পারম্পরিক বিশ্বাস অনুযায়ী জিশুখ্রিস্টের বারো জন শিষ্যের অন্যতম সন্ত টমাস ভারতে এসেছিলেন ৫২ খ্রিস্টাব্দে। মালাবার উপকূলের সাতটি গ্রামে ধর্মপ্রচার করেন তিনি। তাঁর প্রভাবে যাঁরা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন তাঁরা নিজেদের বলতেন ‘মার টোমা’ বা সন্ত টমাসের দ্বারা দীক্ষিত খ্রিস্টান। ধর্ম, উপাসনা ও ভাষার নিরিখে রোমান চার্চের সমসাময়িক এই গোষ্ঠীর সদস্যেরা পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন খ্রিস্টধর্মাবলম্বী। ৩৪৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু করে বেশ কয়েক শতক ধরে সিরিয়া অঞ্চল থেকে খ্রিস্টানরা নানা কারণে মালাবার উপকূলে এসে বসতি গড়া শুরু করেন, মালাবারের প্রাচীন খ্রিস্টানদের সঙ্গে মিশে গড়ে তোলেন এক প্রাণবন্ত সম্প্রদায়। তবে ভাস্কো দা গামা মালাবার উপকূলে জাহাজ নোঙর করার পর, ষোড়শ শতকের শুরু থেকে রোমান ক্যাথলিক চার্চ এই সম্প্রদায়কে নিজেদের ছাতার তলায় নিয়ে আসার চেষ্টা করতে থাকে। সেই প্রয়াসের বিরোধিতাও গড়ে ওঠে। নানা ঘটনা ও সংস্কারকাজের মধ্যে দিয়ে প্রোটেস্টান্ট ও অর্থোডক্স দুই চার্চের সঙ্গেই দূরত্ব রেখে নিজস্ব পৃথক পরিচয় স্থাপনে সক্ষম হয় ‘মার টোমা সিরিয়ান চার্চ’।
গত শতকের শুরু থেকেই রোজগারের আশায় ভারতের নানা জায়গার মতো কেরল থেকেও মানুষ আসতে শুরু করেন কলকাতায়। তখন মালয়ালি খ্রিস্টানদের নিজস্ব কোনও উপাসনাগৃহ ছিল না, বিভিন্ন গোষ্ঠীর মালয়ালি খ্রিস্টানরা ধর্মীয় আচার পালনে প্রতি রবিবার একত্র হতেন বিশপ’স কলেজে। সেখানে আসতেন মার টোমা খ্রিস্টানরাও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেনা কলেজের দখল নিলে, রবিবারের ধর্মসভা সরে যায় আমহার্স্ট স্ট্রিটের হোলি ট্রিনিটি চার্চে। বিশ্বযুদ্ধের বাজারে রোজগারের টানে প্রচুর মালয়ালি কলকাতায় আসেন, লোকসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় দেখা দেয় গোষ্ঠীভিত্তিক ধর্মীয় সংগঠন স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা। কলকাতায় মার টোমা সম্প্রদায়ের স্থাপনাও সেই সময়ই, ১৯৪৭ সালে। এ বছরটি তাই কলকাতার এই সম্প্রদায়ের বিশেষ উদ্যাপনের— পঁচাত্তর বছর পূর্তি।
এই সম্প্রদায়ের নিজস্ব উপাসনাস্থল গড়ে ওঠার পিছনে আবার তরুলতা মিত্র ও হেমলতা রায় নামে দুই বাঙালি বোন। বালিগঞ্জের ২৯ আহিরপুকুর রোডে তাঁদের দেওয়া জমিতেই উপাসনা শুরু ১৯৫৯ সালে, পরে ১৯৬৭-তে তৈরি হয় মার টোমা চার্চ (ছবিতে)। ধর্মাচরণের পাশাপাশি জনসেবার কাজে যুক্ত এই সংগঠন, তাদের ‘জনতা মেডিক্যাল হল’-এর সূচনা হয়েছিল মাদার টেরিজার হাতে। কলকাতার বহু প্রাচীন উপাসনাস্থলের তুলনায় এই গির্জাটি নবীন, কিন্তু তার পিছনের ইতিহাসটি সুপ্রাচীন এবং চমকপ্রদও: স্বয়ং জিশুখ্রিস্টের শিষ্যের সঙ্গে সম্পর্কে গাঁথা তা, ভারত-পশ্চিম এশিয়া আর কেরল-বঙ্গেরও সংযোগসেতু; সর্বোপরি কলকাতার বহুমাত্রিক ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উজ্জ্বল এক নিদর্শন। আগামী কাল যথাযথ মর্যাদায় বড়দিন পালিত হবে এই চার্চেও। ছবিতে মার টোমা চার্চ ও সন্ত টমাসের ক্রস।
