প্রতীকী ছবি।
ঝড়ঝাপ্টা অনেক এসেছে। আসছে একের পর এক ভয়ঙ্কর অসুখের ঢেউ। টালমাটাল জনজীবন। তবু সব বাধা কাটিয়ে ভাল থাকার মন্ত্রে যাঁরা বিশ্বাসী, আমি তাঁদেরই এক জন।
মনে করি, নিজেকে ভাল রাখার দায়িত্ব সবটা না হলেও অনেকটাই আমাদের হাতে। আমার কাজ মূলত বার্ধক্যের সমস্যা নিয়ে। তাই শরীরের থেকেও মনকে সতেজ রাখায় ভরসা বেশি। সকালে হাঁটা, গান শোনা, পছন্দসই সিনেমা, টিভি সিরিয়াল দেখা, বই পড়া, বাগান করা— এ সবে শরীর ও মন দুই-ই ভাল থাকে। দৈনন্দিন জীবনের কাজের তালিকায় এগুলো আমার থাকেই। অন্যদেরও সেই পরামর্শ দিই। শহুরে জীবন নিয়ে আলাদা করে ভেবে দেখা হয়নি। তবে এ শহর তো আমারই। তাই ভাল-মন্দ সবটাকে নিয়ে চলতে শিখে গিয়েছি সেই কোন কালেই!
সারা দিনের ভালবাসা থাকে আমার কাজেই। দক্ষিণ কলকাতার সার্ভে পার্কে আমাদের ডিমেনশিয়া ডে কেয়ার সেন্টার ঘিরেই কেটে যায় দিন। স্মৃতি-হারানো মানুষগুলির হাসিকান্নায় দোল-দোলানো জীবনের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে যখন দিন শুরু করি, তখন মনে প্রশান্তি হয়। মনে হয়, যদি এঁদের চোখের জল মোছাতেই না পারি, তা হলে সেই কাজের অর্থ কী? আমাকে দেখে ওঁদের মুখে ভরসার হাসি এ জীবনে পরম পাওয়া। প্রতিদিন কেটে যায় অসুস্থ মানুষটিকে ঘিরে বাড়ির লোকের সমস্যা শুনে আর অসহায় মানুষগুলির ভরসা খোঁজা চাহনি দেখে। ইচ্ছে থাকলেও কতটুকু সমাধান করতে পারি?
এ শহরে যে অজস্র সমস্যা। শুধু ওঁদের কথাই আজ বলব। বিশ্বের মতো কলকাতাতেও বার্ধক্য জনসংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে অ্যালঝাইমার্স রোগ এবং ডিমেনশিয়ার উপসর্গ। কিন্তু চিকিৎসা কোথায়? চূড়ান্ত অবহেলিত হয়ে পড়ে আছে রোগ নিয়ন্ত্রণের রাস্তা। এই সমস্যায় আক্রান্তদের একটা সময়ের পর থেকে রাতদিন দেখাশোনা জরুরি হয়ে যায়। ভাবতে পারছেন, এক জন তাঁর সমস্ত স্মৃতি হারালে কেমন হতে পারে জীবনটা? জন্ম থেকে যা যা শিখেছিলেন, সবটাই তাঁর হারিয়ে যায়। হয়তো এক জন বিজ্ঞানী, তিনি ভুলেই গিয়েছেনসামান্য যোগ-বিয়োগ। এক জন সঙ্গীতশিল্পী, তিনি জানেনই না আর গান ধরতে। তাঁদের এবং এক জন শারীরিক ভাবে অক্ষম মানুষকে দেখাশোনা করা কিন্তু কখনওই এক রকম নয়। এ কাজে চাই প্রশিক্ষিত কর্মী। সেই পরিকাঠামো তৈরির ন্যূনতম প্রচেষ্টাই নেই। নেই কোনও সরকারি ডে কেয়ার পরিষেবা বা এক ছাতার নীচে পরিষেবা পাওয়ার মতো উপযুক্ত বেসরকারি ব্যবস্থাও।
এই সমস্যা ওষুধে সারে না। অসুখের প্রাথমিক পর্বে চিহ্নিত করা গেলে তবেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু সেই চিহ্নিতকরণ হচ্ছে কোথায়? এ জন্য দরকার জেলার প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে উপযুক্ত বিভাগ। অথচ এ শহরের মাত্র তিনটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চলছে মেমরি ক্লিনিক। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং এসএসকেএমেই মিলছে এই পরিষেবা। সে খবর বহু মানুষ জানেনই না। অর্থাৎ, এই ক্রমবর্ধমান রোগের গুরুত্ব বুঝে সরকারি স্তরের প্রচারও নেই।
অথচ, দক্ষিণের রাজ্যগুলিকে দেখুন। সেখানে এমন রোগের নিয়ন্ত্রণে অনেক কাজ করছে সরকার। তবে আমরা এত যোজন পিছিয়ে কেন? অবহেলা কি শুধু প্রশাসনের তরফে? অবহেলা স্পষ্ট চিকিৎসকদের তরফেও। ভুলে যাওয়াকে বার্ধক্যজনিত সমস্যা বলে সিংহভাগ চিকিৎসক ডিমেনশিয়ার ওষুধ ধরিয়ে দেন। ডিমেনশিয়া তো জ্বরের মতোই একটা উপসর্গ। জানতে চেষ্টা করেন না, এই উপসর্গের কারণটা কী? হতেই পারে সোডিয়াম-পটাশিয়ামের ভারসাম্য হারানোয় বা স্ট্রোকে, বা অন্য কোনও কারণে এমনটা হচ্ছে। যা হয়তো অন্য চিকিৎসায় সারতে পারত। অথচ, সে সব না জেনেই ডিমেনশিয়ার চিকিৎসা শুরু হল। ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলে এমন রোগীর ক্ষেত্রে সমস্যা বোঝানো কষ্টকর। পরিজনদের সবটা বুঝে নিতে হয়। সে ক্ষেত্রে ডাক্তারকেই পরিজনদের বুঝিয়ে দিতে হবে যে, কী দেখলে সতর্ক হবেন। রোগীর সমস্যায় মেসেজ বা ফোনে পাশে থাকতে হবে ডাক্তারকে। আফশোস, বেশির ভাগ চিকিৎসক এমনটা হন না।
কষ্ট পাই এ শহরের পুর পরিষেবাগত কিছু খামতি দেখেও। ভাঙা রাস্তাঘাট, জল জমার সমস্যা, আবর্জনা পড়ে থাকা, এক দিকে পানীয় জলের হাহাকার, অন্য দিকে পুরসভার কল দিয়ে অনবরত জল বেরিয়ে তার অপচয়— এ সবই তো পুর প্রশাসনের প্রাথমিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তবু অবহেলা!
পথে চলতে চলতে দেখি, যেখানে আলো আছে, সেখানে ততই বাহারি আলোর ভিড়। সত্যিকারের অন্ধকার যেখানে, সেখানে নজর কোথায়? স্মৃতির আঁধারেও ঠিক যেন তেমনই অবজ্ঞা!
লেখিকা
জেনারেল সেক্রেটারি, অ্যালঝাইমার্স সোসাইটি