বেগম, আব্দুল মান্নান ও সেলিনা হোসেন, কলকাতার সত্যব্রত দে, বিমলশঙ্কর নন্দ প্রমুখ, সভাপতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মীজানুর রহমান। গত মাসে সূর্য সেনকে নিয়ে এক আলোচনায় ছিলেন শতবর্ষী বিপ্লবী সুধীন্দ্রচন্দ্র মৈত্র। ছবিতে কলকাতা হাই কোর্ট প্রাঙ্গণে মাস্টারদা সূর্য সেনের মূর্তি।
কবিতার সেতু
দু’টি দেশ বিশ্বের দুই প্রান্তে। কিন্তু তাদের সাংস্কৃতিক দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্কের তিন দশক অতিক্রান্ত। বিদ্যাচর্চার জগতে যোগাযোগও কম নয়। ভারত ও পেরুর মধ্যে বন্ধুত্বের আর এক নতুন সূত্র ‘ফার্স্ট ইন্ডিয়া-পেরু পোয়েটস ভার্চুয়াল মিট’। অতিমারিতে শারীরিক দূরত্ব বাড়লেও মনের দিক থেকে মানুষ যে আরও বেঁধে বেঁধে থাকার ইচ্ছা পোষণ করেছে, তা বোঝা যায় এমন কবিতা উৎসবেই। ২২ নভেম্বর ভারতীয় সময় রাত ৮টায় আন্তর্জালে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ছিলেন সুবোধ সরকার, শর্মিলা রায়, তন্ময় চক্রবর্তী ও সুদীপ ভট্টাচার্য। পেরুর পক্ষ থেকে ছিলেন মার্কো মার্তোস কারেরা, ফের্নান্দো কুইয়া, কার্লোস গারাইয়ার দে লিয়ো এবং হেইনরিখ এলবের্গ শাভেস। নিজেদের কবিতা পড়েন কবিরা, আর অনুবাদে তা পাঠ করেন অনুষ্ঠানের আয়োজক ইন্দো-হিস্পানিক ল্যাংগোয়েজ অ্যাকাডেমির ছাত্রেরা।
সীমানা পেরিয়ে
প্রবাসী পত্রিকায় রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় নটীর পূজা-য় গৌরী ভঞ্জের অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন, মানুষ অন্তত কিছু ক্ষণের জন্য উন্নততর লোকে অবস্থিত হয়। শান্তিনিকেতন আশ্রমের কলাভবনের ‘মাস্টারমশাই’ নন্দলাল বসুর কন্যা গৌরী ছিলেন আঁকা থেকে অভিনয়ে সমান পারদর্শী। তাঁকে নটীর পূজা-র তালিম দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ শিখিয়েছিলেন: “তোর নাচকে করে তুলতে হবে পূজা।” শতবর্ষ উপলক্ষে কলাভবন নিয়ে সেখানকার প্রাক্তনীদের এমন আরও নানাবিধ স্মৃতি পাঠ আর কথনের সম্মিলন হয়ে উঠেছে ‘স্মরণ’ নামের তথ্যচিত্রটি (নির্দেশনা: শর্মিলা রায়)। ছবিটি ইউটিউবে এসেছে এ মাসেই। স্মৃতিভাষ্যের সঙ্গে কলাভবনের চিত্রকলা ও ভাস্কর্য তো বটেই, রবীন্দ্রগানও আছে সারা ছবি জুড়ে। আছে বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, রামকিঙ্কর বেজ থেকে দিনকর কৌশিক, কে জি সুব্রহ্মণ্যন, শর্বরী রায়চৌধুরী— সকলের আত্মকথন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে শান্তিনিকেতনে কলাভবনের পত্তনে (১৯১৯) রবীন্দ্রনাথের অভিপ্রায় ছিল, পাঠ্যপুস্তকের সঙ্কীর্ণ সীমা পেরিয়ে কারুকার্য, শিল্পকলা, নৃত্যগীত চর্চা, নাট্যাভিনয় ও পল্লিহিতসাধনের ভিতর দিয়ে চিত্তের পূর্ণ বিকাশ ঘটানো।
