চেন্নাইকে জল দিতে পারে এই শহর, তা সত্ত্বেও সঙ্কটের আশঙ্কা

হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে জলের অপচয়ের ফলে ভূগর্ভস্থ জলস্তরের ক্রমাগত নেমে যাওয়া এবং বৃষ্টির জল পুনর্ব্যবহারে ব্যর্থতা, মূলত এই দুই কারণেই অদূর ভবিষ্যতে এ শহরে জলসঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করতে পারে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা।

Advertisement

দেবাশিস ঘড়াই

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০১৯ ০০:৫২
Share:

বৈপরীত্য: (১) শুকিয়ে গিয়েছে শহরের জলাধারগুলি। পানীয় জলের জন্য এলাকার কুয়োই এখন ভরসা চেন্নাইবাসীর। (২) কলকাতা শহরের আনাচকানাচে এ ভাবেই চলছে নাগাড়ে জল অপচয়। ওয়েলিংটনে রাস্তার পাশে। ছবি: এএফপি, নিজস্ব চিত্র

নিজের চাহিদা মেটানোর পরেও চেন্নাইকে প্রতিদিন জল দিতে পারে কলকাতা! কারণ, সেই পরিমাণ জলই প্রতিদিন উদ্বৃত্ত থাকে এ শহরে। তার পরেও দেশের ‘ওয়াটার স্ট্রেসড সিটি’-র সরণিতে জায়গা করে নিয়েছে এ শহর!

Advertisement

কারণ? হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে জলের অপচয়ের ফলে ভূগর্ভস্থ জলস্তরের ক্রমাগত নেমে যাওয়া এবং বৃষ্টির জল পুনর্ব্যবহারে ব্যর্থতা, মূলত এই দুই কারণেই অদূর ভবিষ্যতে এ শহরে জলসঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করতে পারে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা। ২০১৮ সালেই ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড’ (ডব্লিউডব্লিউএফ)-এর রিপোর্ট দেখিয়েছে, ‘ওয়াটার স্ট্রেসড সিটি’-র মাপকাঠির ভিত্তিতে প্রথম পাঁচটি শহরের মধ্যে চেন্নাই, হায়দরাবাদের সঙ্গে জায়গা করে নিয়েছে কলকাতাও। গত বছরে প্রকাশিত রিপোর্ট যে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি, তা চেন্নাইয়ের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিই বলছে। এখনই সতর্ক না হলে কলকাতাও জলের হাহাকারের সরণিতে দাঁড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে।

অথচ তথ্য বলছে, কোনও শহরে জনপ্রতি যে পরিমাণ জলের প্রয়োজন, এ শহরে তার উদ্বৃত্ত থাকে! কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের অধীনে ‘দ্য সেন্ট্রাল পাবলিক হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং অর্গানাইজেশন’ (সিপিএইচইইও)-এর নির্দেশিকা অনুযায়ী, দিল্লি, কলকাতা, মুম্বই-সহ মেট্রোপলিটন শহরগুলিতে দিনে মাথাপিছু ১৫০ লিটার জলের প্রয়োজন। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী কলকাতার জনসংখ্যা ৪৪ লক্ষ ৯৬ হাজার ৬৯৪। বর্তমানে জনসংখ্যা আনুমানিক ৫০ লক্ষ এবং আরও ১৫ লক্ষ লোক রোজ শহরে যাতায়াত করেন ধরলে প্রায় ৬৫ লক্ষ লোক রোজ জল পান করেন। সেই হিসেবে প্রতিদিন এ শহরে জলের চাহিদা ৯৭ কোটি ৫০ লক্ষ লিটার। সেখানে প্রতিদিন কলকাতা পুরসভা ২০২ কোটি লিটার জল উৎপাদন করে। অর্থাৎ, নিজেদের চাহিদা মিটিয়েও প্রায় ১০৪ কোটি লিটার জল উদ্বৃত্ত থাকছে। ১৫০ লিটার মাপকাঠির হিসেবে যার মাধ্যমে আরও প্রায় ৬৯ লক্ষ মানুষের, অর্থাৎ পুরো চেন্নাই তো বটেই, সঙ্গে নাগপুরেরও পানীয় জলের চাহিদা মেটানো সম্ভব! কারণ, ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী চেন্নাই ও নাগপুরের জনসংখ্যা যথাক্রমে ৪৬ লক্ষ ৪৬ হাজার ৭৩২ এবং ২৪ লক্ষ ৫ হাজার ৬৬৫।

Advertisement

তবুও শহরের একাংশে কেন পানীয় জলের সঙ্কট?

এই জলসঙ্কট ‘ম্যান মেড’ বা ‘মনুষ্যসৃষ্ট’! কলকাতা পুরসভার প্রাথমিক জল সমীক্ষায় এমনই তথ্য উঠে এসেছে। ন্যূনতম সচেতন না হয়ে জল খরচ করলে যে সঙ্কট তৈরি হয়, তা-ই হচ্ছে। পুরসভা সূত্রের খবর, এক থেকে ছয় নম্বর ওয়ার্ডে যে ‘ওয়াটার লস ম্যানেজমেন্ট প্রকল্প’ চালু হয়েছে, তাতে এখনও পর্যন্ত ৩৭৫১টি জলের মিটার বসেছে। তা থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, কোথাও ১৫০ লিটারের জায়গায় ৬০০ লিটার জল ব্যবহার হচ্ছে। অর্থাৎ, পরিবারে যদি চার জন সদস্য থাকেন, তা হলে ৬০০ লিটারের জায়গায় খরচ হচ্ছে ২৪০০ লিটার!

তথ্য বিশ্লেষণ করে এ-ও দেখা যাচ্ছে, রাস্তার ধারের কল থেকে অনেক বেশি জল নষ্ট হয় বাড়ির কলে। তার কারণ, বাড়ির কলের জল নষ্ট নিয়ে বেশির ভাগ নাগরিকের ন্যূনতম হেলদোল নেই। ফলে আগের দিনের অব্যবহৃত জল ‘বাসি’ বলে অনায়াসে যেমন ফেলে দেওয়া যায়, তেমনই বাড়ির জলাধারে জল ভরতে গিয়ে তা উপচে নষ্ট হওয়ার নজির তো আছেই। পুরসভার জল সরবরাহ বিভাগের এক কর্তার কথায়, ‘‘সাধারণ ধারণা, রাস্তার কলে বেশি জল অপচয় হয়। তাই জল নষ্ট বলতে চোখের সামনে রাস্তার পাশের কল থেকে জল বেরিয়ে যাওয়ার চিত্রই ফুটে ওঠে। সমীক্ষা বলছে, রাস্তার কল থেকে যে হেতু অনেক পরিবার জল নেয়, তাই সেখানে জল অপচয়ের সময়টা কম। কিন্তু বাড়ির কলে জল পড়তেই থাকে। তার কোনও হিসেব থাকে না!’’

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ওয়াটার রিসোর্স ইঞ্জিনিয়ারিং’ বিভাগের শিক্ষক পঙ্কজকুমার রায় বলছেন, ‘‘পানীয় জলের বোতল কিনলে এক ফোঁটাও যাতে নষ্ট না হয়, সে দিকে খেয়াল রাখি। কারণ, টাকা দিয়ে কিনছি। অথচ বিনামূল্যে পাচ্ছি বলে সমানে জল নষ্ট করছি! বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলির উপরে না হয় ভূগর্ভস্থ জল তোলার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি রয়েছে, কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে যে জল নষ্ট করে চলেছি, তাতে এখনই সতর্ক না হলে বড় বিপদ অপেক্ষা করছে!’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement