শহরের মধ্যে এক টুকরো সবুজ, সেখানে সাজানো ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, সেন্ট পল’স ক্যাথিড্রাল-সহ গর্বের স্থাপত্যগুলি। কলকাতার এই ময়দান গড়ে ওঠার পিছনে পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে নবাব সিরাজউদ্দৌলারও। ব্রিটিশরা এ শহরে পা দেওয়ার পরেও গোবিন্দপুর সংলগ্ন বিস্তীর্ণ এলাকা ছিল ঘন জঙ্গল, বুনো জন্তুর বাসা। সিরাজের আক্রমণে তাদের পুরনো কেল্লা ধ্বংস হওয়ার পর নতুন ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের জন্য জায়গা, এবং সামরিক আইনমতে দুর্গের সামনেও খোলা জায়গার প্রয়োজনে ১৭৫৭ সালের অগস্টে এক আদেশে জনসাধারণকে জঙ্গলের কাঠ কাটার অনুমতি দেওয়া হয়। অক্টোবরেই ফের আদেশ, বসত ছেড়ে সরে যেতে বলা হল শেঠ বসাক ঠাকুর ঘোষাল-সহ গোবিন্দপুরের বাসিন্দাদের। জঙ্গল আর বসতি পরিষ্কার হতেই গড়ে উঠল ময়দান, বা ‘গড়ের মাঠ’। আয়তনে নিউ ইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্ক বা লন্ডনের হাইড পার্ককে কয়েক গোল দেওয়া কলকাতার এ ময়দানে গোড়ায় সামরিক প্রয়োজন মেনে কোনও গাছ জন্মাতে দেওয়া হত না। ১৮৪৮-এর পরে লর্ড ডালহৌসির আমলে ময়দানে চারা লাগানো শুরু হয়। বদলে যেতে শুরু করে ময়দানের রূপ, চরিত্রও। ইতিহাসের পথ ধরে ময়দানের এই বিবর্তনকেই দু’মলাটে ধরেছেন ডালিয়া রায়, ফোর্ট উইলিয়াম অ্যান্ড ক্যালকাটা ময়দান: দ্য ব্রিটিশ হেরিটেজ অব ক্যালকাটা (প্রকাশক: পুঁথি পুস্তক) বইতে।
ময়দানে গড়ে ওঠা ব্রিটিশ আমলের ম্যাকডোনেল বা পানিওটি ফাউন্টেনের মতো ঐতিহাসিক স্থাপত্য, কিংবা ছোট ক্লাব, বিশেষত অফিস ক্লাবগুলির সঙ্গে জড়িয়ে আছে শহরের বহু অজানা ইতিকথা, তারাও আদরে ঠাঁই পেয়েছে বইয়ে। বাদ যায়নি ময়দানে গড়ে ওঠা বাজার পার্ক রাস্তা পুকুর, অদূরে গঙ্গার ঘাটের কথাও। ক্ষেত্রসমীক্ষা ও সাক্ষাৎকারভিত্তিক প্রকাশনাটি সমৃদ্ধ বিভিন্ন সময়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর ও পত্রাংশে। ফুটে উঠেছে শহরের ঐতিহ্য ধ্বংস নিয়ে এ এল ডায়াস থেকে পিয়ারসন সুরিটা বা জ্যোতির্ময় দত্তেরও উৎকণ্ঠা।
ফোর্ট উইলিয়াম ও ময়দান সংক্রান্ত বিভিন্ন আইন নিয়ে আলোচনায় দেখানো হয়েছে, ১৮৮১ সালের ‘ফোর্ট উইলিয়াম অ্যাক্ট’ অনুযায়ী ময়দান ঘোষিত ‘নো নুইসেন্স’ এলাকা হিসেবে। এখনও বহাল এই আইন, যার বলে ময়দান নোংরা করা, সবুজ ধ্বংস করা ইত্যাদি অপরাধে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করার ক্ষমতা আছে পুলিশের। কিন্তু এই আইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষ তত ওয়াকিবহাল নন, এমনকি বিদগ্ধমহলেও ধারণা যে খুব স্পষ্ট তা বলা যাবে না। কলকাতা বিশেষজ্ঞ পি টি নায়ার-এর প্রাক্কথনে সমৃদ্ধ, ময়দান নিয়ে খুঁটিনাটি বহু তথ্যে ভরা বইটি কলকাতার ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সংযোজন। ছবিতে ১৮৭০-এর দশকের কলকাতার দৃশ্য, ময়দান অঞ্চল থেকে। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
