শিক্ষিকার চাকরি নিয়ে টানাপড়েনের পিছনে একটি পোশাক পরা ছবি রয়েছে বলে অভিযোগ। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
শুরু হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে সমবেত প্রতিবাদ। সাঁতারের পোশাকে একে একে নেটমাধ্যমে ছবি দিচ্ছেন বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত মহিলারা। সইসংগ্রহও করছেন কর্তৃপক্ষের ‘অন্যায়’-এর বিরুদ্ধে।
প্রতিবাদ কিসের?
এক শিক্ষিকাকে সহকারী অধ্যাপকের পদ ছাড়তে বাধ্য করেছেন কলকাতার এক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এমনই অভিযোগ।
কিন্তু সে জন্য সাঁতারের পোশাক কেন?
কারণ, সেই শিক্ষিকার চাকরি নিয়ে টানাপড়েনের পিছনে তেমনই একটি পোশাক পরা ছবি রয়েছে বলে অভিযোগ। কোনও শিক্ষিকার পোশাক কী ভাবে তাঁর যোগ্যতার প্রমাণ হতে পারে, সে প্রশ্ন তুলেছেন শহরের শিক্ষক, অভিনেতা থেকে মনোবিদ, চিকিৎসকেরা। কারও মনে হয়েছে, মহিলাদের পোশাক নিয়ে মন্তব্য করার অধিকার যেন যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। তাতে বদল আনা দরকার। তাই নিজের সুইম স্যুট পরা ছবি দিয়ে ধিক্কার জানিয়েছেন। কারও আবার বক্তব্য, পোশাক নিজের পছন্দের হবে। তা নিয়ে কেউ মন্তব্য করলে সে মানুষটির চিন্তার পরিসরই ছোট বলে প্রমাণিত হয়। কেউ আবার প্রশ্ন তুলছেন, একবিংশ শতকেও মহিলাদের পোশাক নিয়ে কী ভাবে কথা বলার অধিকার পান অন্য কেউ?
কিন্তু অধিকারের প্রসঙ্গ পর্যন্ত কী ভাবে গড়াল ঘটনা?
অভিযোগ, ইনস্টাগ্রামে সংশ্লিষ্ট শিক্ষিকার সাঁতারের পোশাক পরা ছবি ছিল। তা দেখতে পান এক ছাত্র। সেই ছবি ছেলে কেন দেখছে, তা নিয়ে আপত্তি তোলেন তার অভিভাবকেরা। শেষে ছাত্রের বাবার কাছ থেকে লিখিত অভিযোগ যায় নিউ টাউনের বিশ্ববিদ্যালয়ে। কর্তৃপক্ষ গুরুত্ব দিয়ে দেখেন গোটা বিষয়টি। শিক্ষিকার তরফে যে বয়ান পাওয়া যাচ্ছে, তাতে দাবি করা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নেটমাধ্যমে দেওয়া তাঁর ছবিগুলি ‘আপত্তিকর’ এবং ‘অনুপযুক্ত’ বলে মনে করেন। অভিযোগ, সেই ছবির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বদনাম’ হচ্ছে। সে কারণেই তাঁকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অবশ্য এই অভিযোগ মানেননি। তাঁদের তরফের দাবি, ওই শিক্ষিকা নিজেই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে গিয়েছেন। আবার শিক্ষিকার শিবিরের অভিযোগ, যে ভাবে তাঁকে সাত জনের সঙ্গে একটি ঘরে বসিয়ে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে, তাকে ‘হেনস্থা’ বলা উচিত।
বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর গত কয়েক দিন ধরেই অভিযোগকারিণী শিক্ষিকা এবং অভিযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে আনন্দবাজার অনলাইন। কিন্তু কোনও পক্ষই সাড়া দেয়নি। দুই শিবিরের পরিচিতদের বক্তব্য, ‘আইনি জটিলতা’-র কারণে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলা আপাতত স্থগিত রেখেছে দু’পক্ষই। দিল্লির ওই সংবাদমাধ্যমটি ছাড়া অভিযোগকারিণী কারও সঙ্গেই কথা বলেননি। এ বিষয়ে লেখাপত্র যা হয়েছে, সবই তাঁর পুলিশে দায়ের-করা অভিযোগের বয়ান থেকে সংগৃহীত।
