এই যে এখানে এত সাধু দেখছ, এঁরা কেন এসেছেন জানো? ভক্তের জন্য। আমাদের কাছে ভক্তই ভগবান। ভক্ত না থাকলে আমাদের কোনও মূল্য নেই। তাদের জন্যই এই সাজসজ্জা।”— হু-হু দুপুরে বাবুঘাটে গঙ্গাসাগর ট্রানজ়িট শিবিরে বসে বলছিলেন বাঙালি সাধু ‘শনি মহারাজ’। চল্লিশ বছর ধরে আসছেন মেলায়, কঠিন দুর্গম যাত্রাপথ থেকে ক্রমে সুগম হওয়া গঙ্গাসাগর-তীর্থযাত্রার সাক্ষী তিনি।
গঙ্গাসাগর যাত্রীদের জন্য সরকারি উদ্যোগে বাবুঘাটের এই শিবিরে থাকে জল, স্বাস্থ্য, যাত্রা সংক্রান্ত তথ্য সরবরাহ-সহ নানা পরিষেবা। সারা ভারত থেকে আসা পুণ্যার্থীদের সঙ্গে সাধুরাও খানিক জিরিয়ে নেন ক্যাম্পে। ভক্ত সমাগম, আলোকচিত্রীদের ভিড়। কোনও সাধু সারা গায়ে ছাই মেখে গঞ্জিকাসেবনে ব্যস্ত, কেউ ধুনি জ্বালিয়ে মগ্ন হোমে। ভক্তদের সঙ্গে আলোচনারত কেউ, কেউ খবরকাগজে দেখেন ইহজগতের কারবার (ছবিতে)। বাবুঘাটের ক্যাম্প শীতের কলকাতার দৃশ্যপটের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
গঙ্গাসাগর তীর্থে আসা নাথ সম্প্রদায়ভুক্তরা ভক্তেরা দর্শন করে আসেন বাগুইআটি-অর্জুনপুর এলাকার প্রাচীন গোরক্ষবাসী মন্দির। নাথ সম্প্রদায় যে দ্বাদশ পন্থ বা শাখায় বিভক্ত, তার মধ্যে একটির প্রবক্তা কপিলনাথ। এই ‘কপিলানি’ পন্থের প্রধান স্থান এই মন্দির, আর এ শহরও তাই এই যাত্রীদের কাছে তীর্থস্বরূপ। কলকাতার সঙ্গে গঙ্গাসাগরের সম্পর্ক বহু পুরনো। সেই কবে রূপচাঁদ পক্ষী বলে গেছেন, “ধন্যধন্য কলিকাতা সহর, স্বর্গের জ্যেষ্ঠ সহোদর।/ পশ্চিমে জাহ্নবী দেবী দক্ষিণে গঙ্গাসাগর।” গঙ্গাসাগর দ্বীপে জঙ্গল কেটে আবাদ স্থাপনের জন্য উনিশ শতকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মসূচিতে শামিল হয়েছিলেন শোভাবাজারের মহারাজা নবকৃষ্ণ দেবের পুত্র গোপীমোহন দেব, পাথুরিয়াঘাটার দর্পনারায়ণ ঠাকুরের পুত্র হরিমোহন ঠাকুর ও রামদুলাল দে-র মতো সে কালের কলকাতার বিশিষ্টজনেরা।
পৌষ মাস বাংলায় ফসল ঘরে তোলার সময়। পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে সে কারণেই এত মেলার আয়োজন এই ভূমে, যা একই সঙ্গে বাণিজ্যিক ও সামাজিক সম্মিলন। গঙ্গাসাগর মেলার কলকাতা ট্রানজ়িট শিবির হয়ে ওঠে নানা ধর্মাবলম্বী মানুষের আশ্রয়। এসেছেন আবদুল সাপুড়িয়া, ভাল নাম আইসুতুল্লাহ শেখ। বিশ্বাস ও বিজ্ঞানের মাঝে আলো-আঁধারি পরিসরে কারবার তাঁর, সব ধর্মের মানুষ তার ‘পেশেন্ট’। জড়িবুটির সঙ্গে মন্ত্র-ঝাড়ফুঁক মিশিয়ে মানুষের নানা সমস্যা সমাধানের দাবি করেন সগর্বে।
বাবুঘাটের ক্যাম্পে হচ্ছে কোভিড পরীক্ষাও, সেই নিয়ে একটু বিচলিত সাধু থেকে পুণ্যার্থীরা। অতিমারিতে ভক্তসমাগম এ বছর বেশি হবে না, মত অনেকের। পরিবহণ এখনও পুরোপুরি স্বাভাবিক নয়, উত্তর ও পশ্চিম ভারতের অনেক তীর্থযাত্রী হয়তো থাকবেন না মেলায়। মেলা নিয়ে হাইকোর্টের চূড়ান্ত রায় বাকি এখনও, কথা চলছে ই-স্নান, ই-দর্শন নিয়ে। গঙ্গাসাগর যাত্রাপথের অন্যতম বিন্দু হিসেবে কলকাতার বহমান ঐতিহ্যে এ বছরটা হয়তো ইতিহাসে ব্যতিক্রমী হয়ে থাকবে। ছবি: তথাগত সিকদার