স্মরণে
২০২০-র ডিসেম্বরে প্রথম ‘কৃষ্ণা বসু স্মারক বক্তৃতা’ দিতে নিউ ইয়র্ক থেকে এসেছিলেন গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, অতিমারি উপেক্ষা করে। গত বছর এই স্মারক বক্তৃতা দেন প্রাক্তন বিদেশসচিব নিরুপমা রাও। আগামী ২৬ ডিসেম্বর, কৃষ্ণা বসুর (ছবি) ৯২তম বৎসর পূর্তির দিনে নেতাজি ভবনে সন্ধ্যা ৬টায় তৃতীয় স্মারক বক্তৃতা, বলবেন বিশিষ্ট কূটনীতিবিদ রণেন সেন। দু’জনের পরিচয় কর্মসূত্রে, লোকসভার তিন বারের সাংসদ কৃষ্ণা বসু যখন সংসদের বিদেশ বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারপার্সন ছিলেন, তখন এক সঙ্গে কাজ করেছেন, ক্রমে বন্ধুত্ব। এ দিন রণেনবাবুর বক্তৃতায় বিষয় ‘ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য গ্রেট পাওয়ারস: আ ডিপ্লোম্যাট’স পার্সোনাল জার্নি থ্রু ওয়র্ল্ড ক্যাপিটালস’। বলবেন ভারতের রাষ্ট্রদূত হিসাবে ওয়াশিংটন লন্ডন ও বার্লিনের অভিজ্ঞতা, মস্কো ও বেজিংয়ে কাজ করার গল্পও। থাকবেন সুগত বসু ও সুমন্ত্র বসু।
ঐতিহাসিক
১৯২২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি কানপুরে অতুলপ্রসাদ সেনের প্রস্তাবক্রমে, প্রবাসী বিশিষ্ট বাঙালিদের উপস্থিতিতে গড়ে ওঠে ‘উত্তর ভারতীয় বঙ্গ সাহিত্য সম্মিলন’। পরের বছর মার্চে কাশীর সেন্ট্রাল হিন্দু কলেজে তার প্রথম অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন রবীন্দ্রনাথ। পরে ইলাহাবাদ, লখনউ, কানপুর, দিল্লি, নাগপুর ও গোরক্ষপুরেও হয় সম্মেলন, বঙ্গে প্রথম ১৯৩৮ সালে, কলকাতার টাউন হল-এ। ১৯৫৩ থেকে নাম বদলে ‘নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন’, সরলা দেবী চৌধুরাণী প্রমথ চৌধুরী প্রফুল্লচন্দ্র রায় যদুনাথ সরকার রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় নীহাররঞ্জন রায় সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ কৃতী বাঙালির স্মৃতিসমৃদ্ধ এই সংগঠনের শতবর্ষ এ বছর। সারা দেশে প্রায় শতাধিক শাখা ও প্রায় কুড়ি হাজার সদস্য একযোগে পালন করবেন শতবর্ষ, আগামী ২৫ থেকে ২৭ ডিসেম্বর এ শহরে, ৯১তম সর্বভারতীয় সম্মেলনে— বিশিষ্টজনের উপস্থিতি ও অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে।
স্মরণে সঙ্গীতে
