ফাইল চিত্র।
আমাদের প্রিয় শহর কলকাতা মহানগরীর বহিরঙ্গের আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। এখন বাইপাস ধরে এসে ‘মা’-কে ভর করে শহরে প্রবেশের পরেই মাটিতে নেমে আবার সেতু ধরে অন্য শহরের মাটিতে গিয়ে পা ফেলা যায়। ‘বাইপাস’, ‘উড়ালপুল’ ও ‘আন্ডারপাস’ তো আমাদের উন্নয়নের অহঙ্কার। এমনকি, বাইরে থেকে আসা অতিথিরাও প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিছু দিন আগে ভারতের অন্য এক প্রদেশ সে রাজ্যের উন্নয়নের মডেল হিসাবে এই উড়ালপুলের ছবি ফলাও করে বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করেছিল। বাইপাস বা উড়ালপুল শহরের যাত্রাপথ সুগম করে দেয়, সংযোগ হয় দ্রুত, অথচ কত কিছু না-দেখে এড়িয়ে যেতেও সাহায্য করে। যেমন, এক দিকে বাইপাস সংলগ্ন কলকাতার জলাজমি ভরাট করে উন্নয়নের অসংখ্য পেল্লায় ইমারত গড়ে উঠছে। অন্য দিকে, আমরা একসঙ্গে দীর্ঘ দিন থেকেও সামাজিক ভাবে কী ভীষণ রকম বিচ্ছিন্ন। উড়ালপুল ধরে যাত্রা করলে তো সহজেই পার্ক সার্কাসকে এড়িয়ে যাওয়া যায়।
ওয়ার্ড-ভিত্তিক সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, সামাজিক ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে বসবাসের ক্ষেত্রে ভারতের শহরগুলির মধ্যে কলকাতা একেবারে সামনের সারিতে। আপনি যদি খুব সৌভাগ্যবান হন, তবেই এক জন আদিবাসী বা মুসলিমকে প্রতিবেশী হিসাবে পেতে পারেন। এক জন মুসলিম যদি আপনার প্রতিবেশী হতে চান, আর্থিক সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও বাড়ির মালিকের কাছে হাজারটা যুক্তি থাকে তাঁকে ভাড়া না দেওয়ার। যা ওই ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্ন ভাবে থাকতে এক রকম বাধ্য করে।
কয়েক মাস আগে তালিবান যখন আফগানিস্তানের দখল নিল, তখন শুধু ওই কারণেই কাদের নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে আলিপুরের বাড়ির মালিকের বাড়ি-ভাড়া সংক্রান্ত চুক্তি বাতিল হয়ে গেল। চুক্তি বাতিলের কারণ হিসাবে বাড়িওয়ালার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য ছিল, ‘‘চার দিকে যা ঘটছে! আপনি বরং পার্ক সার্কাসে খোঁজ নিন।’’ এ শহরের মুসলিমরা যে নির্দিষ্ট কয়েকটি পাড়া ছাড়া ঘর ভাড়া নিতে বা কিনতে পারেন না, এটা এখন খুব কঠিন বাস্তব। আর এই মুসলিম পাড়াগুলি সম্পর্কে কথাবার্তায় অনেক সময়েই শোনা যায় নানা বিরূপ মন্তব্য: ‘খিদিরপুর তো পাকিস্তান। দেখবেন, সব সময়ে সবুজ পতাকা ওড়ে’ অথবা শিক্ষিকা মা হয়তো মেয়েকে বললেন, ‘একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরিস।’ ‘আপনাকে দেখে মুসলিম বলে একদম মনেই হয় না’ বা ‘এত ভাল বাংলা বলেন!’ তো হামেশাই শোনা যায়।
সংবাদপত্রও এ নিয়ে মাঝেমধ্যে খবর করে বৈকি! আসলে কলকাতা আছে কলকাতাতেই। তা সে যতই নতুন উড়ালপুল হোক না কেন। মোমিনপুর বা খিদিরপুরে এখনও অসংখ্য ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ বসবাস করছেন। তাঁদের অনেকেই এলাকা ছাড়তে চান না। অনেকে আর্থিক ক্ষমতাবলে নতুন করে বাড়ি করছেন এবং তা ভাড়াও দিচ্ছেন। তবে ভুল করেও মুসলিমদের ভাড়া দেবেন না। গত দশ বছরে মুসলিম বা অ-মুসলিম পাড়ায় একটি লক্ষণীয় পরিবর্তন হল, বাড়ির গায়ে খোদাই করা ‘স্বস্তিক’ চিহ্ন।
নিজেদের পাড়ায় কিন্তু মুসলিমদের অনেকেও কম যান না। আমার পরিচিত দিলীপদাকে তো ঘর বিক্রি করে বেহালায় চলে যেতে হল প্রোমোটার হাজি সাহেবের চোখরাঙানি সহ্য করতে না পেরে। আর্থিক ভাবে একটু অসচ্ছল, অ-মুসলমান সহ-নাগরিকদেরও কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে বসবাস করার পরে পুরনো পাড়া ছাড়তে হচ্ছে। নেতা-পুলিশের যোগসাজশের যৌথ ফসল হিসাবে প্রোমোটারদের প্রভাবে কলকাতার বহুত্বের ছবি ক্রমশ ফিকে হচ্ছে।
আমরা কি চেষ্টা করলে পারতাম না একটা সামাজিক সেতু তৈরি করতে? এ ক্ষেত্রেও স্কুলকে কেন্দ্র করে বহুত্বের মালা গাঁথা যেত। দেশভাগের পরে এই শহরের সামাজিক বিন্যাসে যে বদল ঘটেছে, সেই ছবি স্কুলে
পড়ুয়াদের নথিভুক্তির পরিসংখ্যানেও প্রকাশ পায়। বেসরকারি স্কুলগুলিতে এখনও আর্থিক কারণে মুসলিম পড়ুয়াদের অংশগ্রহণ মোট জনসংখ্যার অনুপাতে কম। অন্য দিকে, যে সমস্ত সরকারি স্কুলে মুসলিমরা পড়ে, সেখানেও বেশির ভাগই মুসলিম পড়ুয়া। তা হলে পড়ুয়ারা বহুত্বের পাঠ নেবে কী ভাবে?
অথচ, এক সময়ে এই শহর ছিল সকলের। যে ফিয়ার্স লেন দুপুরের পর থেকে কাবাবের গন্ধে ম ম করে, সেই পাড়াতেই দত্ত ও রায় বাড়িতে প্রায় ২০০ বছর ধরে আয়োজন হয় দুর্গাপুজোর। খিদিরপুরে আজও ভিন্ন ভাষাভাষী ও বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর বাস। রাজনীতির কারণে এই সামাজিক বৈচিত্রগুলি মাঝেমধ্যেই ধাক্কা খাচ্ছে। তবু, বেঁচে থাকার আনন্দ কিন্তু বহুত্বের উদ্যাপনেই।
(লেখক প্রতীচী ট্রাস্টের গবেষক)