খুব বেশি দিন আগে নয়, এই শহরেই ক্রিকেট ফুটবলের পাশাপাশি আয়োজিত হত ঘুড়ির লড়াইয়ের লিগও! বছরের একটা বড় সময় ময়দান মুখরিত থাকত ঘুড়িয়ালদের ‘ভো কাট্টা’ রবে। দুঃখের কথা, গত বছর পাঁচেক ধরে সেই লিগ বন্ধ।
ওয়াজেদ আলি শাহের হাত ধরে ঘুড়ি ওড়ানোর রমরমা বাবুগৌরবের কলকাতায়। শহর অচিরে আপন করে নেয় এই শখকে। বাবুদের মধ্যে ঘুড়ির প্যাঁচ লাগানোর প্রতিযোগিতার মেজাজটা ছিল বুলবুলির লড়াইয়ের মতো, সম্মানের লড়াই। সেই মেজাজই ধরে রেখে, স্বাধীনতার পর ১৯৫৪ সালে স্থাপনা ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল কাইট অ্যাসোসিয়েশন’-এর। তাদের প্রথম ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা শুরু ১৯৫৮-তে। প্রথম বছর ছিল ১৫টি দল। ধর্মতলা, এন্টালি, বৌবাজার, সেন্ট্রাল, জাকারিয়া প্রভৃতি নামের ‘কাইট ক্লাব’-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলের সে কালের ওস্তাদ ঘুড়িয়ালরা। শ্রীশচন্দ্র দত্ত, শৈলেন চট্টোপাধ্যায়, জহিরুল হাসান সামসি-র মতো খেলোয়াড়দের পাশাপাশি মহম্মদ কচি বা তিনকড়ি ওস্তাদের মতো ঘুড়ির কারিগরা হলেন সুবিখ্যাত।
নানা কারণে ভেঙে যায় এ সংগঠন। পরে তৈরি হয় ‘ক্যালকাটা কাইট অ্যাসোসিয়েশন’। মধ্য কলকাতার বৌবাজারের এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন প্রবোধ দে বা অনুপ নাগের মতো এলাকার নামকরা ব্যবসায়ীরা, যাঁদের আলাদা পরিচয় ছিল ওস্তাদ ঘুড়িয়াল হিসেবে। সাংগঠনিক শক্তি, সঙ্গে প্রশাসনিক সমর্থন— দুই মিলিয়ে সাফল্যের সঙ্গে জাতীয় স্তরে প্রতিযোগিতা আয়োজন করেছিল এই সংগঠন। বাংলার বাইরেও প্রতিযোগিতায় পুরস্কার জিতে আসতেন অনুপ নাগ, নাসির আহমেদরা।
আগের প্রজন্মের সংগঠক ও খেলোয়াড়রা সরে যাওয়ায় আর ঘুড়ির প্রতি নতুন প্রজন্মের আগ্রহে ভাটা পড়ায় কমে এসেছিল উন্মাদনাও। চিনা মাঞ্জার উপদ্রবে ঘটা দুর্ঘটনায় ঘুড়ি ওড়ানো ইদানীং পুলিশ প্রশাসনের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিযোগিতা আয়োজনে ময়দানের মাঠ ও প্রশাসনের অনুমতি লাভের ক্ষেত্রে সেটাও মস্ত বাধা, জানালেন অ্যাসোসিয়েশনের অন্যতম সদস্য নীলমণি সেন। তবে করোনাকালীন বিধিনিষেধে অন্য খেলাধুলার অসুবিধে বলে ঘুড়ির দিকে ঝুঁকেছেন অনেকে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে উঠেছে ঘুড়িপ্রেমীদের বেশ কিছু নতুন ক্লাবও। ঘুড়ির গায়ে এখন করোনাভাইরাসের ছবি, সঙ্গে লেখা: ‘বাড়িতে থাকুন’।
এক সময়ে ঘুড়িতে ভালবাসার চিঠি বেঁধে বিশেষ বাড়ির ছাদে নামিয়ে দেওয়ার দুরুদুরু প্রথা চালু ছিল এ শহরে। সে এখন শুধুই অতীত। কিন্তু ঘুড়ির প্রতি ভালবাসাটা আজও খাঁটি। গতকাল ছিল বিশ্বকর্মা পুজো, কলকাতার আকাশে পেটকাটি-চাঁদিয়াল-মোমবাতি-বগ্গাদের একলা বা একত্র উড়ানে সেই ভালবাসার ঝলক মিলল কি? ছবিতে উত্তর কলকাতার রামবাগানে ঘুড়ি নিয়ে আনন্দে শিশুরা, গত বছরের ছবি।
চির সহযোগী
পঞ্চাশের দশকের দ্বিতীয় পর্ব, সত্যজিৎ রায় ভাবছিলেন একটি নতুন ধরনের বিষয় নিয়ে ছবি করবেন, আশঙ্কা ছিল তা জনপ্রিয় নাও হতে পারে। এগিয়ে এলেন প্রমোদকুমার লাহিড়ী (১৯২১-১৯৯৮) (ছবিতে), বললেন, ভাল ছবি করার ইচ্ছেতেই প্রযোজনায় এসেছেন তিনি। তৈরি হল পরশপাথর, ১৯৫৭-য় সেই ছবি নিয়ে কান উৎসবে গেলেন তিনি। প্রযোজনা করলেন তপন সিংহের লৌহকপাট-ও। লাহিড়ী পরিবারের ঘনিষ্ঠ ঋত্বিক ঘটকও প্রমোদের সঙ্গে ছবি করতে আগ্রহী হলেন। তৈরি হল অযান্ত্রিক এবং বাড়ি থেকে পালিয়ে, ভেনিসে দেখানো হল ছবি দু’টি। ১৯৬০-এ বীরেশ মুখোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠা করলেন ঐতিহ্যবাহী থিয়েটার-হল ‘মুক্তাঙ্গন’। তাঁর উদ্যোগেই ’৬১-তে জন্মাল ‘সিনে ক্লাব অব ক্যালকাটা’, সঙ্গী রাম হালদার ও রতিলাল দাভে। উদার প্রমোদ আড্ডা জমিয়ে রাখতেন, ছিলেন গানের সমঝদার। আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর শতবর্ষ পূর্ণ করবেন তিনি।
সেপ্টেম্বর শতবর্ষ পূর্ণ করবেন তিনি।
চিনে নিতে
২১ সেপ্টেম্বর বিশ্ব আলঝাইমার’স দিবস, সেপ্টেম্বর মাসটাও পালিত হয় আলঝাইমার’স মাস হিসাবে। কোভিড-পীড়িত বিশ্বে স্বাস্থ্য-সঙ্কট তীব্রতর হতে পারে ‘ডিমেনশিয়া’র জন্য, মত বিশেষজ্ঞদের, তাঁরা বলছেন কোভিড ও আলঝাইমার’সের সম্পর্ককে গুরুত্ব দিতে, গবেষণায় ইঙ্গিত— কোভিডের স্নায়বিক প্রভাব ডিমেনশিয়ার উপসর্গ বাড়িয়ে দিতে পারে। আলঝাইমার’স নিয়ে বিশেষত কোভিডকালে সচেতনতা বাড়াতে আগামী কাল আন্তর্জাল-আলোচনার আয়োজন করেছে আলঝাইমার’স অ্যান্ড রিলেটেড ডিসঅর্ডার্স সোসাইটি অব ইন্ডিয়া (এআরডিএসআই) কলকাতা ও কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট। ২১ তারিখ হাওড়া ব্রিজ রঞ্জিত হবে প্রতিষ্ঠানের প্রতীকী রং— নীলে।
মনে রেখে
গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজবাড়ির অবন গ্যালারির পাশের ঘরটা ছিল ক্রাফ্ট বিভাগের স্টাফ রুম। বিভাগের প্রধান ছিলেন ভাস্কর অনীট ঘোষ। চিন্তামণি করের ছাত্র তিনি, শিক্ষকতা শুরু হিন্দু স্কুলে, ১৯৮২-তে আর্ট কলেজে যোগদান, ছিলেন অধ্যক্ষও। ছাত্রদরদি শিক্ষক, দক্ষ প্রশাসকও। ধাতব পাতে গড়তেন নব্যধারার ভাস্কর্য। দেশে-বিদেশে গড়েছেন বিবেকানন্দের মূর্তি, গোলপার্কে রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচারের সামনে ও উত্তর কলকাতায় বিবেকানন্দের বাড়ির সামনে স্বামীজির মূর্তি দু’টি তাঁরই গড়া। গত ২৪ অগস্ট চলে গেলেন বর্ষীয়ান এই শিল্পী। আজ বিকেল সাড়ে ৪টেয় তাঁর স্মরণ-অনুষ্ঠান নরেন্দ্রপুরে ভাস্কর ভবনে— সর্বভারতীয় চারুকলা মন্দির, ভাস্কর ভবন ট্রাস্ট ও অবগাহন সমিতি-র একত্র উদ্যোগে।
নিরাময়
অতিমারিতে বার বার রুদ্ধ মঞ্চ। সংসার ও চিকিৎসার দায় বইতে অন্য পেশার মুখাপেক্ষী হচ্ছেন নাট্যকর্মীরা। তাঁদের কথা মনে রেখেই ‘নিরাময়ে নাট্যজন’ আলোচনাসভা করছে ‘বোড়াই ইতি থিয়েটার’, আগামী কাল ১৯ সেপ্টেম্বর শিশির মঞ্চে, বিকেল ৫টায়। এর আগে প্রথম পর্যায়ের আলোচনার সুবাদে এসেছিল সাহায্য, ব্যবস্থা হয়েছিল চিকিৎসাযানেরও। দ্বিতীয় পর্বের আলোচনায় থাকবেন চপলকুমার ভাদুড়ী, চন্দন সেন, অসিত বসু, দীনেশ পোদ্দার প্রমুখ। অন্য দিকে, সঙ্কটকালেও নাট্যশিল্পের সঞ্জীবনে উদ্যোগী নিরঞ্জন সদনের নাট্যবন্ধুরা। ‘নাট্যবোধ’ কর্মশালায় ৩২ জন শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দেবেন অরুণ মুখোপাধ্যায়, মেঘনাদ ভট্টাচার্য, গৌতম হালদার, দেবশঙ্কর হালদার প্রমুখ। ২০-২৬ সেপ্টেম্বর, দুপুর ১টা-রাত ৮টা। নভেম্বরে অন্তরঙ্গ নাট্যমেলা, জানুয়ারিতে প্রসেনিয়াম নাট্যোৎসবের ভাবনাও রয়েছে।
সুধাকণ্ঠ
‘আনন্দ বিলাও তুমি/ না করি কার্পণ্য।/ সুধা কণ্ঠে সুধাগীত/ শুনি হই ধন্য।’— তাঁকে আশীর্বাদ করেছিলেন ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী। রবীন্দ্রসঙ্গীতে যতি বিন্যাসে অসামান্য দক্ষতা, গলা ছেড়ে গান গাওয়া, গলায় টপ্পার দানার সংযত ব্যবহারে অনন্য কিংবদন্তি তিনি— সুচিত্রা মিত্র। ১৯ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্মদিন, ফেসবুকে টরন্টোর ‘অপার বাংলা’-র সুচিত্রা-স্মরণানুষ্ঠান ও ২০ তারিখ রাত ৮টায় বাহরিনের ‘ছন্দোবন্ধন’-এর অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত এ শহরের ‘মুক্তধারা শিল্পী গোষ্ঠী’। সুচিত্রা মিত্রই নাম রেখেছিলেন এই গানের দলের, মুক্তধারা-র কর্ণধার নমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় সুচিত্রা মিত্রের নিবিড় সান্নিধ্যধন্য। অন্য দিকে, ১৮-২০ সেপ্টেম্বর তিন দিন ব্যাপী ‘সুচিত্রা মিত্র উৎসব’ হবে আন্তর্জালে, ‘পূরবী’-র উদ্যোগে, শিল্পীর দীর্ঘ দিনের ছাত্রী ও গানসঙ্গী মন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায়।
নিজের ভাষায়