অভিযোগকারিণী পার্ক স্ট্রিটের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ এবং পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন। গবেষণা করেছেন ইউরোপের দু’টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। নিউ টাউনের ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে পড়াতেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্রে দাবি, ওই ঘটনার পর তিনি রাজ্য ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষিকার ইনস্টাগ্রামের ছবি কোথা থেকে পেলেন, তা নিয়েও বিস্মিত অভিযোগকারিণী। গত বছরের ২৪ অক্টোবর এ বিষয়ে একটি অভিযোগ দায়ের করেন তিনি পূর্ব যাদবপুর থানায়। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, প্রথম বর্ষের এক ছাত্রের বাবা লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছিলেন তাঁর বিরুদ্ধে। পুলিশের কাছে অভিযোগে শিক্ষিকা দাবি করেন, নীল রঙের সাঁতার-পোশাক পরা দু’টি ছবি তিনি তাঁর ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে দিয়েছিলেন ২০২১ সালের জুন মাসে। তারও দু’মাস পরে তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজে যোগ দেন। ইনস্টাগ্রামের রীতি মেনে সেই ছবি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে উধাও হয়ে যাওয়ার কথা তাঁর প্রোফাইল থেকে। অক্টোবর মাসে তো কোনও ভাবে দেখা যাওয়ার কথাই নয়। দ্বিতীয়ত, তাঁর প্রোফাইলটি ‘প্রাইভেট’। তিনি অনুমতি না দিলে কারও দেখতেই পাওয়ার কথা নয় তাঁর কোনও ছবি।
কিন্তু অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি ঘরে শিক্ষিকাকে ডাকেন। সেখানে সাত জনের সামনে বসে তাঁকে সেই ছবির প্রিন্ট আউট দেখতে হয়। তাঁর অনুমতি ছাড়া সে ছবি ঘুরতে থাকে হাতে হাতে। প্রত্যেকেই কিছু না কিছু মন্তব্য করেন বলেও অভিযোগ।
শিক্ষিকার আরও অভিযোগ, বেআইনি ভাবে তাঁর নেটমাধ্যমের প্রোফাইল ‘হ্যাক’ করা হয়েছে। এবং তাঁর ব্যক্তিগত ছবি ওই ভাবে দেখানোয় তাঁর ‘যৌন হেনস্থা’ হয়েছে। অভিযোগ, শিক্ষিকাকে এমনও প্রশ্ন করা হয়েছে যে, তাঁর নিজের পরিবারের লোকজনও এমন পোশাক পরা ছবি আদৌ ভাল চোখে দেখেন কি না!
গত বছর ২৫ অক্টোবর তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের পদ থেকে ইস্তফা দেন। পরে তাঁর পুলিশি অভিযোগের কথা জানতে পেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য উত্তর দেন। সে বছরের নভেম্বর মাসের ১ তারিখ উপাচার্য লেখেন, ‘আপনি নিজেই চাকরি ছেড়েছেন...’। এমনই দাবি অভিযোগকারিণীর তরফে। এর পর মানহানির জন্য তাঁর বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তরফে ৯৯ কোটি টাকার মামলাও করা হয়েছে বলে দাবি।
সম্প্রতি দিল্লির এক সংবাদমাধ্যমে এ সংক্রান্ত একটি খবর প্রকাশিত হয়। তার পরেই চারদিকে শুরু হয়েছে প্রতিবাদ। পশ্চিমবঙ্গের গণ্ডি ছাড়িয়ে প্রতিবাদের ঝড় গিয়েছে অন্য রাজ্যেও। মুম্বইয়ের একটি কলেজের শিক্ষক মনোহর দুবে যেমন বলছেন, ‘‘নেটমাধ্যমে কোন ছবি দেব, সে তো একান্তই ব্যক্তিগত। কোনও শিক্ষকের কি ব্যক্তিগত জীবন বা পছন্দ থাকতে নেই?’’
এমন প্রশ্ন তুলেছেন আরও অনেকেই। কলকাতার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের পড়ুয়া বলেন, ‘‘আমরা যদি নিজেদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে সচেতন হতে পারি, তবে শিক্ষকরা আলাদা হবেন কেন? শিক্ষকরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে নিজেদের মতো থাকবেন। সে কথাই তো স্বাভাবিক। তা নিয়ে এত হইচই হওয়ার কারণ তো বুঝতে পারছি না!’’
