নতুন সংসার পেতে মফস্সলে এসেছে মেয়েটি। টুকিটাকি জিনিস গুছিয়ে নেওয়া চলছে। শুধু বৃহস্পতিবারের সন্ধ্যায় খচখচ করে একটা পাঁচালির অভাব। ছোটবেলা থেকে মা-ঠাকুমার মুখে শুনে শুনেই মুখস্থ, তবু পুজো শেষে পাঁচালি কপালে ছোঁয়ানো না গেলে যেন মনে হয় কী একটা বাকি রয়ে গেল। এক দিন হঠাৎ কানে গেল, শিশুতোষ, ব্রতকথা আর পাঁচ ধরনের বইয়ের সঙ্গে লক্ষ্মীর পাঁচালিও হেঁকে যাচ্ছে ফেরিওয়ালা। তাকে ডেকে বই দেখল মেয়েটি। কিন্তু ছোটবেলার সেই লম্বা পাঁচালি কই, এ তো তিন পাতাতেই শেষ! ফেরিওয়ালা হেসে বুঝিয়ে বলে, শহরের ব্যস্ত জীবনে অত বড় পাঁচালি পড়ার সময় কোথায় এখন? ওই তিন পাতাতেই সব আছে।
কলকাতায় গত প্রায় সাত দশক ধরে লক্ষ্মীর পাঁচালি প্রকাশ করে আসা অপূর্ব দে জানালেন, সময়ের সঙ্গে নানা পরিবর্তন আনা হয়েছে পাঁচালির দৈর্ঘ্য ও ভাষায়। ‘শরৎপূর্ণিমা নিশি নির্মল গগন’ কোথাও হয়েছে ‘দোলপূর্ণিমার নিশি নির্মল আকাশ’। আবার এই শুরুর লাইন অন্যত্র হয়েছে ‘ফাল্গুনে বসন্ত ঋতু হইল প্রকাশ/ তাহে দোলপূর্ণিমার নির্মল আকাশ’। তবে মূল আখ্যানে ও রচনার পয়ার ছন্দে কোনও বদল হয়নি। আজ ছাপা বইয়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে ইউটিউবে কোটি কোটি মানুষ নিত্য শুনছেন এই পাঁচালি। অথচ লোকসাহিত্যের এই সমৃদ্ধ ধারাকে যাঁরা পুষ্ট করলেন, পাঁচালির সেই মূল রচয়িতাদের পরিচয় সম্পর্কে ইতিহাস নীরব। এমনকি ছয়-সাত দশক আগে যাঁদের কলমে পাঁচালির বয়ান আমূল সংস্কার হল, সেই নিবারণচন্দ্র দে বা কমলা দে’র সম্পর্কেও প্রায় কিছুই জানা যায় না।
তবে জানা যায় যে বদল হয়েছে শহরের পাঁচালি প্রকাশের জায়গার। পাঁচালির অন্যতম প্রকাশক ‘ওরিয়েন্ট লাইব্রেরি’-র আদি দোকান ছিল রবীন্দ্র সরণিতে। সেই এলাকাতেই বেণীমাধব শীল, তারাচাঁদ দাস অ্যান্ড সন্স এবং অন্যান্য পাঁচালি প্রকাশকরাও ব্যবসা করতেন। পুরনো প্রকাশকদের মধ্যে অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন, বাকিরা চলে এসেছেন শহরের গ্রন্থ-ব্যবসার ভরকেন্দ্র কলেজ স্ট্রিটে। শহরের বই ব্যবসার আদি কেন্দ্র চিৎপুর এখন অতীতের স্মৃতি। আর লক্ষ্মীর পাঁচালি জুড়েও তো অতীতস্পর্শই, নতুন-পুরনো মিলে বেশ কয়েকটি সংস্করণ খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায়, দুর্ভিক্ষ অন্নাভাবের পাশাপাশি একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাওয়া, রোজগারের জন্য ‘পরিযায়ী’ হওয়ার কথাও প্রতিফলিত সেখানে।আখ্যানের লিঙ্গবৈষম্য নজর এড়ায় না, আবার বিপর্যয় প্রতিরোধে সঞ্চয় বা কৃষিবীজ সংরক্ষণে মেয়েদের ভূমিকার কথাও নিহিত সেখানে। বাঙালির লোকজীবন জনজীবনের সৃষ্টি এই পাঁচালি, সন্ধ্যায় তুলসীতলায় প্রদীপ দেওয়া বা শাঁখ বাজানোর মতোই বহুচর্চিত সংস্কার। সম্পদের সর্বগ্রাসী চাহিদার বদলে ঋণবিমুক্ত থেকে দু’বেলা দু’মুঠো খাওয়ার স্বস্তিতে পূর্ণ ছিল যে জাতির সুখ, তা থেকে বহু দূর চলে এলেও আগামী কাল কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোয় সেই শিকড়েই আর এক বার ফিরিয়ে দেবে লক্ষ্মীর পাঁচালি। ছবিতে ১৮৮৩ সালে ‘ক্যালকাটা আর্ট স্টুডিয়ো’র ফোলিয়োয় মুদ্রিত লক্ষ্মী।
