জুলাই, ১৯০৫। বঙ্গভঙ্গের সরকারি সিদ্ধান্তের খবরে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালি ফেটে পড়ল ক্ষোভে, প্রতিবাদে। ১৩ জুলাই কৃষ্ণকুমার মিত্রের সঞ্জীবনী পত্রিকায় ঘোষিত হল ব্রিটিশবিরোধী ‘বয়কট’ প্রসঙ্গ, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ মতিলাল ঘোষ প্রমুখ তার প্রচারে ব্রতী হলেন। শহরে, মফস্সলে, জেলায় জেলায় হল প্রতিবাদসভা। ৭ অগস্ট টাউন হলে সুরেন্দ্রনাথের উদ্যোগে, মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর সভাপতিত্বে হল ঐতিহাসিক প্রতিবাদসভা; কলেজ স্কোয়ার থেকে ছাত্রদের শোভাযাত্রা, ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনিতে মুখরিত কলকাতা। এত মানুষ এলেন যে স্থির হল তিনটি সভা হবে, টাউন হলের উপরে ও নীচে, বেন্টিঙ্কের মূর্তির পাদদেশে। গৃহীত হল প্রস্তাব: বিদেশি পণ্য, বিচারালয়, স্কুল-কলেজ তথা বিদেশি শাসন বর্জন।
২২ সেপ্টেম্বর টাউন হলেই প্রস্তাব হল, বাংলার অচ্ছেদ্য মিলনের প্রতীক হিসেবে একটি মিলনকেন্দ্র গড়া হোক, নাম হোক ‘ফেডারেশন হল’। ২৯৪ আপার সার্কুলার রোডে জমি পাওয়া গেল, ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের দিন ঠিক হল ১৬ অক্টোবর, ১৯০৫ (৩০ আশ্বিন ১৩১২)। এই সেই বিখ্যাত দিন, রাখিবন্ধনের দিন। কলকাতা দেখল গলি থেকে রাজপথ, গঙ্গার ঘাটে বাঙালির মিলনমেলা, হাতে রাখি, কণ্ঠে বন্দে মাতরম্। অপরাহ্ন তিনটেয় ফেডারেশন হলের ভিত্তিপ্রস্তর (ছবিতে ডান দিকে ভিত্তিফলক) স্থাপন অনুষ্ঠানে উপচে পড়ল মানুষ, পঞ্চাশ হাজার জনতার কথা লিখেছিল অমৃতবাজার পত্রিকা। আনন্দমোহন বসু গুরুতর অসুস্থ তখন, তাঁর হাতেই সমাধা হল শুভকাজ, তাঁর লিখিত ভাষণ পড়েছিলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ছিলেন গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় আশুতোষ চৌধুরী এবং অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অনুষ্ঠান শেষে বাগবাজারে পশুপতি বসুর বাড়িতে ঠিক হল: দেশীয় শিল্পের লক্ষ্যে জাতীয় অর্থভান্ডার গড়া হবে। ৭০ হাজার টাকা উঠল, বেশির ভাগই মধ্যবিত্ত ও সাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত দান।
ভগিনী নিবেদিতা ফেডারেশন হলের (ছবিতে বাঁ দিকে) নাম দিয়েছিলেন ‘মিলন মন্দির’। বাঙালির অখণ্ডতা ও মিলনের প্রতীক এই বাড়িটি শতবর্ষ পেরিয়েছে ঢের আগেই, কিন্তু আজকের বাংলা মনে রেখেছে কি তাকে? আর এক ১৬ অক্টোবর সমাগত, এ বছর আনন্দমোহন বসুর জন্মেরও ১৭৫ বছর, ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ পূর্তি— সেই আবহে ফেডারেশন হল সোসাইটি আগামী কাল ১১৮তম প্রতিষ্ঠাদিবস উদ্যাপন করবে নানা কর্মকাণ্ডে। ১৯০৫-এর ঐতিহাসিক শোভাযাত্রার স্মরণে সকাল ১০টায় হবে ‘ঐতিহ্য পদযাত্রা’, বিকাল ৪টায় মিলন ২৯৪/২/১ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোডে মিলন মন্দির সভাকক্ষে অনুষ্ঠান, থাকবেন চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায়, শ্যামল কুমার সেন, শুভাপ্রসন্ন, আন্দালিব ইলিয়াস-সহ বিশিষ্টজন।
ইউলিসিস ১০০
দ্য লিটল রিভিউ জার্নালে ১৯১৮ সালের মার্চ থেকে ১৯২০’র ডিসেম্বর পর্যন্ত ধারাবাহিক ভাবে বেরিয়েছিল জেমস জয়েসের (ছবিতে) উপন্যাস ইউলিসিস, গ্রন্থাকারে ১৯২২-এ। জন্মলগ্ন থেকেই বিতর্কিত, অভিযুক্ত অশ্লীলতার দায়ে, কিন্তু শতবর্ষ পেরিয়ে চর্চিত আজও— ‘প্রলোভনশীল, শ্লেষ প্যারোডি ও ইল্যুশনে পরিপূর্ণ’, লিখেছে ধূসর শহর পত্রিকা (সম্পা: দেবাশিস চক্রবর্তী)। শহরে নতুন এই সাহিত্যপত্রিকা তাদের দ্বিতীয় সংখ্যায় মগ্ন ‘ইউলিসিস ১০০ বছর’ উদ্যাপনে— মুখ্যত অনুবাদের মধ্য দিয়ে। জেমস জয়েসের কবিতা, চিঠি, গল্পের অনুবাদের সঙ্গে ইউলিসিস নিয়ে হোর্হে লুইস বোর্হেস-এর, বিশ্বের জয়েস-বিশেষজ্ঞদেরও ইউলিসিস নিয়ে লেখার তর্জমা, একশো বছর আগে নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ উপন্যাস সম্পর্কে প্রকাশিত প্রবন্ধও বঙ্গানুবাদে। আরও প্রাপ্তি স্যামুয়েল বেকেটের নাট্যানুবাদ: এন্ডগেম— শেষখেলা।
বিশ্ববিদ্যাতীর্থ
কাচের মতো কঠিন মাধ্যমে শিল্প সৃষ্টি করেন শিশির সাহানা। বিশ্বভারতীর শতবর্ষ উপলক্ষে কলাভবনের এই শিক্ষক বেছে নিয়েছেন আর এক মাধ্যম— ফিল্ম। প্রায় কাহিনিচিত্রের দৈর্ঘ্যের একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন তিনি, নাম রবীন্দ্রনাথ অ্যান্ড বিশ্বভারতী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং গান্ধীজির অসহযোগিতা আন্দোলন যখন জাতীয়তাবাদকে চূড়ান্ত আবেগে পরিণত করেছে, সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথ চিন্তা করছেন এক এমন প্রতিষ্ঠানের, যা বিশ্বকে এক নীড় বলে কল্পনা করছে। কত কঠিন ছিল সেই সম্প্রীতি ও সাম্যের যাত্রা, কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পরেও নিজের বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে কত লড়াই করতে হয়েছে প্রতিষ্ঠানকে, তার নিবিড় পরিচয় মেলে এই তথ্যচিত্রে। সম্প্রতি নন্দন-৩ প্রেক্ষাগৃহে বিশেষ প্রদর্শন হল ছবিটির, ‘ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ় অব ইন্ডিয়া’-র (এফএফএসআই) পূর্বাঞ্চলীয় শাখার উদ্যোগে। আর এক চিত্রনির্মাতা শৈবাল মিত্র বললেন ছবির প্রেক্ষাপট, শান্তিনিকেতনের স্মৃতি নিয়েও।