সংগ্রহে সৌমিত্র
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত ছবির বিদেশি কার্ড, পোস্টার। সিনেমার বিদেশি লবি কার্ড, বিজ়নেস কভার, প্রচারপত্র ও পুস্তিকাও রয়েছে ঢাকুরিয়ার গোপাল বিশ্বাসের কাছে। এর অনেকগুলি— স্বাভাবিক ভাবেই— সত্যজিৎ-স্মারকও। বহু বছর ধরে একটু একটু করে চয়ন করা তাঁর বিপুল সংগ্রহ, অনেকটাই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে ঘিরে। প্রিয় অভিনেতা-শিল্পীর প্রয়াণের পর সেগুলি খুলে দেখে, গুছিয়ে রাখাতেই স্মরণ। শান্তিও। সৌমিত্রের চিঠি, বই, তাঁর অভিনীত নাটকের টিকিট, বুকলেট, বিভিন্ন সময়ের ফিল্ম ম্যাগাজ়িনে প্রকাশিত সৌমিত্রের ছবির বিজ্ঞাপন, কী নেই! অনেক কিছুর উপরেই জ্বলজ্বল করছে বিখ্যাত স্বাক্ষর। অশনি সংকেত-এর একটি বুকলেটে সই করিয়ে নিতে গেলে খোদ অভিনেতাই বলেছিলেন, “এ তো দেখাই যায় না প্রায়!” সৌমিত্রের করা বিজ্ঞাপন, এমনকি দূরপাল্লার বাসের টিকিটের উল্টো পিঠে সৌমিত্র-উপস্থিতি, সেও আছে গোপালবাবুর কাছে। ছবিতে কলকাতার কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে নামজীবন নাটকের বুকলেট, এ ছাড়া জব চার্নকের বিবি ছবির বিজ়নেস কভার, খুঁজে বেড়াই ছবির বুকলেট।
শুধু পটে লিখা
তেলাকুচো পাতা থেকে সবুজ রং, লটকন ফলের বীজ থেকে লাল, চাল পুড়িয়ে কালো। এ ভাবেই প্রকৃতি থেকে রং খুঁজে নিয়ে কাগজে ছবি এঁকে আর গান বেঁধে গল্প শোনান তাঁরা। দেন লোকশিক্ষা। তাঁরা এই বাংলার পটচিত্রী। ১৯-২৫ নভেম্বর ছিল বিশ্ব ঐতিহ্য সপ্তাহ, ২৪ নভেম্বর আন্তর্জাল মাধ্যমে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, কলকাতার তরফে আয়োজিত অনুষ্ঠানে পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়া গ্রাম থেকে যোগ দিলেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে পুরস্কার জয়ী পটচিত্রশিল্পী স্বর্ণ চিত্রকর ও তাঁর সহযোগীরা। দেখালেন রাধাকৃষ্ণ, রবি ঠাকুর থেকে শুরু করে করোনাভাইরাসের পট, সঙ্গে গান। হাতে-কলমে বোঝালেন পটচিত্রের নির্মিতি-ব্যাকরণও। অতিমারিতে মনমরা হয়ে থাকা শহরকে গানে, রঙে ভরিয়ে দিলেন ওঁরা। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, কলকাতা-র ফেসবুক পেজে এখনও দেখা যাবে অনুষ্ঠানটি।
গানের অন্তর
মহাজনী গানের জনপ্রিয়তা যথেষ্ট। কিছু গানের পঙ্ক্তি লোকের মুখে মুখে ফেরে। কিন্তু তাদের কথা সকলের কাছে ধরা দেয় না। আসলে এর অর্থ আপাত নয়, অন্তর্নিহিত। ‘লোকসনাতন’ সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী আয়োজিত এক আন্তর্জালিক আলোচনায় ৮ নভেম্বর সন্ধেয় মহাজনী গান ও তার বিবর্তন নিয়ে বললেন সঙ্গীতশিল্পী শুভেন্দু মাইতি। শোনা গেল দেহতত্ত্ব প্রসঙ্গও, যে ভাবনা এই গান-ধারার ভিত্তিস্বরূপ। কথার ফাঁকে ফাঁকে গানও শোনান শিল্পী। ভারতীয় লোকসংস্কৃতির প্রসার ও সংরক্ষণই উদ্দেশ্য ‘লোকসনাতন’-এর; সঙ্গীত, নৃত্য, চিত্রকলা, সাহিত্য, খাদ্য— লোকসংস্কৃতির বিবিধ দিক ও আঙ্গিক ফেসবুক পেজে নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তুলে ধরছে তারা।
ভাবনার বিনিময়
বিভিন্ন পরিসরের মধ্যে ওঠা দেওয়াল বছরভর রাজনীতি-সঙ্গীত-সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে ভেঙে দেন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা। অতিমারিতে ক্যাম্পাস বন্ধ, পুরনো সেই সব মেলামেশার দিনগুলো ফিরে পেতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু পড়ুয়া তৈরি করেছেন ‘অ্যাপোরিয়া লিটারারি সোসাইটি’, বাংলায় ‘অপারিয়া সাহিত্যসভা’। আলোচনা, বিতর্ক, আড্ডায় ভাবনার বিনিময় হবে সেখানে। সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন উপলক্ষে, গত ২৬ নভেম্বর সন্ধে ৭টায় আন্তর্জালে যাত্রা শুরু হল তার। ‘মিথোলজি ও কল্পবিজ্ঞান: তুলনামূলক আলোচনা: প্রসঙ্গে প্রফেসর শঙ্কু’ শীর্ষক বিষয়ে বললেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক অনির্বাণ রায়। শঙ্কুর কল্পকাহিনিতে ঘটে যাওয়া অতিলৌকিক ঘটনার প্রেক্ষিতে বিশ্বের নানা প্রান্তের পুরাণকথা শোনালেন তিনি। ‘অ্যাপোরিয়া’ ফেসবুক পেজে আলোচনাটি শোনা যাবে।
কাচের ছবি
পথের পাঁচালী ছবিতে অপু-দুর্গার বৃষ্টিতে ভেজার দৃশ্য। গুপী-বাঘার এক সঙ্গে গান গাওয়ার মুহূর্ত। জয় বাবা ফেলুনাথ ছবিতে ছুরির খেলা দেখানোর সেই বিখ্যাত বোর্ডের নকশা (ছবিতে), কিংবা স্বয়ং সত্যজিৎ রায়ের প্রতিকৃতি। এই সবই গ্লাস পেন্টিংয়ের মতো শিল্পমাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন পল্লবী সিংহ রায়। এ বছর সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষ, করোনা-কালে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে যেমন হয়ে চলেছে নানা অনুষ্ঠান ও উদ্যাপন, তেমনই ব্যক্তিগত স্তরে বেশ কিছু অন্য রকম উদ্যোগ নজর কাড়ছে। পল্লবীর গ্লাস পেন্টিং তেমনই এক উদাহরণ, কাচের উপর ফুটিয়ে তুলেছেন অনুপম সত্যজিৎ-সৃষ্টিকে। তারই কিছু নমুনা পল্লবী সম্প্রতি তুলে দিলেন সন্দীপ রায়ের হাতে। এমন উপহার পেয়ে খুশি তিনিও। বললেন, “এ রকম কাজ একত্রে এনে প্রদর্শনী করা যায়।”
