৭ই ডিসেম্বর, শনিবার, ১৮৭২ খৃঃ অব্দ বঙ্গালীর পব্লিক্ ষ্টেজের একটি স্মরণীয় দিন,” স্মৃতিকথায় লিখছেন অমৃতলাল বসু। “একটি জানালায় টিকিট বিক্রয় করা হইয়াছিল। দলে দলে দর্শক আসিতে লাগিল। এত ভিড় হইবে আমরা কখনও কল্পনা করিতে পারি নাই। সকলে টিকিট পাইল না।... অভিনয় আরম্ভ হইল...করতালি-ধ্বনিতে বৃহৎ অট্টালিকা কম্পিত হইতে লাগিল।” দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকের অভিনয় হয়েছিল ৩৬৫ আপার চিৎপুর রোডে মধুসূদন সান্যালের বাড়িতে (জোড়াসাঁকোর ‘ঘড়িওয়ালা বাড়ি’ বলে খ্যাত), ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’-এর উদ্যোগে; নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মতিলাল সুর, রাধামাধব কর, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি, অমৃতলাল বসু, ক্ষেত্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখের কীর্তি। কলকাতায় সাধারণ রঙ্গালয়ের পথ চলারও আনুষ্ঠানিক শুরু, বঙ্গীয় নাট্যশালার ইতিহাস-এ যে প্রসঙ্গ লিখেছেন ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, গোড়ায় গিরিশচন্দ্র ঘোষের মতভেদ ও পরে যোগদানের কথাও। মানুষ টিকিট কেটে নাটক দেখছেন, শহরে তুমুল হইচই, খবরের কাগজে আলোচনা, ইংরেজ শাসকের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া... সব মিলিয়ে এ ছিল ‘ঐতিহাসিক’ এক ঘটনা। সাধারণ তথা পেশাদার রঙ্গালয় তার পর অনেক পথ পেরিয়েছে, জ্বলে উঠেছে, ফুরিয়েও গিয়েছে, তবু এ বাংলার নাট্য তথা সংস্কৃতি-ইতিহাসে তার গুরুত্ব কম নয়।
দেড়শো বছর পরে আর এক ৭ ডিসেম্বর সমাগত, সাধারণ রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠার সার্ধশতবর্ষ পালন করছে ‘বঙ্গ নাট্য সংহতি’, কলকাতা তথা বাংলার নাট্যব্যক্তিত্ব, শিল্পী ও কর্মীদের সম্মিলনে ১৯৯১ সালে গড়ে ওঠা কল্যাণমূলক সংস্থা। বর্ষব্যাপী উদ্যাপন, ৬ ডিসেম্বর দুপুর দুটোয় গিরিশ ঘোষের বাড়ি থেকে শুরু হবে শোভাযাত্রা, অনুষ্ঠানের উদ্বোধন তপন থিয়েটারে বিকেল ৫টায়। এই মঞ্চেই বছরভর দেখা যাবে সাধারণ রঙ্গালয়ে অভিনীত তেরোটি নাটকের নব-মঞ্চায়ন, এই সময়ের তেরো জন পরিচালকের হাতে। ৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় মামুনুর রশীদের পরিচালনায় নীলদর্পণ দিয়ে শুরু, আগামী ১৪ জানুয়ারি দেবাশিসের নির্দেশনায় নুরজাহান। ২০২৩-এর ফেব্রুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতি মাসের প্রথম শনিবার হবে একটি করে নাটক: অপূর্ব সতী (নির্দেশনা: ঈশিতা মুখোপাধ্যায়), ব্যাপিকা বিদায় (অসিত বসু), রজনীগন্ধা (বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়), মানময়ী গার্লস স্কুল (সীমা মুখোপাধ্যায়), জমিদার দর্পণ (পলক চক্রবর্তী), একেই কি বলে সভ্যতা? বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ (কিশোর সেনগুপ্ত), অলীকবাবু (সন্দীপ ভট্টাচার্য), কারাগার (কৌশিক চট্টোপাধ্যায়), আবুহোসেন (আশিস চট্টোপাধ্যায়), নামজীবন (দেবশঙ্কর হালদার) ও চিরকুমার সভা (তুলিকা দাস)। এ ছাড়াও হবে আলোচনা, পাঠ-অভিনয়, নৃত্যগীতানুষ্ঠান, প্রদর্শনীর আয়োজন। ছবিতে সাধারণ রঙ্গালয়ের শতবর্ষে, ১৯৭২ সালের ৭ ডিসেম্বর নীলদর্পণ নাটক অভিনয়ের দৃশ্য।