গণিত নিয়ে
১৯৭১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর ইমপ্রুভমেন্ট অব ম্যাথমেটিক্স টিচিং’ (এআইএমটি), স্কুল স্তরে গণিত শিক্ষার উন্নতিকল্পে। স্কুলশিক্ষক ছাড়াও এতে যুক্ত স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, অন্য গণিতানুরাগীরাও। গত পঞ্চাশ বছর ধরে ছাত্রছাত্রীদের গণিতে প্রতিভা অনুসন্ধান পরীক্ষা, নানা প্রকাশনা ও বহু আলোচনাচক্র আয়োজন করেছে এই সংস্থা। ৫১তম প্রতিষ্ঠাদিবসে বেহালা কলেজে সম্প্রতি হয়ে গেল আলোচনা— গণিতের দর্শন ও যুক্তি, গণিতে প্রবর্তিত নব নীতি ও গণিত-ইতিহাসে সংস্থার ভূমিকা নিয়ে বললেন মিহির চক্রবর্তী মদনমোহন চেল ও অমল ভৌমিক; গণিত পরীক্ষাগার, জনপ্রিয় গণিত ও সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে ছাত্রদের সামনে বললেন আরও পাঁচ জন স্কুলশিক্ষক।
মগ ও জল
জেলখানার ভিতরে মগে জল খাওয়া নিয়ে হাতাহাতি চলছে সদ্য সেলে আসা আগন্তুক আর এক পুরনো কয়েদির, দরজা খুলে ঢোকে দুই সেনা, জানায়— ইত্যবসরে সরকার বদল হয়েছে। “ক্ষমতার কুর্সি আসলে একটা মগ... মগ থেকে যেমন জল ছিটকে পড়ে, মাটি ভিজিয়ে জল হারিয়ে যায় ঠিক তেমনি করে আগের সরকারের প্রধান কুর্সি থেকে ছিটকে পড়ে মাটি রক্তে ভিজিয়ে হারিয়ে গেল,” বলে তারা। এখন তাই আগের যুগের কয়েদিদের তলব, ডেকে পাঠিয়েছেন ‘নতুন মগের জল’। এ ভাবেই এগোয় বিশ্বজিৎ রায়ের নাটক বারবার মগের মুলুক— বাস্তব ও রূপকের হাত-ধরাধরিতে, ক্ষমতাতন্ত্রকে প্রশ্ন করতে করতে। মান্দাস প্রকাশিত এই নাটকের বইটির আনুষ্ঠানিক প্রকাশ হয়ে গেল সম্প্রতি, বইপাড়ায় মান্দাসের বিপণিতে। ছিল বই ঘিরে কথালাপও।
এই শহরের
সিকি শতাব্দী তিনি কলকাতায়, কেরলের মানুষ হয়েও। ছিলেন ফিল্মস ডিভিশনে, ছবি তৈরির কর্মকাণ্ডেই এখনও ব্যস্ত থাকেন জোশি জোসেফ। তাঁর ওয়ান ডে ফ্রম আ হ্যাংম্যান’স লাইফ; আ পোয়েট, আ সিটি, অ্যান্ড আ ফুটবলার; অভিমানী জল/ ওয়াকিং ওভার ওয়াটার, এই তিন ছবিতে উঠে এসেছিল এ শহরের ভিতরেই লুকিয়ে থাকা আর এক কলকাতার কথা। তা নিয়ে বই লিখেছেন চলচ্চিত্র-আলোচক বিদ্যার্থী চট্টোপাধ্যায়: ক্যালকাটা ফিল্মস/ আ জোশি জোসেফ ট্রিলজি। চিদানন্দ দাশগুপ্ত শতবার্ষিকী পুরস্কারপ্রাপ্ত বইটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হল সম্প্রতি, তিরুঅনন্তপুরম প্রেস ক্লাবে। এমন আয়োজন তো কলকাতাও করতে পারত, ফিল্মপ্রেমী সংগঠন তো কম নেই শহরে, অভাব শুধু উদ্যোগের!