বহে নিরন্তর
শান্তিনিকেতনে সঙ্গীত ভবনে ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হতে গিয়ে থার্ড ইয়ারে ভর্তি হলেন সুবিনয় রায় (১৯২১-২০০৪) (ছবিতে)। পরীক্ষক ছিলেন শান্তিদেব ঘোষ! ‘উত্তরায়ণ’ বাড়িতে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কাছে গান শিখেছেন, পাশে এস্রাজ সঙ্গতে শৈলজারঞ্জন মজুমদার। রবীন্দ্রনাথের গান শান্তি পেয়েছে সুবিনয় রায়ের গলায়, তাঁর কণ্ঠকে রবীন্দ্রগানের ‘যোগ্য বাহন’ বলেছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। এমনকি পঙ্কজ মল্লিককেও রবীন্দ্রনাথের গান শিখিয়েছেন তরুণ সুবিনয়, আর পরিণত বয়সে কয়েক দশক ধরে তাঁর গায়ক ও প্রশিক্ষক সত্তা আশ্রয় ও আশ্বাস জুগিয়েছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের উত্তরাধিকারকে। উচ্চাঙ্গ তথা রাগসঙ্গীতেও রীতিমতো তালিম ছিল, গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তী, রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুখেন্দু গোস্বামীর মতো সুরসাধকেরা ছিলেন সে পথ-পরিক্রমায় তাঁর গুরু। লিখেছেন রবীন্দ্রসংগীতসাধনা-র মতো বই, জোর দিতেন রবীন্দ্রনাথের গানে নির্ভুল উচ্চারণ ও সুরপ্রয়োগ, বাণীর অন্তঃস্থ ভাবকে উপলব্ধির প্রয়োজনীয়তা। এ বছর তাঁর জন্মশতবর্ষ, আর গত ৯ জানুয়ারি ছিল তাঁর প্রয়াণদিন। তাঁর স্মরণে ৯-১২ জানুয়ারি চার দিন ব্যাপী আন্তর্জালিক অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে কলকাতার সাংস্কৃতিক সংস্থা ‘নান্দনিক’। সঙ্গীত-অর্ঘ্য দিনভর সংস্থার ফেসবুক পেজে।
গ্লোবায়ন
‘গ্লোবায়ন’? আশ্চর্য একটা শব্দ। শুনতে ভালই, অর্থেও একটা বিশেষত্ব আছে। বিশ্বায়নের থেকে অনেকটা ফারাক। ইংরেজি ‘গ্লোব’-এর উপস্থিতি যেন মনে করিয়ে দেয়, ‘গ্লোবালাইজ়েশন’ মানে সত্যিই ‘বিশ্বায়ন’ নয়, একটা বিশেষ ইংরেজিমাফিক বিশ্বের প্রসার, প্রচার, প্রতিপত্তি। কথাটা প্রথম বলেছিলেন কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, ফের সেটা বুঝিয়ে দিলেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তী। গত ৭ জানুয়ারি ‘গ্লোবায়ন ও ইতিহাস-চর্চা: দেশেবিদেশে’ এই নামে তাঁর ভাবনা শোনা গেল প্রয়াত ইতিহাসবিদ সব্যসাচী ভট্টাচার্যের নামাঙ্কিত বক্তৃতায়, পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ ও এশিয়াটিক সোসাইটি-র আয়োজনে। গ্লোবায়ন-সূত্রে বিশ্বময় একীকরণের দিকে বিশ-একুশ শতকের দুনিয়ার অমোঘ যাত্রা, তার প্রেক্ষাপটে ইতিহাস-চর্চার চ্যালেঞ্জটাই পাল্টে যাচ্ছে, বোঝালেন বক্তা। ইতিহাস মানেই কনটেক্সট বা প্রেক্ষিতের মধ্যে কিছু বোঝার চেষ্টা, এই কনটেক্সট-এর বোধ কী ভাবে পাল্টাচ্ছে, ইতিহাস-দার্শনিকের কাছে তা জরুরি ভাবনা। তাঁর শিক্ষক, বহু-সম্মানধন্য অধ্যাপক সব্যসাচী ভট্টাচার্যের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এর থেকে যোগ্যতর বিষয় আর কিছু হতে পারত কি?