ধারা-ভাষ্য
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আদরের ‘ময়না’ তিনি, সব সময়ের সঙ্গী। অবনীন্দ্রের কনিষ্ঠ পুত্র মানীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নমিতা দেবীর বড় মেয়ে ধারা ভট্টাচার্য ঠাকুর। জন্ম ১৯৪২-এ, নাম রেখেছিলেন দাদামশাই-ই, জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই আঁকা শিখেছেন তাঁর কাছে। সাহস জুগিয়েছিলেন দাদামশাই: “হিজিবিজি কাগের ছা, এঁকে চল যা, তা/ আঁকতে আঁকতে পাকলে হাত, আঁকার হবে ধারাপাত।” শান্তিনিকেতনে পাঠভবন পেরিয়ে কলকাতায় সরকারি আর্ট কলেজে ভর্তি হন। প্রয়াণ ২০২০-র ডিসেম্বরে। লিখে গিয়েছেন গুপ্তুনিবাসে অবন-জীবনের অন্তরঙ্গ বয়ান, তা-ই এ বার প্রকাশিত হল গ্রন্থাকারে, অবন ঠাকুরের ময়না (প্রকাশক আর্কড ডট কো ডট ইন) নামে। স্মৃতিচিত্রণ, অবনীন্দ্রনাথের আত্মপ্রতিকৃতি-সম্বলিত দু’টি চিঠি (ছবিতে তার একটি), সঙ্গে ধারার নিকটজনের কথাও। ছোট্ট বই, গুরুত্বপূর্ণ তবু।
সময়ের আয়না
উৎসবের মরসুম, আনন্দ-আবহ, এ-ই কি সুসময় তা হলে? অন্তরে সায় মিলছে না, সমাজমন রাজনীতি ধর্ম সংস্কৃতির পরিসরেও সুপবন বইছে বলা যাচ্ছে না জোর দিয়ে, তা হলে? ‘এই দুঃসময়’ বিষয়-ভাবনায় মনের সেই ভাবই প্রকাশ করেছে এবং অন্যকথা পত্রিকার (সম্পা: বিশ্বজিৎ ঘোষ, জলধি হালদার) সাম্প্রতিক সংখ্যা। শুরুতেই হাসান আজিজুল হক শঙ্খ ঘোষ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় পল ফার্মারের স্মরণে নিবন্ধ— দরদি চিন্তকহীন এই বর্তমানই যে দুঃসময়ের নামান্তর! বিশিষ্টজনের লেখায় একগুচ্ছ প্রবন্ধ সম্পদ এ পত্রিকার— শিক্ষা স্বাস্থ্য কৃষি পরিবেশ, রাজনীতি ফ্যাসিবাদ মানবাধিকার এনআরসি, ধর্ম ইতিহাস সমন্বয়ভাবনা, শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর— যা কিছুই স্পর্শ করছে এই মুহূর্তের দেশ ও মনকে, তা নিয়ে। যুক্তিনিষ্ঠ অনুভবঋদ্ধ মননচর্চায় উত্তরণের অনুসন্ধান।
দেশভাগের ছবি
দেশভাগ যতটা উঠে এসেছে বাঙালির সাহিত্য ও চিত্রকলায়, চলচ্চিত্রে, বিশেষত পূর্ববঙ্গ তথা এখনকার বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তার স্থান তুলনামূলক ভাবে কমই। বাংলােদশের ও বাংলা ভাষার চলচ্চিত্র পরিচালক তানভীর মোকাম্মেল অবশ্য ব্যতিক্রম; চিত্রা নদীর পারে, স্বপ্নভূমি, সীমান্তরেখা বা রূপসা নদীর বাঁকে, তাঁর বহু কাহিনিচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্রেই