KMC Election 2021

KMC Election 2021: ‘জঞ্জালের জরিমানা দেব, তবু নোংরা করার অভ্যাস ছাড়ব না!’

জঞ্জাল ব্যবস্থাপনাকে সুসংহত রূপ দিতে অন্য পুর কর্তৃপক্ষের মতোই কলকাতার পুর কমিশনারকেও নির্দেশ দিয়েছিল কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ

Advertisement

দেবাশিস ঘড়াই

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২১ ০৬:০৪
Share:

যত্রতত্র: জঞ্জাল ফেলা হতে হতে কার্যত ভ্যাটের চেহারা নিয়েছে রাস্তার একাংশ। বিধান সরণিতে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

২০১৫ সালের ৯ অক্টোবর। দেশের অন্যান্য পুর কর্তৃপক্ষের মতোই কলকাতার পুর কমিশনার একটি চিঠি পেয়েছিলেন। প্রেরক, কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। চিঠির মূল নির্যাস ছিল— ‘মিউনিসিপ্যাল সলিড ওয়েস্ট (ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড হ্যান্ডলিং)’ রুলস ২০০০’ জারির ১৪ বছর পরেও চূড়ান্ত ‘অবৈজ্ঞানিক’ জঞ্জাল সাফাই ব্যবস্থার জেরে দেশের নাগরিকের প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত। প্রতিদিন এ দেশে উৎপন্ন ১,৪৩,৪৯৯ টন জঞ্জালের মধ্যে মাত্র ৩৮,৭৭১ টনের প্রক্রিয়াকরণ হয়। সে কারণেই যত্রতত্র জঞ্জাল পড়ে থাকে।

Advertisement

সামগ্রিক জঞ্জাল ব্যবস্থাপনাকে সুসংহত রূপ দিতে অন্য পুর কর্তৃপক্ষের মতোই কলকাতার পুর কমিশনারকেও নির্দেশ দিয়েছিল কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। একই সঙ্গে প্রতি বছর ৩০ জুনের মধ্যে ওই ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বার্ষিক রিপোর্ট রাজ্য সরকারের কাছে জমা দেওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়েছিল।

ওই চিঠি আসার পর থেকে গত ছ’বছরে শহরের উৎপন্ন প্রায় এক কোটি টন বর্জ্য ধাপায় পড়েছে। যার মধ্যে ৭৪,৫৯,০৫০ টন বর্জ্য ২০১৫-২০১৯ সালের মধ্যে প্রক্রিয়াকরণ করা হয়েছে বলে কলকাতা পুরসভার এক অন্তর্বর্তী রিপোর্ট জানাচ্ছে। পুর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নিয়ম মানা হচ্ছে কি না, সে সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট আবার কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ গত সোমবার জাতীয় পরিবেশ আদালতে পেশ করেছে। সেই রিপোর্ট বলছে, কলকাতায় উৎপন্ন দৈনিক সাড়ে চার হাজার টন বর্জ্যের মধ্যে মাত্র ৫১৫ টনের প্রক্রিয়াকরণ হয়, বাকি ৩৯৮৫ টন বর্জ্যের প্রক্রিয়াকরণ হয়ই না। ফলে রিপোর্টের ভাষায়, এই পরিমাণ বর্জ্যের প্রক্রিয়াকরণে ‘ফাঁক’ (গ্যাপ ইন সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট) রয়ে গিয়েছে।

Advertisement

যে কারণে শুধুমাত্র বায়ুদূষণ রোধে ব্যর্থ হওয়ার জন্যই নয় (২০১৬ সালে পরিবেশ আদালতে জরিমানা হয়েছিল রাজ্যের), শহরের অন্য ভাগাড়, গার্ডেনরিচে জঞ্জাল প্রক্রিয়াকরণের বিধি না মানায় মাসে ১০ লক্ষ টাকা করে খেসারত দিতে হচ্ছে পুরসভা তথা রাজ্য প্রশাসনকে। সেখানে ১৮ একর জমিতে প্রায় দেড় লক্ষ টন স্তূপীকৃত জঞ্জাল রয়েছে।

খেসারতের কারণ, পরিবেশ আদালতের নির্দেশ মতো সেখানে বায়ো-রেমিডিয়েশন (সজীব বস্তু ব্যবহার করে মাটি, জল বা এলাকার দূষণ কমানোর প্রক্রিয়া) এখনও চালু করা যায়নি।