বাঘিনি-কথা
প্রদর্শনীর নাম টাইগ্রিস: দ্য কুইন অব বেঙ্গল। মরিজ়িয়ো বশেরি ও দানিয়েল কালোভি, দুই ইটালীয় শিল্পীর মিশ্র মাধ্যমের কাজে উদ্ভাসিত রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার ও তার আবাসভূমির জীববৈচিত্র। ক্রান্তীয় অরণ্য, ঘাসজমি বা ম্যানগ্রোভের বাস্তুতন্ত্রের রূপ ফুটে উঠেছে প্রায় শিশুর দৃষ্টিতেই, যেন হিতোপদেশ বা কথামালা-র পাতা থেকে বাঘের সঙ্গী হয়ে ক্যানভাসে হাজির পাখি, প্রজাপতিরা (ছবিতে)। প্রদর্শনীর পাশাপাশি কলকাতার পড়ুয়া ও শিল্পীদের নিয়ে কর্মশালাও করেছেন দুই শিল্পী, কর্মশালার আঁকা দু’টি ক্যানভাসে সেজে উঠেছিল শহরের দুই পুজোমণ্ডপও। স্বাধীনতার পঁচাত্তর পূর্তি এবং ভারত-ইটালির কূটনৈতিক সম্পর্কের সাড়ে সাত দশক উপলক্ষে কলকাতার কনসুলেট জেনারেল অব ইটালি-র সহযোগিতায় এই সমস্তই হয়ে গেল সদ্য, কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি (কেসিসি)-তে।
শিল্পের ‘স্বর্গ’
বছর কয়েক আগে একটি ম্যুরাল বিশ্বে তোলপাড় তুলেছিল: শিশুর হাত থেকে হৃদয় আকৃতির বেলুন একটু একটু করে হাওয়ায় দূরে সরে যাচ্ছে। বেলুনটি ভালবাসা ও আশার প্রতীক, যা শিশুটির ছায়ার নাগালের বাইরে চলে যায়। শিল্পী দেখাতে চেয়েছেন, মানুষের অনুভূতিগুলো কত ক্ষণস্থায়ী; কী ভাবে দূরে সরে যায়। সম্প্রতি ‘হিডকো’-র উদ্যোগে নিউটাউনের ইকো আর্বান ভিলেজের দিকে যেতে ‘আউল স্টপ’-এর ঠিক পরের ট্র্যাফিক আইল্যান্ডে গ্লেজ়ড টাইল দিয়ে তৈরি প্যারাডাইস নামের যে শিল্পকর্মটি (ছবিতে) স্থাপিত হয়েছে, সেটির শিল্পী অশোক মল্লিক। আশির দশক থেকে কাজ করা এই শিল্পী ও তাঁর সহযোগীরা জানালেন, এই শিল্পকর্মের উদ্দেশ্য শান্তির মূল্য বোঝানো, শহরের সৌন্দর্য বাড়ানো। অশোকের কথায়, “নিউটাউনের মতো শান্ত নিরিবিলি জায়গায় বাসের অভিজ্ঞতা, আর শহরজোড়া দৃশ্যদূষণের বাস্তবতা থেকেই এ এক ফ্যান্টাসি রচনা।”
হাত ধুয়ে
ভারতে পাশ্চাত্য চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য ধারণার প্রসারের সঙ্গে সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি পালনের অঙ্গ হিসেবে হাত ধোওয়া গুরুত্ব পেল, উনিশ শতকের শেষ নাগাদ। সাধারণ ভাবে পাশ্চাত্যে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে যুক্ত করা হলেও, ‘স্বরাজ দল’ কলকাতা পৌরসভার ক্ষমতায় আসার পর তাদের উদ্যোগে স্বাস্থ্যবিধি পালন হয়ে ওঠে প্রায় জাতীয় কর্তব্যের অংশ। ১৯২৬-এর এপ্রিলে মানিকতলায় ‘স্বাস্থ্য বিকাশ সমিতি’-র আয়োজন করেছিল স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে বিশেষ আলোচনা ও কর্মসূচি। স্বাস্থ্যবিধি পালন ও পরিচ্ছন্নতাকে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের আন্দোলনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার এই উদ্যোগ প্রায় শতবর্ষ ছুঁতে চলল। তবু আজও খাওয়ার আগে ও শৌচালয় ব্যবহারের পরে ভাল করে হাত ধোওয়ার জন-অভ্যাস পূর্ণ সাফল্য পায়নি। আজ, ১৫ অক্টোবর আবিশ্ব পালিত হয় ‘হাত ধোওয়া দিবস’। জনস্বাস্থ্যের দিক থেকে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন, সে ভাবনাকে হাত ধুয়ে না ফেললেই হল।