কলকাতার রাস
বৈষ্ণব শাস্ত্রমতে ‘স্পন্দন’, ‘হিন্দোল’ ও ‘উল্লাস’ লীলাগুলির মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্ব স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ প্রবর্তিত ‘উল্লাস’ বা রাসলীলার। চৈতন্যচরিতামৃতে আছে, “সম্যক বাসনা কৃষ্ণের ইচ্ছা রাসলীলা।/ রাসলীলা-বাঞ্ছাতে রাধিকা শৃঙ্খলা।” দোল ও ঝুলনের মতো রাসের সঙ্গেও সূর্যের বার্ষিক গতি ও কৃষি উৎপাদনের সম্পর্ক জুড়ে আছে। রাস জনপ্রিয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাই দেখা যায়, ধর্ম-শিল্প-অর্থনীতি মিলেমিশে উৎসবের নতুন রূপ। কলকাতার রাস উৎসবও এই বৃত্তের বাইরে নয়। কীর্তন, ধর্মগ্রন্থ পাঠ হয়, মেলা বসে, উৎসব প্রাঙ্গণ সেজে ওঠে কৃষ্ণলীলা ও দশাবতার মূর্তিতে। এ শহরের উল্লেখযোগ্য রাস উৎসব হয় বাগবাজারের মদনমোহনতলা ও হরিদাস সাহার মন্দিরে, টালিগঞ্জে বড় রাসবাড়িতেও। কাশীপুরে রতনবাবু রোডের আড়াইশো বছরের প্রাচীন রাসমঞ্চ (ছবিতে) ঘিরে বসে মেলা। আজ রাস, কিন্তু করোনার জন্য এ বার মেলার অনুমতি দেওয়া হয়নি।
ছবির মেলায়
শীত শুরু, কিন্তু মেলা নেই, শহরের মন মানছে না। কোভিড-বিধি মেনে দক্ষিণ কলকাতার ‘দেবভাষা বই ও শিল্পের আবাস’-এ ৫-৮ ডিসেম্বর চলবে ‘দেবভাষা শিল্পমেলা’। ঘরোয়া এই মেলায় থাকছে ক্রেয়ন থেকে টেম্পেরা, প্যাস্টেল, তৈলচিত্র, কোলাজ, বিভিন্ন মাধ্যমে করা বাংলার প্রবীণ ও নবীন শিল্পীদের কাজ। মিলবে দেবভাষা-র বইপত্র, চিত্রিত ব্যাগ, কফি মাগ। মেলা উপলক্ষে হচ্ছে প্রদর্শনী ‘লিভিং ট্র্যাডিশন’— আছে পরিতোষ সেন, সোমনাথ হোর, কে জি সুব্রহ্মণ্যন, রেবা হোর, রণেন আয়ন দত্ত, রবীন মণ্ডল, সনৎ কর, রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়, গণেশ হালুই, লালুপ্রসাদ সাউ, যোগেন চৌধুরী, শুভাপ্রসন্ন, অনিতা রায় চৌধুরী ও তুষার চৌধুরীর ছবি, ১৮ ডিসেম্বর অবধি। অন্য দিকে, আলোকচিত্রে বহতা জীবনের খণ্ডচিত্র তুলে ধরাতেই আনন্দ ডাক বিভাগের প্রাক্তন কর্মী কিংশুক রায় ও আইআইটি-তে
বি টেক চতুর্থ বর্ষের ছাত্র দেবস্মিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ‘দ্য লেয়ার্স অব এন্টিটি’ নামে তাঁদের ফোটোগ্রাফি প্রদর্শনী শুরু হয়েছে ২৭ নভেম্বর, অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস-এর সাউথ গ্যালারিতে। চলবে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত, রোজ ১২টা থেকে রাত ৮টা।
দুই মলাটে