পুর প্রশাসনের দাবি, গার্ডেনরিচে ওই পদ্ধতি খুব শীঘ্রই চালু হবে। প্রস্তাবিত ওই প্রকল্পের খরচ সাড়ে আট কোটি টাকা। তবে তার আগে পর্যন্ত বরাবরের মতোই কলকাতা পুর এলাকার সমস্ত বর্জ্যের ভার ধাপাকেই নিতে হচ্ছে। সেখানে এক দিকে প্রতিদিনের বর্জ্যের প্রক্রিয়াকরণ চলছে। অন্য দিকে, পৃথক ভাবে ৬০ একর এলাকায় ৪০ লক্ষ টন স্তূপীকৃত বর্জ্যের (লিগ্যাসি ওয়েস্ট, যা ১৯৮৭ সাল থেকে জমা) বায়ো রেমিডিয়েশন চালু হয়েছে। পুরকর্তাদের একাংশের বক্তব্য, ধাপার ৬০ একর এবং গার্ডেনরিচের ১৮ একর, মোট এই ৭৮ একর জমিকে সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতির মাধ্যমে পুনরুদ্ধার করা গেলে জঞ্জাল কোথায় ফেলা হবে, সেই প্রশ্নে জমির সঙ্কট অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা যাবে। ‘‘কিন্তু যেখানে-সেখানে জঞ্জাল ফেলার বিষয়ে নাগরিকেরা সচেতন না হলে যে ভাবে জনসংখ্যা বাড়ছে, তাতে পুরো শহরই ধাপা হয়ে যেতে পারে!’’— হতাশ সুরে বলছেন এক পুরকর্তা।

জঞ্জালের পুরো দায় পুরসভার উপরে চাপাতে নারাজ পরিবেশবিদদের একাংশও। এক পরিবেশ বিজ্ঞানীর কথায়, ‘‘অন্য শহরের সঙ্গে তুলনা এলে কলকাতা কত নোংরা তা বলতে মুখর হয়ে ওঠেন অনেকে, অথচ সেই তৎপরতা শহর পরিষ্কারের ক্ষেত্রে দেখা যায় না কেন?’’ প্রসঙ্গত, ২০১০ সালের মার্চে পুরসভার সাতটি ওয়ার্ড দিয়ে জঞ্জাল পৃথকীকরণের (পচনশীল এবং অপচনশীল) প্রকল্প শুরু হয়েছিল। পুরসভার জঞ্জাল দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত তথা বিদায়ী পুর প্রশাসকমণ্ডলীর সদস্য দেবব্রত মজুমদার জানাচ্ছেন, বর্তমানে সেই প্রকল্প ২৭টা ওয়ার্ডে চলছে। প্রশ্ন ওঠা সঙ্গত, কেন এখনও বাকি ওয়ার্ডে এই প্রকল্প চালু করা গেল না? তবে কি পুরসভার গাফিলতি রয়েছে?

পাশাপাশি এ-ও ঠিক, জঞ্জাল পৃথকীকরণের লাগাতার প্রচারে যত শতাংশ নাগরিক সাড়া দিচ্ছেন, তাতে হতাশ পরিবেশবিদেরা। এক পরিবেশবিদের কথায়, ‘‘রাজ্য বা কলকাতা পুরসভা যে-ই দিক, জরিমানার মাসিক ১০ লক্ষ টাকা তো জনগণেরই টাকা! অর্থাৎ, জঞ্জালের জরিমানা দেব, তবু নোংরা করার অভ্যাস ছাড়ব না!’’

জল ও নিকাশি প্রকল্পে অর্থসাহায্যের আবেদন করে এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্কের কাছে পুরসভা অতীতে একটি রিপোর্ট (ইনিশিয়াল এনভায়রনমেন্টাল এগজামিনেশন) জমা দিয়েছিল। সেই রিপোর্টে বলা হয়েছিল,— ‘এই ভাগাড় (ধাপা) নিজের ধারণক্ষমতার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে।’

দুর্ভাগ্যের বিষয়, শহরের জঞ্জাল-বিতৃষ্ণা এখনও সম্ভবত সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছয়নি! এমনই আক্ষেপ শহরের পরিবেশ সচেতন মানুষের। হয়তো সে কারণেই অলিতে-গলিতে-রাজপথে-ফুটপাতে-মাঠে-ঘাটে-অফিসে-জনঅরণ্যে-একাকী অবস্থায়-প্রকাশ্যে-গোপনে, সর্বত্র, সব সময়ে হাতে বাতিল কিছু থাকলেই কোনও খোলা জায়গায় ছুড়ে ফেলা যায়। অনতিদূরে জঞ্জাল ফেলার বিন থাকা সত্ত্বেও। ‘নিজে তো পরিষ্কার হই, শহর নোংরা হলে হোক!’— হয়তো এই মানসিকতাই ললাট-লিখন হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশের অন্যতম এই সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্রের!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement