পার্কের নাম লেখা ইংরেজিতেই। বৃহস্পতিবার। নিজস্ব চিত্র।
বাংলায় কাজ করতে গেলে বাংলা জানতেই হবে। বুধবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই মন্তব্য ঘিরে রাজ্য প্রশাসন তো বটেই, কলকাতা পুর প্রশাসনের অন্দরেও আলোচনা শুরু হয়েছে। পুরকর্তাদের একাংশ মনে করছেন, আসন্ন পুরভোটের আগে শহরের ‘বাঙালিয়ানা’ এবং বাংলা ভাষার ঐতিহ্যকে উস্কে দিতে চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাই এমন এক ‘সন্ধিক্ষণে’ তাঁর এই মন্তব্য। অনেকে আবার এর মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর সাম্প্রতিক মহারাষ্ট্র সফরের ‘প্রভাব’ও খুঁজে পেয়েছেন। কারণ, সেখানে মরাঠি ভাষারই প্রাধান্য। অনেকে আবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন, মুম্বইয়ে কী ভাবে মুখ্যমন্ত্রী ‘জয় মরাঠা, জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়েছেন।
তবে এর সঙ্গে রাজনীতিকে জড়াতে নারাজ পুর প্রশাসনের আর একটি অংশ। তাঁরা কলকাতা পুর প্রশাসনের আড়াই বছর আগের এক সিদ্ধান্তের প্রসঙ্গ টেনে আনছেন। তাঁদের বক্তব্য, রাজ্য যে প্রশাসনিক তরফে বাংলা ভাষাকে অগ্রাধিকার দিতে চায়, তা পুর প্রশাসনের ওই সিদ্ধান্তেই স্পষ্ট ছিল। যেখানে শহরের সব রাস্তার নামফলকে বাধ্যতামূলক ভাবে প্রথমে বাংলায় সংশ্লিষ্ট রাস্তার নাম লেখার কথা বলা ছিল। তার নীচে থাকবে ইংরেজি। রাস্তার নামের ক্ষেত্রে এই দুই ভাষাকেই গুরুত্ব দিতে হবে, সেই সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবও তৎকালীন মেয়রের কাছে জমা পড়েছিল।
পুরকর্তাদের একাংশ জানাচ্ছেন, সে বারই প্রথম নয়। ওই প্রস্তাবেরও আগে শহরে বাংলাকে অগ্রাধিকারের প্রসঙ্গটি পুর কর্তৃপক্ষের আলোচনার স্তরে উঠে এসেছিল। সেই কারণে ২০১৭-র ২৩ মে পুর কর্তৃপক্ষ একটি নির্দেশিকা জারি করে বলেছিলেন— রাস্তার নামফলকের জায়গায় অনেক সময়েই বাংলা থাকছে না। থাকছে অন্য ভাষা। তাই কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত হল, সংশ্লিষ্ট সমস্ত ফলকে অন্য ভাষার সঙ্গে বাধ্যতামূলক ভাবে বাংলাও রাখতে হবে। তা ছাড়া ফলকে শুধুমাত্র রাস্তার নাম, ওয়ার্ড নম্বর এবং পুরসভার প্রতীক থাকতে হবে। অন্য কোনও তথ্য থাকলে চলবে না।
পুরকর্তাদের বক্তব্য, অনেক সময়েই রাস্তার নামফলকে সৌজন্যে কোনও না কোনও কাউন্সিলরের নাম উল্লেখ থাকে। সেখানে রাস্তার নাম জানানোর থেকেও ওই এলাকার নির্বাচিত প্রতিনিধির নাম জানানো, আদতে তাঁর নিজের প্রচারটাই যেন ‘মুখ্য’ হয়ে ওঠে। ২০১৭ সালের সেই নির্দেশিকাই পরবর্তী কালে প্রস্তাব আকারে গৃহীত হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট প্রস্তাব গ্রহণের কিছু দিন পরে এই নিয়ে তোড়জোড় চলেছিল। সেই অনুযায়ী শহরের অনেক জায়গাতেই বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায় রাস্তার নামের ফলক লাগানো হয়েছে বলে পুরসভা সূত্রের খবর। কিন্তু নির্দেশিকায় এবং পরবর্তী কালে প্রস্তাবে যে ভাবে বাধ্যতামূলক ভাবে বাংলা ভাষাকে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছিল, তা এখনও শহরের সমস্ত জায়গায় করে ওঠা গিয়েছে কি না, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে বলে জানাচ্ছেন পুরকর্তাদেরই একাংশ।
শুধু তা-ই নয়, কলকাতা পুরসভার ওয়েবসাইটে ক্লিক করলে ‘ডিফল্ট’ হিসাবে প্রথমে ইংরেজিই আসবে, বাংলা নয়। বাংলা সেখানে ‘দ্বিতীয় ভাষা’! সে কারণে ‘কনটেন্ট’-এর ক্ষেত্রে প্রথমে ইংরেজি, তার পরে কেউ চাইলে প্রথম পেজে ‘বাংলা’য় ক্লিক করে বাংলা ‘কনটেন্ট’ পেতে পারেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে পুরকর্তাদের একাংশ জানাচ্ছেন, রাস্তার নামফলকে বাংলাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রস্তাব কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে, সেটা প্রশ্নযোগ্য ঠিকই। তবু সেখানে ভাষার ক্ষেত্রে প্রথমে বাংলা, পরে ইংরেজিতে রাস্তার নাম লেখার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু ওয়েবসাইট, যা বহু মানুষ দেখেন, (যেমন, বৃহস্পতিবার মোট ‘ভিজ়িটর’ দেখিয়েছে প্রায় ৫৩ লক্ষ) সেখানে আগে বাংলা, তার পরে ইংরেজি করলে বিষয়টি যুক্তিযুক্ত হত।
তবে বাংলা ভাষাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার মুখ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছেন অনেকেই। ভাষাবিদ সুভাষ ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘পৃথিবীর অনেক দেশেই এখন বাংলা শেখার আগ্রহ দেখা দিয়েছে। অথচ, আমাদের রাজ্যে আমরা বাঙালিরা এখনও বাংলা ভাষাকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিই না। শুধু বাঙালির কথাই বা বলব কেন? এই রাজ্যে যাঁরাই বসবাস করেন, বাংলা তো তাঁদেরও শিখে নেওয়া উচিত। বাংলা ভাষা ছাড়া বাঙালির সংস্কৃতিকে কতটুকু বোঝা যায়?’’ তবে এরই মধ্যে এক পুরকর্তার সতর্ক মন্তব্য, ‘‘ভাষা-বিপ্লব যেন নির্দেশিকা, প্রস্তাবে শুরু আর সেখানেই শেষ না হয়ে যায়! তবে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ভোট-বাজার যে কিছু দিন বাংলায় সরগরম থাকবে, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।’’