চেতলা মুরারি সঙ্গীত স্মৃতি সম্মিলনী প্রতি বছর প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সঙ্গীতপ্রতিভার অন্বেষণ করে শহরে, কোভিডকালেও তা বন্ধ হয়নি, চলেছে আন্তর্জালেই। সঙ্গীতগুণী মুরারিমোহন ও তাঁর পরিবারের সঙ্গীতচর্চার উত্তরসাধিকা নির্মলা মিশ্র ছিলেন এ সংস্থার প্রাণপ্রতিমা, তাঁর স্মরণে পরিবারের পক্ষে অন্যতম সংগঠক দিলীপ মিশ্র আয়োজন করেছেন ৮২তম সঙ্গীত উৎসবের, আজ অহীন্দ্র মঞ্চে বিকেল ৪.৪৫ থেকে। ১৭ ডিসেম্বর প্রথম পর্বে ছিলেন শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায় গৌতম ঘোষাল সৈকত মিত্র-সহ বিশিষ্ট শিল্পীরা, নির্মলার আজীবন অনুষ্ঠানসঙ্গী প্রীতিময় গোস্বামীও। আজ, ২৪ ডিসেম্বর শাস্ত্রীয় সঙ্গীত: কণ্ঠসঙ্গীতে ওঙ্কার দাদারকর ও আইভি বন্দ্যোপাধ্যায়, পণ্ডিত স্বপন চৌধুরীর তবলা লহরা, লাবণী মোহান্তের কত্থক, মিতা নাগের সেতারবাদন।
প্রতিবিম্ব ৫০
১৯৭২ সালে বর্ধমান শহরে যাত্রা শুরু প্রতিবিম্ব পত্রিকার (সম্পা: প্রশান্ত মাজী), এখন কলকাতা তথা বাংলার পাঠকধন্য পত্রিকাগুলির একটি। পাঁচ দশক পূর্ণ করল এই লিটল ম্যাগাজ়িন, আজ ২৪ ডিসেম্বর উদ্যাপন অনুষ্ঠান বাংলা আকাদেমি সভাঘরে বিকেল ৫টায়। থাকবেন শিবাজীপ্রতিম বসু জয় গোস্বামী চিন্ময় গুহ সাধন চট্টোপাধ্যায়, প্রকাশিত হবে প্রতিবিম্ব-র বিশেষ সুবর্ণজয়ন্তী সংখ্যা, ৫০ বছরের নির্বাচিত গল্প সঙ্কলন-ও (ঋক প্রকাশন)। সংবর্ধিত হবেন দেবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়; সুমন্ত মুখোপাধ্যায় বলবেন ‘সময়ের হাত ও ছোট কাগজ’ নিয়ে। কবিতা, গান, শ্রুতিনাটকে আনন্দযাপন, দেখানো হবে পত্রিকার ৫০ বছরের যাত্রা নিয়ে অরিন্দম সাহা সরদারের চলমান কথাচিত্র একটি তরবারির রূপকথা।
ফিরে দেখা
শুধু তথ্যচিত্রই নয়, এ যেন বাংলা থিয়েটারের ভাষ্যও এক। নাট্যব্যক্তিত্ব বিভাস চক্রবর্তীর জীবন ও কাজকে নিবিড় ভাবে দেখা, আবার যুদ্ধ মন্বন্তর দেশভাগ পেরিয়ে সময়, সমাজ ও থিয়েটারের ধারাবিবরণীও। বিহাইন্ড দ্য কার্টেন: আ জার্নি উইথ বিভাস চক্রবর্তী, শান্তনু সাহার এই তথ্যচিত্রটি দেখানো হয়েছে বহু জায়গায়— ফিল্ম ক্লাবে, নাটকের দলের আড্ডায়, নাট্যোৎসবে, ঢাকা-চট্টগ্রাম থেকে সুদূর নিউ জার্সিতে, এই শহর ও রাজ্যের বহু কলেজেও। আগামী ২৯ ডিসেম্বর সন্ধে ৬টায় তপন থিয়েটারের জ্ঞানেশ-তাপস কক্ষে পঞ্চাশতম প্রদর্শন এ ছবির, বারাসত জনস্বর-এর উদ্যোগে। সঙ্গে রয়েছে আলোচনাও, বিষয়টি বেশ: ‘বাংলা থিয়েটার রক্ষণশীল নয়, সংরক্ষণশীলও নয়’। থিয়েটার ঘিরে এ কালের এই চর্চা আশা জোগায়।
চিত্রিত ইতিহাস
তথ্যচিত্র পরিচালক, নারী আন্দোলন কর্মী, কমার্শিয়াল আর্টিস্ট। মিতালি বিশ্বাস আবীর নিয়োগী ও সাগরিকা দত্ত, তিন বন্ধু মিলে বানিয়েছেন একটি ডেস্ক ক্যালেন্ডার। ভারতের মূল ধারার ইতিহাসে উপেক্ষিত যাঁরা, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণিগত ভাবে প্রান্তিক সেই মানুষদের নিয়ে, নারীদের নিয়ে তো অবশ্যই। নাঙ্গেলি থেকে ভাঁওরি দেবী, বিলকিস বানো, ওয়ারলি বিদ্রোহ, কৃষি আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, কাশ্মীর থেকে শাহীন বাগ, সমলিঙ্গের সম্পর্কের আইনি স্বীকৃতি আদায় থেকে লাভ জেহাদের মিথ্যা নির্মাণের বিরুদ্ধে ভালবাসার অধিকার প্রতিষ্ঠা— নারী ও প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌনতার পরিচয় ছাপিয়ে মানুষের লড়াইয়ের ইতিহাসকেই তুলে ধরার প্রয়াস। ক্যালেন্ডারের পাতাগুলি যেন এক-একটি ক্যানভাস: মাসুদি আসমা মেরী ওয়াহিদা লাবণী বৈশালী চিল্কা ধ্রুপদী অপর্ণিতা সুচন্দ্রা, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের মহিলা শিল্পীদের আঁকা আন্দোলন ও প্রতিবাদের ছবি তুলে ধরেছে (নীচের ছবিতে তেমন একটি)। সাহায্য করেছেন সমমনস্ক অনেক বন্ধু। ক্যালেন্ডারের সূত্রে যেন মনে রাখি এই গণ আন্দোলনকে, সেটাই উদ্দেশ্য। বিশদ তথ্য ‘ক্যালেন্ডার: ক্যানভাস অব আনটোল্ড হিস্ট্রি’ ফেসবুক পেজে।
তাঁর স্মৃতিতে
সামাজিক ক্লাবের উদ্যোগে নাট্যমেলা হচ্ছে, কলকাতায় এমন কৃতিত্বের দাবিদার লেক ক্লাব। ২০১৫ সালে প্রথম নাট্যমেলা, অতিমারিতে দু’বছর বন্ধ ছিল, এখন জোরকদমে চলছে সপ্তম নাট্যমেলার প্রস্তুতি। শুরু নতুন বছরের গোড়াতেই, ২ জানুয়ারি। এ বারের মেলা হাবিব তনভীরের প্রতি শ্রদ্ধায়; ২০২৩-এ তাঁর জন্মশতবর্ষ, তারই স্মরণ ও উদ্যাপন। প্রথম দিন সন্ধ্যা ৭টায় ক্লাবের স্পোর্টস কমপ্লেক্সে আলোচনসভা ‘হাবিব একাই একশো’, থাকবেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় অরুণ মুখোপাধ্যায় বিভাস চক্রবর্তী-সহ বিশিষ্টজন, হাবিব-কন্যা নাগিন তনভীরও। হাবিবের নাটক ও মঞ্চসজ্জা নিয়ে শিল্পী হিরণ মিত্রের আঁকা ছবিতে সেজে ওঠা একটি ক্যালেন্ডারও প্রকাশিত হবে। ৩ জানুয়ারি নয়া থিয়েটার ভূপাল-এর চরণদাস চোর (ছবিতে এ নাটকে হাবিব তনভীর, পুরনো মঞ্চায়নে) এ ছাড়া ডব্লু ডিলু টিমলু টিলু ডুব, বড়দা বড়দা, প্রথম রাজনৈতিক হত্যা, শের আফগান, ব্যারিকেড ও টাইপিস্ট— ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন দিনে।
বড় পর্দায়
“সমুদ্র গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, তার জল আর বালি বার বার ফিরে আসে...” বলছিলেন সন্দীপ রায়। সত্যজিতের হত্যাপুরী-র পুরীর সমুদ্র কতখানি জুড়ে তাঁর ছবিতে, জানাচ্ছিলেন পরিচালক। ছ’বছর পর গতকালই বড় পর্দায় ফেলুদা হাজির এ শহরে, কমলালেবু-রোদ গায়ে মেখে বড়দিনের উৎসবে মেতে ওঠা শহরে ফেলুদার রহস্য-অ্যাডভেঞ্চার। জটিল প্লট, তথ্য, মগজাস্ত্রের পাশাপাশি ফেলুদা-লালমোহনবাবু-তোপসের পারস্পরিক রসায়নও বুনতে চেয়েছি, বলছেন সন্দীপ রায়: “তিন অভিনেতা বাবার বা আমার আগেকার ফেলুদা-ছবির কাউকেই অনুসরণ করেননি। ওঁদের কেমিস্ট্রি যদি বাঙালির পছন্দ হয়, তবে এই তিন জনকে নিয়েই আবার ফেলুদা সিরিজ়ের ছবিগুলো করব।”