সারা জীবন শিল্পের সাধনা করে গিয়েছেন প্রচারের আলোর অনেক দূরে থেকে। তৈরি করেছেন নিজস্ব এক শিল্পভাষা। শিল্পী যোগেন চৌধুরীর মতে অমল চাকলাদার (১৯৩৬-২০২১) এক অসাধারণ সংবেদনশীল ও মৌলিক শিল্পী, বেঙ্গল স্কুলের অন্য শিল্পীদের থেকে আলাদা। কলকাতার গভর্নমেন্ট কলেজ অব আর্ট অ্যান্ড ক্রাফ্টে ১৯৬০-এ স্নাতক, সহপাঠী ছিলেন গণেশ পাইন, লালুপ্রসাদ সাউ। পরে সেখানেই শিক্ষক। নিয়ো বেঙ্গল স্কুল অব আর্ট-এর অগ্রযাত্রায় টেম্পারা চিত্রকলার পুনরুজ্জীবনে তাঁর বিশেষ অবদান, সদস্য ছিলেন ‘ক্যালকাটা পেন্টার্স’-এরও। ১৯৬৮ সালের কলকাতায় তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনী, পরে দেশ জুড়ে বহু প্রদর্শনীতে গিয়েছে তাঁর ছবি, বিদেশে আছে তাঁর ছবির সংগ্রহ। ভূষিত পুরস্কার, সম্মানেও। চলে গেলেন গত ২১ জুলাই, এ শহরের ডিজিটাল শিল্প-পরিসর ‘আর্টওয়েভ ইন্ডিয়া’ তাদের পথ চলার এক বছর পূর্তিতে আয়োজন করেছে তাঁরই ছবির প্রদর্শনী। ‘ন্যারেটিভ ইমপালস: আ জার্নি টু ট্র্যাঙ্কুইলিটি’ দেখা যাবে সংস্থার ওয়েবসাইটে, নভেম্বর পর্যন্ত। আছে জীবনের বিভিন্ন পর্বের কাজ, বেছে দিয়েছিলেন শিল্পী নিজে। নীচের ছবিতে তারই একটি।
নতুন করে
বাংলার তন্তুবায়দের জন্য পত্রিকা। উদ্দেশ্য: তাঁদের জীবন, সঙ্কট ও সম্ভাবনা তুলে ধরা। চার দশক আগে, ১৯৮০ সালে ফুলিয়া থেকে প্রকাশিত হয় টানা পোড়েন, হরিপদ বসাকের সম্পাদনায়, বলরাম বসাকের যোগ্য সঙ্গতে। চলেছিল আঠারো বছর ধরে, কিন্তু মাসিক থেকে ত্রৈমাসিক, ষাণ্মাসিক হয়েও শেষরক্ষা হয়নি, বন্ধ হয়ে যায় ক্রমে। অথচ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ, প্রতিবেদন ও প্রবন্ধগুলি একটি নির্দিষ্ট কালপর্বে তাঁতশিল্প সংক্রান্ত তথ্যের সমৃদ্ধ ভান্ডার, ফুলিয়া তথা বাংলার তাঁতশিল্পের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিলও। ১৯৯৮ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়া সেই পত্রিকাই ফের শুরু হয়েছে ফুলিয়াবাসী শিক্ষক নিলয় কুমার বসাকের উদ্যোগে। নব পর্যায়ে প্রথম বছরের প্রথম সংখ্যায় (ছবিতে প্রচ্ছদ) আছে প্রবন্ধ, প্রতিবেদন, ছোটগল্প, কবিতা এমনকি গানও, সবই তাঁত ও তাঁতশিল্পীদের নিয়ে। চলছে শারদ সংখ্যা প্রকাশের প্রস্তুতিও
বাঁশি কেন
নন্দনে ইভনিং শো-শেষের গাছতলা। চা-তেষ্টা। লোকের ভিড় নেই, রবীন্দ্র সদন অন্ধকার। ভ্রাম্যমাণ চা-ওয়ালার থেকে নেওয়া চায়ে ধীরেসুস্থে চুমুক দিতেই তীক্ষ্ণ বাঁশির আওয়াজ শুনে চমকে ওঠা। এই পুলিশি বাঁশি চেনা, আগে ঢাকুরিয়া লেক, বিবেকানন্দ পার্ক চত্বরে কোনও প্রেমীযুগল একটু ঘন হয়ে বসলেই বেজে উঠত, অন্ধকার চিরে ঠিকরে বেরোত জোরালো টর্চের আলো। অতিমারিতে এখন নন্দন চত্বরে প্রেমিক-প্রেমিকার কলতান দূর অস্ত, কিন্তু ফিরে এল বংশীধ্বনিটি। মর্মার্থ, সাতটা বেজে গিয়েছে, এ বার উঠে পডুন। এই শহরে কিছুই হারায় না।