ধনঞ্জয় ১০০
গানজীবন যে ব্যক্তিজীবনেরও দিগন্ত খুলে দেয়, প্রমাণ ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য (ছবিতে)। ভক্তিগানে সাধকপ্রতিম, আধুনিক গানেও শিরোধার্য এই শিল্পী ছিলেন শিল্পীদের অভিভাবকসম। আজ, ১০ সেপ্টেম্বর, জন্মশতবর্ষ পূর্ণ হচ্ছে তাঁর। শিল্পী-পুত্র দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের উদ্যোগে এ শহরে আয়োজিত হত ধনঞ্জয়-স্মরণানুষ্ঠান, তাঁর প্রয়াণেও থেমে যায়নি সে ধারা, কলকাতার শ্রুতি পরিষদ ও সিকম স্কিলস ইউনিভার্সিটির উদ্যোগে আজ সন্ধ্যা ৬টায় বিড়লা অ্যাকাডেমিতে অনুষ্ঠান ‘এমনও মধুর ধ্বনি’। কাছের মানুষের স্মৃতিচারণায় পরিবারের এই প্রজন্মের দুই সদস্য, শোনা যাবে শিল্পীর স্মরণীয় গান। শতবর্ষে একটি স্মারকগ্রন্থ, শিল্পীর জীবনকৃতির যথার্থ সংরক্ষণ হলে ভাল হত আরও। ১৩ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৫টায় রবীন্দ্র সদনে আর একটি অনুষ্ঠান: ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য স্মরণ সংসদ, ধনঞ্জয় গীতিমন্দির ও হারমোনিকার উদ্যোগে।
মিলাবে মিলিবে
নতুন উপাদান ও আঙ্গিক, অদেখা বিষয়বস্তু, নতুন শৈলী— পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ দেয় শিল্পীকে। শিল্প সৃষ্টিতে বিনিময় তাই এক নিরন্তর প্রক্রিয়া। ভারতের শিল্প-ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে পশ্চিম থেকে উঠে আসা নানা ধরনের শিল্প-উপাদানে মোগল শিল্পকলার প্রারম্ভিক পর্বে চিত্র ও চারুকলায় কী ভাবে সূত্রপাত হল এক নতুন ধারার, সচিত্র উল্লেখে সে কথাই বলবেন অশোককুমার দাস, রাজ্য চারুকলা পর্ষদের আয়োজনে ‘নন্দলাল বসু স্মারক বক্তৃতা’-য়, ১৩ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৫টায়, অবনীন্দ্র সভাগৃহে। অশোকবাবু বিশিষ্ট শিল্প-আলোচক, কলকাতায় ভারতীয় সংগ্রহালয়ের ডেপুটি কিপার ও জয়পুরে সওয়াই মানসিংহ মিউজ়িয়মের ডিরেক্টর ছিলেন, পড়িয়েছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও জেএনইউ-তে, বিশ্বভারতীতে ছিলেন ‘সত্যজিৎ রায় চেয়ার’ অধ্যাপক; দেশে বিদেশে বিখ্যাত কয়েকটি মিউজ়িয়মের ‘ফেলো’ হিসেবে তাঁর গবেষণা কীর্তিত। এ দিনের সন্ধ্যায় বিষয়-শীর্ষক ‘পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার’, সভামুখ্য শিল্পী যোগেন চৌধুরী।
ইতিহাস ছুঁয়ে