সাঙ্গীতিক
“যাঁরা বোঝেন, তাঁদের কাছে ওটি সবচেয়ে বড় উপাসনা,” সঙ্গীত সম্পর্কে বলেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। ব্রাহ্ম সমাজের অনুষ্ঠান থেকে দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের ঘর, বেলুড় মঠে জীবনের শেষ দিনটিতেও তাঁর সঙ্গী ছিল গান। ভালবাসতেন, নিজেও গাইতেন ধ্রুপদ। তাঁর জন্মদিনে প্রতি বছর মার্গ সঙ্গীতের অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার, গোলপার্ক। বিবেকানন্দ হল-এ দিনব্যাপী সেই অনুষ্ঠানের অপেক্ষায় থাকেন এ শহরের সঙ্গীতপ্রেমী মানুষ, প্রবেশপত্রের চাহিদা থাকে তুঙ্গে। করোনাকালে এ বারের ‘স্বামী বিবেকানন্দ মিউজ়িক ফেস্টিভ্যাল’ আন্তর্জালিক, দেখা যাবে ইনস্টিটিউটের ইউটিউব চ্যানেল ‘আরএমআইসি গোলপার্ক’-এ। আগামী কাল ১২ জানুয়ারি সকাল ১০টা থেকে কণ্ঠসঙ্গীত, সরোদ, সন্তুর, তবলাবাদন— ওঙ্কার দাদারকর, পণ্ডিত তেজেন্দ্র নারায়ণ মজুমদার, পণ্ডিত তরুণ ভট্টাচার্য, পণ্ডিত কুমার বসু, পণ্ডিত শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও সহশিল্পীদের পরিবেশনায়।
বিস্মৃতপ্রায়
ক্ষিতিমোহন সেনের ভ্রাতুষ্পুত্র, মেধাবী কিশোরটিকে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে আশ্রমে ভর্তি হতে আহ্বান করেছিলেন, কিন্তু বিক্রমপুরের সোনারং গ্রামের সত্যেন সেন (১৯০৭-১৯৮১) (ছবিতে) উত্তর দিয়েছিলেন: “আমি কৃষকদের মুক্তির জন্য কাজ করতে চাই।” আজীবন এ-ই ছিল তাঁর সংগ্রামী ব্রত। কিছু দিন ব্রিটিশ-বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামে যুক্ত থাকলেও অচিরেই যোগ দেন মার্ক্সবাদী রাজনীতিতে। কমিউনিস্ট আন্দোলন প্রসারে ও কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে চষে বেড়াতেন পূর্ববঙ্গ— ঢাকা, নরসিংদী, বগুড়া, রংপুর। জীবনের একটা বড় সময় কেটেছে কারাগারে, পরিণত বয়সে মগ্ন হয়েছেন অক্লান্ত সাহিত্যকর্মে। দুই দশকে গ্রন্থের সংখ্যা কমবেশি বিয়াল্লিশ। প্রথম বইটি উপন্যাস— ভোরের বিহঙ্গ, এ ছাড়াও লিখেছেন মহাবিদ্রোহের কাহিনী, গ্রামবাংলার পথে পথে, ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের কথা, প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ বই। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী’-র কর্মীরা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেছিলেন। সত্যেন সেন রচিত ও সুরারোপিত বহু গণসঙ্গীত আজও বাংলাদেশের মানুষের কাছে ‘মুক্তির গান’। অকৃতদার, চোখের আলো প্রায় হারাতে বসা মানুষটির জীবনের শেষ আট বছর কেটেছিল শান্তিনিকেতনে, দিদি প্রতিভা সেনের কাছে। গত ৫ জানুয়ারি তাঁর প্রয়াণের চার দশক পূর্ণ হল, কিন্তু এ পারের বাঙালি তাঁকে স্মরণ করা দূরস্থান, ভাল ভাবে জানলেন কই!
নাটকের বই
২০১১ সালে পথ চলা শুরু ভাবনা থিয়েটার পত্রিকার (সম্পাদক: অভীক ভট্টাচার্য), গত দশ বছর ধরে বঙ্গ ও বিশ্ব থিয়েটারের নিবিড় পর্যবেক্ষণ নিংড়ে নিয়মিত নাট্যপত্র প্রকাশ করে এসেছেন ওঁরা। আর এক ধাপ এগিয়ে এ বার শুরু হয়েছে প্রকাশনা বিভাগ বিয়ন্ড গ্রিনরুম পাবলিকেশনস। বছর-শুরুর নান্দীমুখ হিসেবে গত ৮ জানুয়ারি সন্ধেয় দমদমের থিয়েঅ্যাপেক্স-এ এক অনুষ্ঠানে প্রকাশিত হল নাটক সংক্রান্ত দু’টি বই— আশিস গোস্বামীর থিয়েটার: ভিন্ন পরিসরে এবং অভীক ভট্টাচার্যের তিন নাট্য বৈঠক। প্রথম বইটি পরিচয় করিয়ে দেয় বাদল সরকার, হেইসনাম কানহাইলাল, প্রবীর গুহ, গৌতম সেনগুপ্ত, সুবোধ পট্টনায়ক, অবনী বিশ্বাসের মতো নাট্যভাবুকদের বিকল্প থিয়েটার-পরিসর নিয়ে কাজের সঙ্গে, আর দ্বিতীয় বইটি গত কয়েক বছরে অভীকের দেওয়া থিয়েটার বিষয়ক স্মারক বক্তৃতাত্রয়ীর প্রবন্ধরূপ। ইলাহাবাদের ‘ব্যাকস্টেজ’ নাট্যদলের নির্দেশক প্রবীণ শেখর উদ্যোক্তাদের ডাকে এসেছিলেন প্রিয় শহর কলকাতায়, বললেন আজকের সময়ের হিন্দি নাট্যচর্চার অভিমুখ নিয়ে। ছিলেন এই প্রজন্মের থিয়েটারকর্মী, নির্দেশক, নাট্য-সমালোচক— সকলের প্রাণের কথা, সমসময় ও থিয়েটার নিয়ে এমন চর্চা দীর্ঘজীবী হোক।
প্রতিদ্বন্দ্বী ৫০
প্রতিদ্বন্দ্বী ছবিতে গল্প বলার ঢঙে এত দিন অনুসৃত ফিল্ম তৈরির ঘরানা থেকে যেন সরে এসেছিলেন সত্যজিৎ রায়, মত ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়ের। এই ছবিতে অনেকটাই তথ্যচিত্রের মেজাজ। ষাট ও সত্তর দশকের সন্ধিক্ষণের উত্তাল কলকাতাকেই পর্দায় তুলে এনেছিলেন পরিচালক। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে তৈরি এই ছবি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭০-এর অক্টোবরে, পঞ্চাশে পা দিল সত্যজিতের ‘কলকাতা ট্রিলজি’-র প্রথম এই ছবি (ছবিতে তার পোস্টার)। এই উপলক্ষে সত্যজিৎ রায় ফিল্ম সোসাইটি বেঙ্গালুরু ও দ্য সোসাইটি ফর প্রিজ়ার্ভেশন অব সত্যজিৎ রায় ফিল্মস-এর যৌথ উদ্যোগে গত ২৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় হয়ে গেল এক আন্তর্জালিক বৈঠক। সন্দীপ রায়ের সঙ্গে ছিলেন বিশিষ্ট অভিনেতা ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়, টিন্নু আনন্দ ও কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়, গ্রন্থনায় ঋদ্ধি গোস্বামী। সত্যজিতের সে সময়ের সহকারী টিন্নু জানালেন, নকশাল আমলে তিনিও পুলিশের বেয়নেটের সামনে পড়েছিলেন। ‘‘সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজ করি,” জানিয়ে ও প্রমাণ দিয়ে নিস্তার পাওয়া গিয়েছিল। সে সময়ে কলকাতার রাস্তায় শুটিং করা ছিল সহজ, আরামের— বললেন সন্দীপ রায়। শুটিংকালীন তোলা নানা আলোকচিত্র ও তার সঙ্গের গল্প, ছবির নির্মাণশৈলী ও পর্দার আড়ালের কাহিনিও উঠে এল স্মৃতিচারণে।
কলকাতা এক্সপ্রেস
সোফি ক্যুজ়িনিয়ে ফ্রান্সের চিত্রশিল্পী। ‘ইন্দো-ইউরোপিয়ান রেসিডেন্সি কলকাতা প্রজেক্ট’-এর সুবাদে এ শহরের সঙ্গে তাঁর যোগ ২০১৯ সাল থেকে। এই ‘রেসিডেন্সি প্রজেক্ট’-এ শিল্পী তাঁর পরিচিত বৃত্তের বাইরে নতুন জগৎ, নতুন সংস্কৃতিকে নিয়ে কাজ করেন। সেই সূত্রেই সোফি ভালবেসে ফেলেছেন কলকাতাকে। অতিমারির সময়েও সেই টান অটুট, ডিজিটাল মাধ্যমে আবার কলকাতায় ফিরেছেন তিনি। আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দু বেঙ্গল ও ফ্রেঞ্চ ইনস্টিটিউট ইন ইন্ডিয়া-র যৌথ উদ্যোগে চলছে সোফির একক ডিজিটাল কাজ ‘কলকাতা এক্সপ্রেস’। শুরু হয়েছে গত ১০ ডিসেম্বর, চলবে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত। এই পর্বে সোফি রং-তুলি কাগজে কখনও ফুটিয়ে তুলছেন কলকাতার ব্যস্ততা, ছুট লাগানো অটো-ট্যাক্সি, কখনও বা দালানে দুষ্টুমি করে বেড়ানো খুদেকে। সম্প্রতি ‘কোল ব্যাক’ শিরোনামের কর্মশালায় এক সন্ধেয় ঘণ্টা দেড়েকের পর্বে সোফির অনবদ্য আঁকা দেখা আর শেখাও গেল। পরের কর্মশালা আগামী কাল, সন্ধে ৭টা থেকে। ফরাসি শিল্পীর কলকাতা-চিত্রকথকতার স্বাদ পেতে আগ্রহীজন নাম লেখাতে পারেন আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ-এর ফেসবুক পেজে।
যতই কালো হোক
কলকাতায় বসে আফ্রো-আমেরিকান চিত্রশিল্পের অভিজ্ঞতা? সুযোগ করে দিচ্ছে কলকাতার ‘এমামি আর্ট’-এর প্রদর্শনী ‘নেগ্রিচিউড’। আমেরিকার ‘হিস্টোরিক্যাল ব্ল্যাক কলেজেস অ্যান্ড ইউনিভার্সিটিজ়’-এর অঙ্গাঙ্গি শিল্পী-সংগঠন ‘ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স অব আর্টিস্টস’ আয়োজিত ‘ব্ল্যাক আর্ট’-এর এই ভ্রাম্যমাণ প্রদর্শনী ঘুরছে নানা দেশ ও শহর, বিশিষ্ট আফ্রিকান-আমেরিকান শিল্পীদের কাজের সঙ্গে শিল্পরসিকদের পরিচয় করাতে। এই অভিজ্ঞতা ঐতিহাসিকও, কারণ এখানে দেখা যাবে বিগত আট-নয় দশকের শিল্পকৃতি, বোঝা যাবে বিশ ও একুশ শতকে রাজনীতি ও সমাজের বাঁক-বদল কী করে এসে মিশেছে ব্ল্যাক শিল্পীদের ছবিতে। আছে হারলেম রেনেসঁাস ও ১৯৫০-৬০’এর দশকের ব্ল্যাক মুভমেন্ট-এর সময়কার শিল্পীদের কাজ; আলমা উডসি টমাস, এলিজ়াবেথ ক্যাটলেট, ক্লদ ক্লার্ক, আল হলিংসওয়র্থ, জ্যাকব লরেন্স, বেনি অ্যান্ড্রুজ়, ভার্নেটা হানিউড-এর মতো স্মরণীয় শিল্পীদের আঁকা ছবি। এই সব ছবিই এখন আমেরিকার বিভিন্ন শিল্প সংগ্রাহক, গ্যালারি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রহে, কলকাতার ছবিপ্রেমীদের দেখার অমূল্য ও সুবর্ণ সুযোগ। কিউরেটর পেগি ব্লাড ও নীতা ওমপ্রকাশের সযত্ন প্রয়াসে সাজানো এই প্রদর্শনী দেখা যাবে ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত, সকাল ১১টা থেকে সন্ধে ৭টা, এমামি আর্ট প্রদর্শনীকক্ষে, এবং সংস্থার ওয়েবসাইটেও। ছবিতে ১৯৪৩ সালে ক্লদ ক্লার্ক-এর জলরঙে আঁকা ছবি ফ্রিডং মর্নিং।
সংক্রান্তিলক্ষ্মী
বনেদি কলকাতার শহুরে কেতার নীচে আজও নানা রূপে বহতা গ্রামীণ আত্মপরিচয়ের ফল্গুধারা। বাংলার শীত-উৎসবের পরিচয় করাতে গিয়ে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, “অঘ্রাণে নবান্ন দেয় নতুন ধান কেটে, পৌষ মাসে বাউনী বাঁধে ঘরে ঘরে পিঠে।” পৌষ সংক্রান্তি সমাগত, নতুন ধান ওঠার কৃষিভিত্তিক লোকাচার আজও পালিত হয় শহরের বনেদি পরিবারে। লক্ষ্মীকে পুজোয় তুষ্ট করে বাড়িতে বেঁধে রাখতে পৌষ সংক্রান্তির আগের দিন ধানের শিস বা খড় ও আমপাতা দিয়ে ধানের মড়াই, সিন্দুক ইত্যাদি দিয়ে ‘বাউনি বাঁধা’ প্রথা আজও পালিত হয় শোভাবাজার রাজবাড়িতে, জানালেন অলককৃষ্ণ দেবের স্ত্রী নন্দিনী দেব। সংক্রান্তি ও তার আগে-পরে মিলিয়ে তিন দিন আসকে পিঠে বানিয়ে তিনটি সরার মধ্যে সেই পিঠে আর বাউনি রেখে আসা হয় ঠাকুরঘরে। ছড়া কাটা হয় “আওনি বাওনি চাওনি/ তিন দিন পিঠা খাওনি।” যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি এই ছড়ার অর্থ করেছেন, গৃহে লক্ষ্মীর আগমন ও বন্ধন হয়েছে, এ বার চাহনি (প্রার্থনা), তিনি গৃহে চিরদিন থাকুন। আচার সম্পূর্ণ হয় সেদ্ধ পিঠে, পাটিসাপটা, মুগডালের ভাজা পিঠে, গোকুল পিঠে, রসবড়া, রাঙা আলুর পিঠে, সরুচাকলি তৈরিতে। আগে বাউনি বাঁধার সরঞ্জাম আসত নিজেদের খেত থেকে, এখন আস্থা বাজারের কেনা উপকরণেই।
পট্ট নাট্যমেলা
এশিয়ার প্রথম জুট মিল গড়ে উঠেছিল কলকাতার কাছে রিষড়ায়, ১৮৫৫ সালে। উনিশ শতকীয় বঙ্গের শিল্প-বাণিজ্যের ইতিহাসে তা ছিল গুরুত্বপূর্ণ এক ঘটনা। কালে পাটশিল্পকেন্দ্রিক অর্থনীতি ক্ষীয়মাণ হয়েছে, কিন্তু অতীতের সেই গর্ব ও স্মৃতিকে মনে করিয়ে দিতে নাট্যদল ‘রিষড়া দূরায়ন’ আয়োজন করেছে অভিনব ‘পট্ট নাট্যমেলা ২০২১’। ১৩-২০ জানুয়ারি আট দিনে আটটি নাটক দেখা যাবে ওঁদের ইউটিউব চ্যানেলে, রোজ সন্ধে ৭টায়। আছে লন্ডনের ‘মুকুল অ্যান্ড ঘেটো টাইগার্স’ দলের নাটক রোমিয়ো অ্যান্ড জুলিয়েট, ঢাকার ‘স্বপ্নদল’-এর হরগজ, কেরলের ‘লোকধর্মী থিয়েটার’-এর শকুন্তলা, এ ছাড়াও সিওল, ত্রিপুরা, পাবনা, কলকাতার নাটক। উৎসবের জন্য গান বেঁধেছেন, পটচিত্র এঁকেছেন দলের সদস্যেরা, হবে ‘পাটের কথা পটের গান’। আছে ছোটদের জন্য নাটকের কর্মশালা, ১৮-২০ জানুয়ারি দুপুর ৩টেয় ‘দুপুরের ফোর্থ ওয়াল’ শিরোনামে তিনটি ছোট নিরীক্ষাধর্মী নাটক, ২১ তারিখে ‘ভার্চুয়াল থিয়েটার’ নিয়ে বিতর্কসভা।
পূর্ব-পশ্চিম
নাটক ফিরেছে শহরের মঞ্চে, বেশ কিছু দিনই। অতিমারিতে কোণঠাসা গত বছরে থেমে থাকেনি থিয়েটার নিয়ে চর্চা ও লেখালিখি, প্রমাণ নতুন বছর শুরুর মুখে নাট্যপত্রগুলি। সেই ধারাতেই নবতম সংযোজন ‘পূর্ব পশ্চিম’-এর বার্ষিক নাট্যপত্র ১৪২৭ (সম্পাদক: অনুপ বন্দ্যোপাধ্যায়)— যার কেন্দ্রকথা ‘শূন্যতা’। ২০২০ কেড়ে নিয়েছে যে সারস্বতদের, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধায় নিবেদিত একগুচ্ছ লেখা। কনস্তানতিন স্তানিস্লাভস্কির অভিনয়শৈলী ও তত্ত্ব নিয়ে স্টেলা অ্যাডলার-এর বিখ্যাত ও দীর্ঘ প্রবন্ধের প্রস্তাবনা-সহ সটীক অনুবাদ ব্রাত্য বসুর, মেঘনাদ ভট্টাচার্যের কলমে ব্রডওয়ে-দর্শনস্মৃতি, ফরাসি নাট্যকার ফ্লোরিয়ান জেলার-এর নাটকের ক্রিস্টোফার হ্যাম্পটন-কৃত ইংরেজি তরজমা-ফেরতা রূপান্তর সৌম্য সেনগুপ্তের— ঝড়ের চুড়োয়। আছে উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়ের নাটক, গদ্য ও প্রবন্ধ লিখেছেন অশোক মুখোপাধ্যায়, সৌমিত্র মিত্র, আসাদুজ্জামান নুর, গৌতম হালদার, সুমন মুখোপাধ্যায়, অভীক মজুমদার-সহ বিশিষ্টজন। প্রচ্ছদ ও নামলিপি হিরণ মিত্রের।
পাতায় পাতায়
লাইব্রেরিতে কোলকুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে বইপত্র ঘাঁটছেন, ফরাসি দেশের সর্বোচ্চ সম্মান হাতে নিচ্ছেন অনুষ্ঠানে, নিজের কবিতাসমগ্র তুলে দিচ্ছেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের হাতে, কখনও একাকী নির্জন চিন্তামগ্ন, কখনও আবার পাইপ মুখে (ছবিতে), সহাস্যে সস্ত্রীক... নতুন বছরের ক্যালেন্ডারের বারোটি পাতায় যেন জীবন্ত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এই প্রয়াস তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের, সম্পাদক অরিজিৎ মৈত্র জানালেন “তিনি এখন সময়-সাল-তারিখের উর্ধ্বে, তবু তাঁর উজ্জ্বল স্মৃতি আমাদের মনে ধরে রাখতেই এই ক্যালেন্ডার।” আছে শর্মিলা ঠাকুর ও যোগেন চৌধুরীর বয়ানও। সম্প্রতি সৌমিত্রর বাসভবনেই ক্যালেন্ডারটির আনুষ্ঠানিক প্রকাশ করলেন স্ত্রী দীপা ও পুত্র সৌগত। অন্য দিকে, বেহালার বি টেক পড়ুয়া অগ্নিভ চক্রবর্তী নতুন বছরের ক্যালেন্ডার তৈরি করেছেন সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার নামলিপি দিয়ে। অপরাজিত থেকে দেবী, জলসাঘর, ঘরে বাইরে, মহানগর, সোনার কেল্লা, গণশত্রু-সহ শিল্পী সত্যজিতের অনবদ্য ক্যালিগ্রাফির নিদর্শন এক-একটি পাতায়। তরুণ সত্যজিৎপ্রেমীর এই শ্রদ্ধার্ঘ্য হাতে পেয়ে খুশি সন্দীপ রায়ও।
খাদ্য যখন শিল্প
কৃষি বিল ও কৃষক আন্দোলন নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে, শহুরে হাওয়ায় সকলে ভুলতে বসেছিল চাষ, চাষি ও নিজেদের অতীত। মকরসংক্রান্তি আসছে, বেহালা সরশুনার শিল্পী সমবায় ‘চাঁদের হাট’ সেজে উঠেছে নতুন ধান, সুগন্ধী চাল ও হারিয়ে যাওয়া রান্নার মৌতাতে। ‘চাঁদের হাট’, ‘শেলটার প্রমোশন কাউন্সিল’ ও ‘ফুড স্টুডিয়ো’-র উদ্যোগে স্থানীয় জীবন নির্ভর শিল্প প্রকল্প ‘চাষ-বাস’ শুরু হয়েছে চাঁদের হাট প্রাঙ্গণে, ৯-১৪ জানুয়ারি আছে নানা অনুষ্ঠান, মাস্টারক্লাস। কর্মশালায় শেখানো হচ্ছে নানা প্রকার মাটির উনুন, বড়ি, পাঁপড় তৈরি, হারিয়ে যাওয়া রান্না, গঙ্গাজলি, অন্নদাসুন্দরী ও চিংড়ি পিঠা। প্রতি সন্ধেয় ফুড অ্যানথ্রপলজি, ফুড অ্যাপ্রিশিয়েশনের পাঠ, বিশেষজ্ঞেরা জানাবেন চাষবাসের ঐতিহাসিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট। শিল্পীদের সঙ্গে শিল্পকর্মে মাতবেন ফুড ডিজাইনাররা। সমকালীন আধুনিক শিল্পীদের নিরীক্ষাধর্মী কাজ দেখা যাবে ১৪ জানুয়ারি চাঁদের হাট প্রাঙ্গণে, বিকেল ৩টে থেকে সন্ধে ৭টা। প্রদর্শনী সকলের জন্য উন্মুক্ত। কেবল দেখা ও শোনা নয়, থাকছে ‘শিল্পকর্ম’ চেখে দেখারও অভিনব বন্দোবস্ত।
আজও অমলিন
জীবৎকাল মাত্র বাইশ বছর। মৃত্যুর পর পেরিয়ে গিয়েছে আরও ১৯০। তবু প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের মুখে আজও ধ্বনিত হয় তাঁর উত্তরাধিকারের কথা। প্রগতিশীল চিন্তাবিদ তথা তৎকালীন ‘হিন্দু কলেজ’-এর শিক্ষক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজ়িয়ো বাঙালি যুবকদের মধ্যে যুক্তিবাদিতা ও বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরির চেষ্টা করেছিলেন। ধর্ম নিয়ে তাঁর খোলামেলা আলোচনা পছন্দ হয়নি সে যুগের রক্ষণশীল অভিভাবকদের, চাকরি হারান ডিরোজ়িয়ো। গত ২৮ ডিসেম্বর এক আন্তর্জালিক আলোচনায় এই নিয়ে বললেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায়। শিরোনাম ‘দ্য স্যাকিং অব আ টিচার: অ্যান অ্যানাল অব আর্লি ক্যালকাটা’। আয়োজনে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের স্নাতক স্তরের এক দল ছাত্রের তৈরি মঞ্চ ‘কারওয়াঁ: দ্য হেরিটেজ এক্সপ্লোরেশন ইনিশিয়েটিভ’। ওদের ফেসবুক পেজে শোনা যাবে বক্তৃতাটি।
ই-স্কুল
‘‘ভার্চুয়াল-এর বাংলা তা হলে আর কিছু হল না? সব কিছুর আগে ই বসিয়েই চালিয়ে নিতে হবে? শেষ পর্যন্ত ই-স্নান? অ্যাঁ?’’— সকালবেলায় দু’নম্বর টেবিলে খবরের কাগজের পাতা থেকে মুখ তুলে বিরসবদনে বললেন ভদ্রলোক। অমনি ও-দিকের চার নম্বর টেবিল থেকে জবাব এল, ‘‘তাতে ক্ষতি কী দাদা? এটাই তো বাংলার ঐতিহ্য। সেই কোনকাল থেকে আমরা স্কুল না বলে ইস্কুল বলি, সেটা এক বার ভেবে দেখলেন না?’’
বিলে, নরেন, বিবেকানন্দের শহর
সিমলেপাড়ার ৩ নং গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিট তো তাঁর জন্মস্থান হেতু ঐতিহাসিক হয়ে উঠেছেই, এখন সেখানে দেশ-বিদেশের ভক্ত-অনুরক্তদের আনাগোনা। গোটা উত্তর কলকাতাই ছিল নরেন্দ্রনাথ দত্তের ‘মুলুক’, বললে অত্যুক্তি হয় না। ঢিল ছোড়া দূরত্বে হেদুয়া। রামতনু বসু লেনে তাঁর দিদিমার বাড়ি, েসখানেই ‘টঙের ঘর’-এ তাঁর সবন্ধু দুরন্তপনা, ধ্যান-ধ্যান খেলা। মসজিদবাড়ি স্ট্রিটে অম্বু গুহর কুস্তির আখড়ায় যেতেন, সেকেলে কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে (আজকের বিধান সরণি) নবগোপাল মিত্রের আখড়ায় জিমন্যাস্টিক্স শিখতেও। খিদিরপুর ডকে যুদ্ধজাহাজ ‘সেরাপিস’ ভিড়েছে, অর্বাচীন ভেবে দ্বারবান ভাগিয়ে দিলেও কৌশলে সাহেবি অনুমতিপত্র আদায় করে হতভম্ব রক্ষীকে সকৌতুক জবাব দিয়েছিলেন, ‘‘হম জাদু জানতা।’’ কৈশোরে মেটিয়াবুরুজে নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের পশুশালা দেখেছেন, বাল্যবন্ধুদের নিয়ে হাওয়া খাওয়ার প্রিয় জায়গা ছিল গড়ের মাঠ। ছেলেবেলায় বিদ্যাসাগরের সুকিয়া স্ট্রিটের স্কুলে পড়েছেন, পড়েছেন স্কটিশ চার্চ কলেজে, উত্তরকালে কিছু দিন পড়িয়েছেন বিদ্যাসাগরের মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনেও।
মহেন্দ্র গোস্বামী লেনে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ তাঁর তারুণ্যের ধর্মসন্ধিৎসার সাক্ষী; জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে তো গিয়েছেন বহু বার— মহর্ষির পৌত্র, দ্বিজেন্দ্রনাথ-তনয় দ্বিপেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন তাঁর সহপাঠী, সেই সূত্রে— ঈশ্বর-সন্ধানে মহর্ষির কাছে, সঙ্গীতানুরাগ সূত্রে ও ব্রাহ্ম সমাজের নানা উপলক্ষে রবীন্দ্র-সঙ্গও অনেক বার, পরে নিবেদিতার উপস্থিতিতে ও উদ্যোগেও। নিমতলা শ্মশানেও গেছেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত, কেশবচন্দ্র সেনের মৃত্যুর পর ছিলেন দাহকার্যের পুরো সময়টুকু। বাগবাজার অঞ্চলে বলরাম বসুর বাড়ি (এখন বলরাম মন্দির), গিরিশ ঘোষের বাড়ি, রাজবল্লভ স্ট্রিট তাঁর স্মৃতিময়।
বরানগর, আলমবাজার, শ্যামপুকুর, কাশীপুর তাঁর সাধনজীবন ও রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের সূচনাপর্বের কেন্দ্রচতুষ্টয়। বিশ্বজয়ী বিবেকানন্দের ট্রেন ১৮৯৭-এর ২০ ফেব্রুয়ারি শিয়ালদহ ঢুকল বজবজ থেকে, স্টেশন থেকে রিপন কলেজ (এখন সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) সন্ন্যাসীকে ঘিরে বাঁধভাঙা আবেগের সাক্ষী, ২৮ ফেব্রুয়ারি শোভাবাজার রাজবাড়ির গণসংবর্ধনাসভাও। হাওড়া থেকে ট্রেন ধরেছেন নানা সময়ে। তাঁর পা পড়েছে সে কালের ‘স্টার থিয়েটার’ (তখন বিডন স্ট্রিটে), ‘ক্লাসিক থিয়েটার’-এ। বেলুড় থেকে কলকাতা এলে মঠে ফিরতেন নৌকোয়, আহিরীটোলা ঘাট থেকে। আলিপুর চিড়িয়াখানায় বেড়াতে গিয়ে সুপারিনটেনডেন্ট রামব্রহ্ম সান্যালের সঙ্গে বিবর্তনবাদ নিয়ে তাঁর আলাপের সাক্ষী স্বয়ং নিবেদিতা। ১৯০১-এর শেষ দিকে কালীঘাট মন্দিরে গিয়েছেন গর্ভধারিণী ভুবনেশ্বরী দেবীর ইচ্ছাপূরণের জন্য ‘মানতপূজা’ দিতেও। এই শহর বিলে থেকে নরেন, বিবেকানন্দের শহর। ছবিতে ১২ জানুয়ারি জন্মদিনের আগে তাঁর মূর্তি সংস্কারের কাজ, ২০০৫-এ।