দেশভাগের বেদনা। কলকাতায় গোর্কি সদনে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তানভীর বললেন সেই বেদনার ভাষাকেই ছবিতে ফুটিয়ে তোলার পশ্চাদ্ভাবনা, অনুসন্ধান ও অনুভবের কথা। শিল্পীর ভাবনায় ধর্ম থাকে না, থাকে মানুষ— মানুষেরই যন্ত্রণার কথা বলা, মানুষেরই জন্য, মানুষেরই সামনে। আগামী সপ্তাহে বেঙ্গালুরুতে ক্রাইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়েও বলবেন দেশভাগ নিয়ে, দেখানো হবে সীমান্তরেখা।
সংস্কৃত চর্চা
সংস্কৃত ভাষার কথা শুনলে অনেকে ভয় পান, বা কঠিন ভাবেন। অনুবাদে দুধের সাধ ঘোলে মেটাতে হয়। ধর্ম বা বর্ণের সঙ্কীর্ণ সীমানা-ভাবনায় রুদ্ধ এ ভাষার চর্চা আজ দৃশ্যমান নয় তত। ভাষা ও সাহিত্যপ্রেমী মানুষ সংস্কৃত শিখুন, সেই লক্ষ্যেই ভারত ও বহির্ভারতেও ১৯৮১ সাল থেকে কাজ করছে ‘সংস্কৃতভারতী’। সংস্কৃতের সরল সম্ভাষণাত্মক এবং শাস্ত্রীয়, দু’টি স্তরেই ভাষাচর্চার প্রসার লক্ষ্য এ প্রতিষ্ঠানের, তারই অঙ্গ দশ দিনের ‘সরল সংস্কৃত সম্ভাষণ শিবির’, প্রতিষ্ঠানের দক্ষিণ কলকাতা শাখার উদ্যোগে, আগামী ১১-২০ অক্টোবর, কবি নজরুল মেট্রোর কাছে করুণাময়ী পাঠচক্র ট্রাস্টে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা তো বটেই, নিঃশুল্ক এই কার্যক্রমে যোগ দিতে পারেন যে কোনও নাগরিক। সহজ শৈলীতে ভাষা শিক্ষা— শ্রবণ, কথন, পঠন ও লিখন, ভাষাশিক্ষার চার সোপান সহায়ে। করোনাকালেও আন্তর্জালে চলেছিল এ প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে সংস্কৃত চর্চা, দেশ-বিদেশের সংস্কৃতপ্রেমী মানুষের অংশগ্রহণে।
পরম্পরা
রবীন্দ্রসঙ্গীতের শুদ্ধতা পরম্পরাগত চর্চার অনুপম এক নিদর্শন। সেই বহমানতারই নব নমুনা, অগ্নিভ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সহমর্মীদের সঙ্গীতচর্চা প্রতিষ্ঠান ‘অভিজ্ঞান’-এর প্রয়াস ‘পারম্পর্য’। কবির ষাট বছর বয়সের মধ্যে লেখা ১৪২টি গানে সমৃদ্ধ, সম্প্রতি প্রকাশিত এই ডিভিডি-সঙ্কলনে আছে শিল্পী সুচিত্রা মিত্র গীত একটি গান, অগ্নিভ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে একটি, বাকি গানগুলি ১৪০ জন নবীন শিল্পীর কণ্ঠের, একটি করে। ‘ভবকোলাহল ছাড়িয়ে’, ‘বঁধুয়া, অসময়ে কেন’, ‘গাব তোমার সুরে’, ‘মধুর মিলন’-এর মতো একাধারে স্বল্পপরিচিত ও অন্য বহুচর্চিত গানে শিল্পী-জীবনের আবাহন নবীন গায়কদের কণ্ঠে। এমন নবীনবরণ শহরের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতায় নেই।
ঐতিহ্যের ‘ডাক’
