ফাঁদ: রাস্তার পিচ উঠে তৈরি হয়েছে গর্ত। তার মধ্যেই কোনও রকমে যাতায়াত। খিদিরপুরের হাইড রোডে। ছবি: রণজিৎ নন্দী।
পুরসভার অধীনে থাকা কলকাতার মোট রাস্তার দৈর্ঘ্য প্রায় ১৮০০ কিলোমিটার। পুরসভার হিসাব অনুযায়ী, এই দীর্ঘ রাস্তার রক্ষণাবেক্ষণে বছরে খরচ হয় প্রায় ৬০ কোটি টাকা। রাস্তা তৈরির কাঁচামাল, সারানোর উপকরণ এবং অন্যান্য খরচ ধরলে সেই অঙ্ক ছাড়িয়ে যায় ২০০ কোটি। এর মধ্যেই থাকে রাজ্য সরকারের আর্থিক সহায়তা। অর্থাৎ, এক কিলোমিটার রাস্তার জন্য বছরে ব্যয় হয় প্রায় ১১ লক্ষ টাকা!
এ তো গেল বার্ষিক খরচের হিসাব। পুরকর্তাদের একাংশ জানাচ্ছেন, এর চেয়েও বড় ব্যাপার বেহাল রাস্তায় তাপ্পি দিয়ে তা চলাচলযোগ্য করার খরচ! তাঁদের দাবি, এর জেরে প্রাথমিক ভাবে রাস্তা চলাচলযোগ্য হয় ঠিকই, কিন্তু কিছু দিন যেতে না যেতেই বেরিয়ে আসে তার কঙ্কাল। এক ভুক্তভোগীর মন্তব্য, ‘‘নির্দিষ্ট সময় অন্তর রাস্তা সারাইয়ে যে খরচ, তা দীর্ঘস্থায়ী মেরামতির খরচের চেয়ে বেশি। এমন খরচে আর কার লাভ হয় জানি না, কিন্তু আমাদের সুরাহা
হয় না।’’ অভিযোগ, রাস্তা নিয়ে উদাসীন বন্দর ও পূর্ত দফতরের কর্তারাও। এই সার্বিক উদাসীনতা এবং প্রতিদিনের পথের যন্ত্রণা আসন্ন পুর ভোটে প্রভাব ফেলবে কি না, সেটাই আপাতত বড় প্রশ্ন।
গত কয়েক দিনে শহর ঘুরে দেখা গেল, অভিযোগ বিস্তর। কোথাও মাঝরাস্তায় হাঁ হয়ে থাকা গর্তে পড়ে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন গাড়িচালক, কোথাও মোটরবাইক থেকে ছিটকে পড়ার উপক্রম হচ্ছে সহযাত্রীর। কোথাও পিচ উঠে বেরিয়ে এসেছে পাথর, কোথাও গর্তে পড়ে সাইকেল, অটো উল্টে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। অভিযোগ, সব চেয়ে খারাপ অবস্থা বন্দর এলাকার। সেখানকার তারাতলা রোড, কোল ডক রোড, সোনাই রোড ও সোনাপুর রোডে পুজোর আগে দেওয়া তাপ্পি ইতিমধ্যেই উঠে গিয়েছে। জিঞ্জিরাবাজার মোড়ের কাছে তারাতলা রোডের বিপজ্জনক অংশ মেরামতি কবে শুরু হবে, সদুত্তর মেলেনি বন্দর কর্তৃপক্ষের তরফে। উত্তর নেই সেন্ট্রাল গার্ডেনরিচ রোডের সংস্কার নিয়েও।
ছবিটা আলাদা নয় জওহরলাল নেহরু রোড, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের একাংশ, বড়বাজার, বেহালার মহাত্মা গাঁধী রোডের বিভিন্ন জায়গা এবং ক্যানাল ইস্ট ও ওয়েস্ট রোডের কয়েকটি অংশেও। তিলজলা, তপসিয়া, ট্যাংরা এবং গল্ফ গার্ডেনের বহু রাস্তা এতটাই বিপদসঙ্কুল যে, গত এক মাসে ওই এলাকা থেকে একের পর এক দুর্ঘটনার খবর আসছে বলে দাবি পুলিশের।
কলকাতা পুরসভার হিসাবই বলছে, শহরে এমন ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তার সংখ্যা প্রায় পাঁচশো। এই মুহূর্তে রাস্তা সংস্কার হচ্ছে বিটুমিনে। কারণ, মূলত দূষণের কারণে ম্যাস্টিক অ্যাসফল্ট ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সাধারণত, ভাঙা রাস্তার উপরিভাগ মেরামত করার পরেই পিচ বা ম্যাস্টিকের আস্তরণ দেওয়া উচিত। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে মেরামত না করেই ম্যাস্টিকে রাস্তা মুড়ে ফেলা হচ্ছিল সর্বত্র। সঙ্গে পুরসভার ‘দাদা’ ধরা থাকায় সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাই নেওয়া হচ্ছিল না। এখনও সেই রীতি বজায় রয়েছে বলে অভিযোগ। বেহাল রাস্তার জেরে দুর্ঘটনা ঘটলে তার মাসুল দিতে হবে ঠিকাদারকেই— এই মর্মে এক সময়ে আইন পাশ করার কথা থাকলেও তা আর বাস্তবায়িত হয়নি।
এখন ‘ডেন্স বিটুমিনাস ম্যাকাডাম’ (ডিবিএম), বিটুমিনাস ম্যাকাডাম (বিএম) বা বিটুমিনাস কংক্রিট দিয়ে রাস্তার কাজ সেরে উপরে ‘ফিনিশিং কোট’ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এই ধরনের রাস্তা মাটির নীচে জলের প্রবেশ ঠেকাতে পারে না। যার ফল হচ্ছে মারাত্মক। এক পুরকর্তার কথায়, ‘‘রাস্তা খারাপ হওয়ার সব চেয়ে বড় কারণ জমা জল। যে সব রাস্তায় বৃষ্টির জল জমে ছিল, সেই সব রাস্তাই বেশি ভেঙেছে।’’ পুরকর্তাদের দাবি, শহরের প্রায়
সব রাস্তায় নীচ দিয়েই হয় পানীয় জলের, নয় তো নিকাশির পাইপ গিয়েছে। ওই সব পাইপ সারাতে গেলেই রাস্তা খুঁড়তে হয়। তার পরে একটি রাস্তা মেরামত করে দিলেও অন্তত ১০-১২ দিন সেখান দিয়ে গাড়ি চলাচল বন্ধ রাখার কথা। কিন্তু কলকাতার মতো শহরে সেই সময়ই পাওয়া যায় না।
গোটা বিষয়টি নিয়ে পুরসভার রাস্তা দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত, বিদায়ী পুর প্রশাসকমণ্ডলীর সদস্য রতন দে-কে বার বার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। উত্তর দেননি টেক্সট মেসেজেরও। কিন্তু পুরসভার এক কর্তার দাবি, ‘‘আমাদের নিজস্ব প্লান্টে ম্যাস্টিক তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। ভোটের পরেই এ নিয়ে এগোনো হবে। তবে, জল জমার রোগ সারাতে না পারলে কোনও রাস্তাই বাঁচানো যাবে না।’’