হর্ষবর্ধন-গোবর্ধনের আরশোলা রেস, যুদ্ধের অ্যাডভেঞ্চার, শিবরাম চক্রবর্তীর পিসিমার পিকদানির সব গল্প এ বার দু’মলাটে, ‘চকরবরতি’ লেখকের ঝাঁকালো চুলের সরস ছবি-সহ। শিবরাম চক্রবর্তী সৃষ্ট চরিত্রযুগলের কীর্তিকলাপ হর্ষবর্ধন গোবর্ধন সমগ্র-র দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশ করল ‘কল্পবিশ্ব’ প্রকাশনার ইমপ্রিন্ট ‘মন্তাজ’। ২১ নভেম্বর ছিল আন্তর্জাল-আলাপচারিতা, উদ্বোধন হল প্রকাশনার ডিজিটাল বিপণিও। বিশিষ্টজনের স্মৃতিচারণায় উঠে এল শিবরাম ও শৈল চক্রবর্তীর জীবন। শুধু হর্ষবর্ধন-গোবর্ধনকে নিয়েই শিবরাম লিখেছেন শতাধিক গল্প, ছ’টি উপন্যাস, নাটক, ছড়া, কৌতুকী। তাঁর লেখা দুষ্প্রাপ্য হর্ষবর্ধন-কাহিনি, পত্রিকায় প্রকাশিত অগ্রন্থিত গল্প ঠাঁই পেয়েছে এই বইয়ে, আছে প্রেমেন্দ্র মিত্র, হিমানীশ গোস্বামী ও কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা হর্ষবর্ধনের তিনটি প্যাস্টিশ বা সরস অনুকৃতি। থাকছে শৈল চক্রবর্তীর আঁকা মূল ছবিগুলিও।
দাও ফিরে
বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্রনাথকে ‘ধুত্তোর’ করতে চাইতেন কিন্তু পারতেন না। শেষের কবিতা তাঁকে ও তাঁর সহ-লেখকদের ফের এগিয়ে দিল রবীন্দ্রনাথের দিকে। কলহ ও মিলনের দ্বন্দ্বই তো ভালবাসা, বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত আধুনিক বাংলা কবিতা সঙ্কলনে তাই রবীন্দ্র-কবিতা অনিবার্য। কলকাতার সঙ্গেও নিগূঢ় প্রেমের সম্পর্ক তাঁর। ঢাকার ছেলেটিকে কলকাতা যৌবনবন্ত করে তুলেছিল। দক্ষিণ কলকাতার রূপ-রসে মজলেন বু.ব. সেই রূপ-রস আজীবন তাঁর লেখায়। তাঁর কবিতা ভবনের পদ্যযাপনের দিন, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের নির্মাণ ও প্রসারের উদ্যমময় প্রহরগুলি কলকাতাকে বর্ণময় করেছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের টান অমোঘ, তাই শান্তিনিকেতন ভ্রমণ। মুগ্ধ বুদ্ধদেব লিখলেন ‘সব-পেয়েছির দেশে’-র কথা। সে শান্তিনিকেতন তখন সদর্থে কসমোপলিটন নাগরিক সমাজ। আজ বুদ্ধদেব বসুর জন্মদিন, রবীন্দ্রনাথ-বুদ্ধদেবের নাগরিকতা কি বাঙালি ফেরাতে পারে না!
সেই যে আমার নানা রঙের ট্রেনগুলি
ছবি: সুমন বল্লভ
তত ক্ষণ কি আপনার চুল দিয়ে দাঁত মাজব?’— এই বিস্ময়সূচক প্রশ্নের প্রেক্ষাপট— শিয়ালদহ মেন লাইনের এক ডাউন লোকাল। কামরার দরজার দু’পাশে দাঁড়িয়ে কয়েকজন। চিঁড়েচ্যাপ্টা ভিড়ে সামনের স্টেশনে নামতে প্রবল গুঁতোগুঁতি। এমন সময়ে সামনের লম্বা ভদ্রলোকটির কাছে পিছন থেকে প্রশ্ন, ‘নামবেন তো?’ উত্তর, ‘না পরেরটায়’। এর পরেই ওই ‘বিস্ময়সূচক প্রশ্ন’। কারণ, সামনের ভদ্রলোকের মাথার লম্বা চুল সুড়সুড়ি দিচ্ছে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটির কপালে!