শিয়ালদহ থেকে বেলেঘাটার পথে গান্ধী ভবন পেরিয়ে অগ্রবাণী গ্রন্থাগার। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আবহে বেলেঘাটার বাড়িতে কিছু দিন ছিলেন মহাত্মা, সেই দাঙ্গার আগুন থেকে একটি সমৃদ্ধ পারিবারিক গ্রন্থাগারকে বাঁচানোর লক্ষ্যে অগ্রবাণী-র শুরু, ১৯৪৭-এর ডিসেম্বরে। স্বাধীনতার পঁচাত্তর পূর্তিতে সে-ও উৎসবময়। ‘সিসৃক্ষা’র সহযোগিতায় ১০-১৪ সেপ্টেম্বর অগ্রবাণী ভবনে হবে গ্রন্থ প্রদর্শনী তথা বইমেলা, উদ্বোধন আজ বিকেল ৫টায়। প্রকাশিত হবে শিখা অগ্রবাণী পত্রিকা। প্রতি দিন বিকেল সাড়ে ৫টায় আলোচনাসভা, নানা বিষয়ে: জন্মের সার্ধদ্বিশতবর্ষে রাজা রামমোহন রায় ও দ্বিশতবর্ষে রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্রের স্মরণ, বেলেঘাটার ইতিবৃত্ত, ছোট পত্রিকার তিন কাল, গ্রন্থাগার ও এই সময়— বিশিষ্টজনের উপস্থিতি ও অংশগ্রহণে।
মানুষের শিল্পী
বাংলা পথনাটকের অগ্রণী পুরোধা তিনি। প্রোসেনিয়ামের বাধা অতিক্রম করে নাটককে খোলা আকাশের নীচে নিয়ে আসেন পূর্ণেন্দুশেখর পালচৌধুরী তথা পানু পাল, মার্ক্সীয় আদর্শ বুকে নিয়ে নাটকে বলতেন নিপীড়িত মানুষের কথা। কারখানার ফটক, বস্তি, শহিদ মিনার প্রাঙ্গণে অভিনীত হত তাঁর নাটক ভোটের ভেট, হিন্দি চিনি ভাই ভাই, খেয়াতরী... বাংলার রাজনীতি, স্বাধীনতার পূর্বাপর পরিস্থিতি, বামপন্থী আন্দোলন, গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গে আশ্লিষ্ট ছিলেন নাটক নৃত্যনাট্য প্রবন্ধ চলচ্চিত্র তথা শিল্পের যোগে। প্রয়াত ১৯৯৫-এ; গত ২ সেপ্টেম্বর প্রয়াণদিনে ‘থিয়েলাইট’ ও ‘শিল্পাঙ্গন’-এর উদ্যোগে তৃপ্তি মিত্র নাট্যগৃহে হল তাঁর স্মরণ, পৌত্রী মধুমিতা পালের নিবেদনে, আশিস গোস্বামী ও বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথনে, শিল্পীর নাটকের গানেও।
কলকাতায় কিউবা
ছবির পর্দায় উনিশ শতকের কিউবা। আবার এই একুশ শতকেরও, যেখানে চোখ-ধাঁধানো নাগরিক বৈভব আর প্রযুক্তির সমান্তরালে জীবনের সহজ সত্য ধরা পড়ে কৈশোরের আয়নায়। বিদেশি শক্তির দড়ি টানাটানির মধ্যে পড়ে যাওয়া দেশ, দুই পরিবারের দ্বেষ-জাল কেটে বেরোতে চাওয়া বন্ধুতা... অনেক দিন পরে আবার কিউবার ছবি এ শহরে। ভারতের কিউবান দূতাবাসের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়, কলকাতার চলচ্চিত্রচর্চা সংস্থা ‘ফোরাম ফর ফিল্ম স্টাডিজ় অ্যান্ড অ্যালায়েড আর্টস’ আয়োজন করেছে চারটি কিউবান ছবির প্রদর্শন: ইনোসেনসিয়া, ভিভা কিউবা, কিউবা লিবরে আর হাভানাস্টেশন। আগামী ১২ ও ১৩ সেপ্টেম্বর, বিকেল ৪টে ও সন্ধে ৬টায়, নন্দন-৩ প্রেক্ষাগৃহে।
সান্ধ্য আসরে