রাগ রামমোহন
গত বছর থেকে নানা কর্মসূচি ও অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রাজা রামমোহন রায়ের (ছবিতে এ শহরে তাঁর মূর্তি) সার্ধদ্বিশতবর্ষ পালন করে আসছে ‘রামমোহন রায় পুনর্মূল্যায়ন সমিতি’। গত মে মাসে এক আন্তর্জাতিক আলোচনাসভা ও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতানুষ্ঠানে ফুটে উঠেছিল রামমোহনের জীবন, বিশেষত তাঁর সঙ্গীতকৃতি। সেই ধারাতেই এ বার এই সমিতি ও নবরস স্কুল অব পারফর্মিং আর্টস-এর যৌথ প্রয়াস— বিশিষ্ট লেখক ও সঙ্গীতজ্ঞ অমিত চৌধুরীর নিবেদনে ‘রাজা রামমোহন: দ্য খেয়াল অ্যান্ড দ্য রাগ অ্যাজ় নিউ ওয়েজ় অব থিঙ্কিং’। রাগসঙ্গীত ও খেয়ালকে নিরীক্ষণের মাধ্যম হিসাবে আলোচনা, এবং শিল্পীর সৃষ্ট ‘রাগ রামমোহন’-এর পরিবেশনা এই অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ। হারমোনিয়াম ও তবলা সঙ্গতে থাকবেন হিরণ্ময় মিত্র ও বিভাস সঙ্ঘাই। ৫ ডিসেম্বর, সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় আইসিসিআর-এর সত্যজিৎ রায় প্রেক্ষাগৃহে।
দেওয়া নেওয়া
অতিমারির কারণে গত দু’বছর বার্ষিক উদ্যাপন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারেনি ইন্দিরা শিল্পী গোষ্ঠী। এই সময়কালের মধ্যে বিদায় নিয়েছেন মনস্বী বাঙালিদের অনেকেই, বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও সঙ্গীতজ্ঞ সুধীর চক্রবর্তী যেমন। তাঁকে স্মরণ করে, তাঁরই লেখার আশ্রয়ে এ বারের বাৎসরিক অনুষ্ঠান এই সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের, ‘দেওয়া নেওয়া ফিরিয়ে দেওয়া’— রবীন্দ্রনাথের গানে দেওয়া-নেওয়ার ভাবনার নান্দনিক বহিঃপ্রকাশ। আগামী কাল, ৪ ডিসেম্বর আইসিসিআর-এর সত্যজিৎ রায় প্রেক্ষাগৃহে। পাঠে সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, গানে ইন্দিরা গোষ্ঠীর শিল্পীদের পাশাপাশি কিছু নতুন কণ্ঠও।
কেন বিমুখ
অর্থনৈতিক মন্দা, অসাম্য সত্ত্বেও বিভিন্ন দেশে শ্রমজীবী মানুষ ভোট দিচ্ছেন দক্ষিণপন্থী দলগুলিকে। তাঁর নতুন বইয়ে এর কারণ বিশ্লেষণ করেছেন বার্কলি বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির ইমেরিটাস অধ্যাপক প্রণব বর্ধন; তাঁর মতে উদারবাদী গণতন্ত্রের প্রতি এই বিরূপতার কারণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে মানুষের নিরাপত্তাহীনতা। আমেরিকার গ্রামের স্বল্পশিক্ষিত বয়স্ক মানুষ বা ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি-সমর্থক শিক্ষিত শহুরে যুবক, উভয়েই আঁকড়ে থাকতে চান চিরাচরিত প্রথা, জাত্যভিমান। ৯ ডিসেম্বর বিকেল ৪টেয় ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ় কলকাতা (আইডিএসকে)-র প্রতিষ্ঠাদিবস উপলক্ষে সল্টলেক ক্যাম্পাসে এ নিয়েই বলবেন প্রণববাবু, প্রকাশিত হবে নতুন বইটি। অন্য দিকে, মেয়েদের উপর পারিবারিক হিংসা নিয়ে আইডিএসকে-র এক গবেষণাসূত্রে মেয়েদের বেঁচে থাকার লড়াইকে স্থিরচিত্রে তুলে ধরেছেন চিত্রপরিচালক দেবলীনা, মিশ্রমাধ্যমে সঙ্গত করেছেন অর্চি রায়। আগামী ৭-৮ ডিসেম্বর দুপুর ৩টে-রাত ৮টা ছবিগুলি দেখা যাবে আইসিসিআর-এ অবনীন্দ্র গ্যালারিতে।
উৎসবের ছবি
ছোট ছবির জগতে আন্তর্জাতিক স্তরে কেমন কাজ হচ্ছে, এ শহরে তার খোঁজ এনে দেয় ‘কল্পনির্ঝর ইন্টারন্যাশনাল শর্ট ফিকশন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’— কল্পনির্ঝর ফাউন্ডেশন, গ্যোয়টে ইনস্টিটিউট ম্যাক্সমুলার ভবন ও কেয়ারিং মাইন্ডস-এর আয়োজন। দেখতে দেখতে কুড়ি বছর পেরিয়ে এল কলকাতার এই ছোট ছবির উৎসব, এ বারের উদ্যাপন ম্যাক্সমুলার ভবনে আগামী ৭ থেকে ১০ ডিসেম্বর। ছবি বাছাইয়ে বিশেষ ভাবনা ও যত্ন এই উৎসবের বৈশিষ্ট্য, এ বারও ব্যতিক্রম নয়— ‘বিশ্বের ছবি’ বিভাগে দেখা যাবে নানা দেশের ৫১টি ছবি, আলাদা করে জার্মানির ১১টি অ্যানিমেশন-ছবি, হামবুর্গের কুর্জ়ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত ৫টি ছবিও। ভারতের ন’টি ছোট ছবি রয়েছে প্রতিযোগিতা বিভাগে। ৭ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে ৪টেয় উদ্বোধন-অনুষ্ঠান।
দুই কবি
“যদি পারতুম একেবারে শূন্য হ’য়ে যেতে,/... তবে আমাকে প্রতি মুহূর্তে ম’রে যেতে হ’তো না/ এই বাঁচার চেষ্টায়...” লিখেছিলেন এক কবি। আর এক জন: “মানুষ কিভাবে মৃত হয়ে আছে, নিজেও জানে না।/ জানে না বলেই মৃত...” বিশ ও একুশ শতকের বাংলা কবিতাধারা প্রাণ পেয়েছে দুজনেরই কলমে। বুদ্ধদেব বসু ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়, দুজনেরই জন্মদিন চলে গেল সদ্য, নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে। দুই কবির স্মরণে এক অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিল দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় স্মৃতি সংসদ, গত ৩০ নভেম্বর সন্ধ্যায় পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি সভাঘরে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা তিতি রায়ের স্মৃতিচারণা ‘আমার বাবা’, দুই কবির লেখনীর বিশিষ্টতা নিয়ে সুজিত সরকারের আলোচনা, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছাত্রছাত্রীদের আবৃত্তি ও কাব্যনাটক পাঠে মেদুর সন্ধ্যা।
পথিকৃৎ
রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের (ছবিতে বাঁ দিকে) হাত ধরে ১৯২২ সালে মহেঞ্জোদড়ো আবিষ্কার পাল্টে দিয়েছিল ভারত-ইতিহাসচর্চার ধারা। সিন্ধু সভ্যতার এই পীঠভূমি আবিষ্কারের শতবর্ষ পূর্তি এ বছর; সিন্ধু সভ্যতা উৎখননের আরও এক মহারথী, প্রত্নতাত্ত্বিক ননীগোপাল মজুমদারের (নীচে ডান দিকের ছবি) জন্মেরও ১২৫ বছর। দুই পথিকৃৎকে স্মরণ করল শ্বেতদ্বীপ ইন্ডোলজিক্যাল ফাউন্ডেশন ও ‘বাঙলার মুখ’ প্রকাশন, গতকাল ২ ডিসেম্বর বিকেলে বেঙ্গল থিয়োসফিক্যাল সোসাইটি হল-এ। রাখালদাস-লিখিত দি ওরিজিন অব দ্য বেঙ্গলি স্ক্রিপ্ট বইটি পুনঃপ্রকাশিত হল এই উপলক্ষে, সঙ্গে ননীগোপাল মজুমদার স্মরণে দীপান ভট্টাচার্যের একটি বই— দুই মহারথীর নামাঙ্কিত সম্মাননায় ভূষিত হলেন দীপানবাবু। ছিলেন আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া-র প্রাক্তন মহানির্দেশক গৌতম সেনগুপ্ত, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৌত্র দেবাশীষ বন্দ্যোপাধ্যায়, ননীগোপাল মজুমদারের দৌহিত্র অঞ্জন মুখোপাধ্যায়-সহ বিশিষ্টজন।
সেবাব্রতী
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হাতে চিন আক্রান্ত হলে জওহরলাল নেহরু ও সুভাষচন্দ্র বসুর উদ্যোগে পাঁচ চিকিৎসকের একটি দল চিন যাত্রা করে, যুদ্ধক্ষেত্রে আহত চিনা সৈনিকদের শুশ্রূষায়। অন্য চার জন দেশে ফিরে এলেও দ্বারকানাথ শান্তারাম কোটনিস ভারতে ফিরতে পারেননি, সেবাকাজের মধ্যেই মৃত্যু ১৯৪২-এর ৯ ডিসেম্বর। এ বছর তাঁর প্রয়াণের আশি পূর্তি। তাঁর স্মৃতিরক্ষায় স্থাপিত ‘ডা. দ্বারকানাথ কোটনিস স্মৃতিরক্ষা কমিটি’ও এ বছর পঞ্চাশ পূর্ণ করল। মানুষের সেবা, সংস্কৃতি চর্চা, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী চেতনা প্রসারে নিয়োজিত এই সংগঠনের সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন চলছে বর্ষব্যাপী, কেন্দ্রীয় ভাবে ও শাখা সংগঠনগুলির উদ্যোগে। তারই অঙ্গ হিসেবে উত্তরপাড়া শাখার আয়োজনে আগামী ৯ ডিসেম্বর ‘কোটনিস দিবস’-এর মুখ্য অনুষ্ঠানটি ভারতসভা হল-এ বিকেল ৪টায়, ‘একবিংশ শতকের সাম্রাজ্যবাদ’ নিয়ে বলবেন রতন খাসনবিশ। উত্তরপাড়া গণভবনে ১৮ ডিসেম্বর সন্ধে ৬টায় ‘কোটনিস মাস থিয়েটার গ্রুপ’ অভিনয় করবে অমল রায় রচিত নাটক ইন্টারন্যাশনালিস্ট, বেদান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনায়। ছবিতে দ্বারকানাথ কোটনিস স্মরণে প্রকাশিত ডাকটিকিট।
মেলার বই
আন্তর্জাতিক কলকাতা পুস্তকমেলার দিন ঘোষণা হয়েছে আগেই, রাজ্য জুড়ে নানা জায়গায় লিটল ম্যাগাজ়িন আর সাহিত্যমেলারও বাদ্যি বেজেছে। তেমনই অনেক সুসংবাদের মধ্যে একটি: মহানগরে দশম বাংলাদেশ বইমেলা শুরু হয়েছে গতকাল ২ ডিসেম্বর থেকে, চলবে ১১ তারিখ পর্যন্ত, রোজ দুপুর ১টা থেকে রাত ৮টা। মেলা এ বার নতুন ঠিকানায়, কলেজ স্কোয়ারে— বাঙালির প্রিয় বইপাড়ায়। বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির আয়োজনে, কলকাতার বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশনের সহযোগিতায় মেলায় হাজির বাংলাদেশের ৭৫টি প্রকাশনার বিপুল বই-সম্ভার। লেখক পাঠক প্রকাশকের আড্ডা, আলোচনা, কবিতাপাঠ, আবৃত্তি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান... তারই মাঝে শীতশহরে প্রিয় বইয়ের ওম খুঁজে ফেরার মেলা।