১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৮০৯। ক্যালকাটা গেজ়েট-এ পোস্টমাস্টার জেনারেল জানাচ্ছেন, ডাক-মাধ্যমে মূল্যবান কিছু পাঠালে সরকার তার দায়িত্ব নেবে না। ডাকাতির ঘটনায় ডাকগাড়ি আক্রান্ত হওয়ায় কর্মীদের সুরক্ষার কথা ভেবে এই সিদ্ধান্ত। অবশ্য ব্যাঙ্ক নোটকে অর্ধেক করে কেটে আলাদা দিনের ডাকে পাঠানো যাবে। সে কালের ডাককর্মীদের পেশাগত ঝুঁকির আন্দাজ পাওয়া যায় এ খবর থেকে। ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে হেস্টিংস স্ট্রিট ও চার্চ লেনের সংযোগস্থলে কলকাতার প্রথম সাধারণ ডাকঘর গড়ে উঠেছিল, বেশ ক’টি ঠিকানা ঘুরে তা পরে উঠে আসে লালদিঘির পশ্চিম পাড়ে, ২৮টি কোরিন্থিয়ান স্তম্ভের উপর স্থাপিত, বিশাল গম্বুজ-শোভিত জেনারেল পোস্ট অফিস তথা জিপিও ভবনে। ২০১৮ সালে দেড়শো পূর্ণ করেছে কলকাতা জিপিও, আগামী কাল বিশ্ব ডাক দিবস এবং পরশু জাতীয় ডাক দিবসের প্রাক্কালে এ শহরের এই স্থাপত্যটির ইতিহাস ফিরে দেখলে মন্দ কী! ছবিতে ১৮৭০-এর কলকাতায় জিপিও ও ডালহৌসি চত্বর।
মাতৃভাষায়
‘বাংলা ভাষার শিক্ষার সংস্কৃতি’ ভাবনায় বাৎসরিক স্মারক বক্তৃতার সঙ্গে অক্ষয়কুমার দত্তকে (ছবিতে) সম্পৃক্ত করাটা ব্যতিক্রমী, বিস্মৃতির কুয়াশায় তিনি আচ্ছন্ন অনেক দিনই। আজকের বাঙালির শিকড়-ছেঁড়া স্রোতে ভাসা, ইংরেজি মাধ্যম আঁকড়ে ধরে জীবন সহজতর করার চেষ্টা, ‘ভাল আছেন তো?’ কুশল বিনিময়ের নিজস্ব আচারেরও ক্রমশ পিছু হঠা... এই বাস্তবের বিপরীতে তত্ত্ববোধিনী পাঠশালার শিক্ষকমশাইয়ের কণ্ঠ ভেসে আসে— শিক্ষার মাধ্যম হওয়া উচিত বাংলা। ব্রিটিশের কাছে এই অধিকার দাবি করেছিলেন তিনি। বিদ্যাসাগরের সঙ্গেই, দু’বছর আগে দ্বিশতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে এই মনীষীর, প্রাসঙ্গিক তিনি আজও। গত ১৮ সেপ্টেম্বর জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশন অ্যালামনি অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত ‘উপেন্দ্রনাথ দত্ত স্মারক বক্তৃতা’ হয়ে গেল স্কুল সভাগৃহে, অক্ষয়কুমার দত্তের বাংলা তথা মাতৃভাষায় বিদ্যাভ্যাস-অভিমত বিষয়ে বললেন মীরাতুন নাহার। আলোচনা শেষে ছিল প্রশ্নোত্তর পর্বও।
স্মরণে তিনি
ভূমিপুত্র, ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়কে স্মরণ করল উত্তরপাড়া, গত ১৮ সেপ্টেম্বর জয়কৃষ্ণ সাধারণ গ্রন্থাগারের সভাঘরে। উত্তরপাড়ার স্বাধিকার ও সম্প্রীতি রক্ষা মঞ্চের উদ্যোগ, সহযোগিতায় জয়কৃষ্ণ সাধারণ গ্রন্থাগার। উত্তরপাড়ার সঙ্গে তাঁর সংযোগসূত্রের কথা উঠে এল অনুষ্ঠানে, ব্রজদুলালবাবুর ইতিহাস চর্চায় প্রামাণ্য তথ্য ও যুক্তিনির্ভর লিপির ব্যবহার প্রসঙ্গে বললেন গৌতম সেনগুপ্ত ও কণাদ সিংহ। ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিহাস চর্চার বিপ্রতীপে ব্রজদুলালবাবুর বহুত্ববাদী ইতিহাস-ভাবনার প্রসঙ্গও উঠে এল; অসত্যের ব্যবহারে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসচেতনা গুলিয়ে দেওয়ার যে অপচেষ্টা চলছে এই সময়ে, তার বিরুদ্ধে শুভবোধসম্পন্ন নাগরিকের সতর্ক থাকার কথাও।