এ যুক্তি নিউ টাউনের ওই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ক্ষেত্রে খাটে না বলে দাবি মিমি বিশ্বাস নামে এক তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীর। নিউ টাউনের ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ পার্ক স্ট্রিটে একটি কলেজও চালান। সেখানে পড়তেন মিমি। তিনি জানান, ওই কলেজে পোশাক নিয়ে অনেক কড়াকড়ি ছিল। মিমি বলেন, ‘‘২০০৮ সালে আমরা প্রতিবাদে নেমেছিলাম। কলেজে যে কত কড়াকড়ি! পার্ক স্ট্রিটে জল জমতই। এ দিকে, জিন্স গুটিয়ে ঢোকা যাবে না। কলেজের ভিতরে অতটা জলের মধ্যে দিয়ে জিন্স ভিজিয়ে হেঁটে যেতে হত। সারা দিন সে ভাবেই থাকতে হত। কোনও মেয়ে হাতকাটা জামা পরে এলে তাঁকে ৫০০ টাকা জরিমানা করা হত।’’
মিমির দাবি, সেই কর্তৃপক্ষের অধীনস্থ বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শিক্ষকদেরও এমন অবস্থা হতে পারে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তবে তাঁরা স্মারকলিপি দেওয়ার কথাও ভাবছেন। সেই কলেজের কয়েক জন প্রাক্তন পড়ুয়া ও শিক্ষক সইসংগ্রহ শুরু করেছেন বলে জানান মিমি।
তবে অনেকে মনে করছেন, বিষয়টি খুবই বড়। এটি বিশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোনও নির্দিষ্ট ঘটনার নিরিখে মাপা যায় না। রাজ্যের শিশুসুরক্ষা কমিশনের চেয়ারপার্সন অনন্যা চক্রবর্তী বহু দিন শিক্ষকতা করেছেন। তাঁর মতে, এই ঘটনা বহুবিস্তৃত পিতৃতান্ত্রিক ভাবনারই বিকাশ। অনন্যা বলেন, ‘‘আমি পোশাকবিধিতে বিশ্বাস রাখি না। মনে করি, নিজের ইচ্ছামতো পোশাক পরার অধিকার সকলের আছে। পিতৃতন্ত্র নারীদের নানা ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, সব ক্ষেত্রেই। কখনও পোশাক, তো কখনও আচরণ— সব বেঁধে দিতে চায়। এ ঘটনাও আসলে তেমন ভাবনারই বহিঃপ্রকাশ।’’
নানা আঙ্গিকে এই ঘটনার প্রতিবাদ হওয়া জরুরি বলে মনে করছেন কেউ কেউ। মনোসমাজকর্মী রত্নাবলী রায় উদ্যোগী হয়েছেন ছবি দিয়ে প্রতিবাদে। নিজের সাঁতারের পোশাক পরা ছবি নেটমাধ্যমে দিয়ে লিখেছেন ‘কাঁচকলা’। পাশাপাশি ডাক দিয়েছেন অন্য মেয়েদেরও। সাড়াও মিলেছে বিভিন্ন স্তর থেকে। মনোবিদ থেকে অভিনেত্রী, নানা জনে একই ভাবে নিজেদের ছবি দিয়েছেন। আনন্দবাজার অনলাইনকে রত্নাবলী বলেছেন, ‘‘শিক্ষকদের কেন দেবতার মতো হতে হবে? আমাদের স্কুলে এক ভূগোল শিক্ষিকা ছিলেন। বেশ লাস্যময়ী ছিলেন তিনি। নিয়মিত সরু হাতকাটা ব্লাউজ পরে ক্লাসে আসতেন। তাঁকে দেখার জন্য গেটে ছেলেদের ভিড়ও জমত। কিন্তু সত্তরের দশকেও তো সেই শিক্ষিকার পোশাক নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি স্কুল কর্তৃপক্ষ। বরং তাঁর যোগ্যতা দিয়েই বিচার করেছেন তাঁকে।’’ রত্নাবলীর বক্তব্য, ‘‘আমাদের চাউনি এবং চোখও তার ফলে প্রাপ্তমনস্কতা পেয়েছিল। হঠাৎ, কে কী পোশাক পরলেন, তা কবে থেকে শিক্ষকের যোগ্যতাপ্রমাণের মাপকাঠি হয়ে গেল?’’
ছাত্র-শিক্ষক বা এ ধরনের যে কোনও সম্পর্ককে ‘পর্নোগ্রাফিক’ মাত্রা দেওয়া এক প্রকার সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করেন রত্নাবলী। তাঁর কথায়, ‘‘সমাজের একটি অংশ ঈক্ষণকাম সুখ পাচ্ছে এর মাধ্যমে। শিক্ষা যবে থেকে পণ্য, ‘অশ্লীলতা’ তবে থেকে শুরু। ফলে ছাত্রের অভিভাবক পয়সার বিনিময়ে শিক্ষা কেনার শর্তে শিক্ষকের আচরণবিধিকেও নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছেন।’’ এই বিষাক্ত অভিভাবকত্ব কি কম অশ্লীল, প্রশ্ন তুলছেন এই মনোসমাজকর্মী।