সেই প্রশ্নকর্তার দিকেও কয়েক মিনিটের মধ্যেই ধেয়ে এল মন্তব্য। ‘দাদা, ব্যাগে কি তিনটে টিফিন?’ ভদ্রলোকের ‘অপরাধ’, পিঠে একটি বেশ পুষ্ট ব্যাগ নিয়ে সহযাত্রীদের দাঁড়ানোর জায়গা কেড়ে নিচ্ছেন।
এত সব কথার পিঠে কথার মাঝেই, কামরার শেষ প্রান্তে শোরগোল। তিন জনের সিটে চার জন বসাই লোকাল ট্রেনের দস্তুর। সিটের চতুর্থ জন, জানলার ধারে বসা লোকটিকে বলছেন, ‘দাদা একটু চাপুন’। তক্ষুনি উত্তর, ‘পা-টা কি কেটে আনব না কি হাতে ধরব? এত খান কেন?’ খাওয়া নিয়ে খোঁটায় চতুর্থ জনের বেশ আঁতে লেগেছে। এর মধ্যেই কিঞ্চিৎ কর্কশ গলায় এক জন বললেন, ‘পা তুলে দেব...’ শুনে রাগ গলে জল। আসলে তো চলে এসেছে ‘পাতিলেবু’, খান চার-পাঁচ নেওয়া দরকার! কামরার মাঝামাঝি খবরকাগজ উদ্ধৃত করে তখন দেশ ও দশের পরিস্থিতি নিয়ে তীব্র বাদানুবাদ চলছে নিত্যযাত্রীদের মধ্যে। এক পক্ষ এঁটে উঠতে না পেরে বলল, ‘ভজনদা আজকাল তিনে থাকছে। এখেনে থাকলে বুঝতি।’ তিনে মানে, তিন নম্বর কামরায়।
হাওড়া ও শিয়ালদা থেকে লোকাল ট্রেন চালু হয়েছে দিন কুড়ি হল। ‘ভিড় হচ্ছে’, ‘ভিড় একই রকম হচ্ছে’, ‘না তো ভিড় কোথায়’— নানা মত ও তর্ক ভাসছে। শহরতলি বা আরও দূরের লোকাল ট্রেন শিয়ালদায় এসে থামতে সেই হুড়োহুড়ি করে নামার চেনা দৃশ্য, তফাত বলতে যাত্রীদের মুখ ঢাকা মাস্কে। শিয়ালদায় টিকিট কাউন্টারের সামনে সাদা গোল্লা, হাতে সময় থাকলে নিয়ম মেনেই যাত্রীরা দাঁড়িয়ে আছেন সেখানে (ছবিতে), চোখে পড়ছে তাও।
এত সব কিছুর পরেও, প্রাক-করোনা জীবনের নানা রঙে ভরে থাকা লোকাল ট্রেনযাত্রার স্মৃতিতেই ফিরতে চাওয়া। কবে সব স্বাভাবিক হবে? প্ল্যাটফর্মে, ট্রেনে হকাররা নেই, নেই চা খাওয়া, বেছেবুছে কলা-কমলা, ছোলাভাজা, চালের পাঁপড়, চুলের কাঁটা, খেলনা কেনা। অনেক হকারই পেশা পাল্টাতে বাধ্য হয়েছেন। স্টেশনের চা-দোকানে বয়স্কদের আড্ডাও অতীত। ভাইরাস-ভয়ে ভিড়ের মধ্যে নাকমুখ ঢেকে, হাতে স্যানিটাইজ়ার ঘষতে ঘষতে মনে পড়ে যায় পুরনো রুটিন: ‘চারটে বাইশ তো? ভেন্ডরের পরেরটা...’