এক কথক আর তার গল্প বলার জাদুকে ঘিরে যুগ যুগ ধরে বসেছে আসর। পারস্য উপসাগরের কোল ঘেঁষে কোনও বন্দরে, উপমহাদেশের শহর বা গ্রামে। কোথাও বণিকের কাফিলা, কোথাও তীর্থযাত্রীর দল। স্থান কাল পাত্র বদলেছে, বদলায়নি গল্পের টান। বরং তৈরি হয়েছে কথকতার নানা শৈলী, যেমন দস্তানগোই। ‘ক্যালকাটা কারোয়াঁ’ এই শৈলীর আশ্রয়ে ঐতিহ্যবাহী নানা বিষয়ে অনুষ্ঠান করে থাকে, এ বার নবাবি বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদের হারিয়ে যাওয়া সময়ের নানা কিস্সা শোনাবেন গল্পকথক, ‘কিসসা মুর্শিদাবাদি’ বৈঠকে, সঙ্গে গানবাজনা। আছে ‘তসবিরনামা’, মুর্শিদাবাদের দুষ্প্রাপ্য ছবির গল্প। এ সব নিয়েই আজ, ১০ সেপ্টেম্বর ‘শাম-এ-মুর্শিদাবাদ’, চারুকলা পর্ষদের অবনীন্দ্র সভাগৃহে বিকেল ৫টা থেকে। নীচে উনিশ শতকের প্রথম দিকের আঁকা ছবিতে গঙ্গায় মুর্শিদাবাদের নবাবের নৌকা, ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
নেপথ্য-ইতিহাস
বঙ্গজীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’। কলকাতা বেতার জগতের এই আলেখ্য জানিয়ে দেয়, পুজো এসে গেল। কিন্তু কী ভাবে হয়েছিল এই মহাকাব্যিক সংঘটন? বাণীকুমারের লেখা, পঙ্কজকুমার মল্লিকের সুর এবং বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের পাঠই তো শুধু নয়, শহরে বেতারের পত্তনের প্রেক্ষাপটে মিশে গিয়েছিল ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’ তৈরির গল্প। সেই ইতিহাসই উঠে এসেছে সদ্যপ্রকাশিত মহিষাসুরমর্দ্দিনী: সম্পূর্ণ নেপথ্যকাহিনি (প্রকাশক: আনন্দ) বইয়ে। কৌশিক পাল সম্পাদিত এ বইয়ে শুধু ইতিহাস আর টুকরো গল্পই নয়, রয়েছে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র বাণীকুমার পঙ্কজকুমার মল্লিকের (ছবিতে তিন জন, বইয়ের প্রচ্ছদে) জীবনের নানা কাহিনি, বন্ধুত্বের গল্প, খানিক মন-কষাকষিরও। ঘটনাপরম্পরায় এসেছেন উত্তমকুমার, মহালয়ার সকালে তাঁর অনুষ্ঠানসূত্রে; মহিলা কণ্ঠশিল্পীরাও বিকচ স্বাতন্ত্র্যে। রয়েছে ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’র মূল স্ক্রিপ্ট, সঙ্গে গানের স্বরলিপিও। পরতে পরতে নস্টালজিয়া, আবার এ এক অমূল্য ঐতিহাসিক দলিলও।
শিল্পমগন
ধ্রুপদী চলচ্চিত্রকারদের ছবি তৈরির মন নির্ভার গদ্যে ফুটিয়ে তুলেছিলেন নীতিশ মুখোপাধ্যায়। তাঁর চলচ্চিত্রের চিত্রকর প্রকাশ পেয়েছে সদ্য, তিন খণ্ডে। নিজেও ছিলেন চিত্রকর ও চলচ্চিত্রকার, ইমেজ রচনায় আনন্দমগন। গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের ছাত্র, মগ্ন রবীন্দ্রনাথে, তৈরি করেছিলেন রবিবার, চার অধ্যায়-এর মতো ছবি। দাদা, বিশিষ্ট তথ্যচিত্রকার আশীষ মুখোপাধ্যায়ের সূত্রে ছবির জগতে আসা সত্তর দশকে— উল্লেখ্য কাহিনিচিত্র একদিন সূর্য, নয়নশ্যামা; রামকিঙ্কর, শর্বরী রায়চৌধুরীকে নিয়ে তথ্যচিত্রও। ঘনিষ্ঠ ছিলেন সত্যজিতের, তাঁরই আগ্রহে হয়ে ওঠেন সন্দেশ-এর ইলাস্ট্রেটর। নীতিশের চিত্রকলার প্রদর্শনীও হয়েছে একাধিক বার। প্রফুল্ল, আড্ডাপ্রিয় মানুষটি চিরবিদায় নিলেন গত ৩১ অগস্ট। গুণমুগ্ধেরা তাঁকে স্মরণ করবেন আগামী কাল ১১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৬টায়, কসবার ৯১ রাজডাঙা চক্রবর্তীপাড়ায়।