প্রাক্তন নৌসেনা কর্মীর দেহাংশের খোঁজে ডিহিমল্ল এলাকার পুকুরে চলছে তল্লাশি। রবিবার, বারুইপুরে। নিজস্ব চিত্র।
বাবা উজ্জ্বল চক্রবর্তীকে (৫৫) শ্বাসরোধ করে খুনের পরে বাড়ির অদূরে মাঠে বসেছিল ছেলে রাজু ওরফে জয় চক্রবর্তী। পুলিশের দাবি, তার পরে সে-ই ঠান্ডা মাথায় মৃতদেহ লোপাটের পরিকল্পনা করে। তবে জেরায় মা-ছেলের কথার মধ্যে ফারাক এবং ছেলের দ্বিতীয় মোবাইল ফোনের সূত্র ধরেই ওই প্রাক্তন নৌসেনা কর্মীকে খুনের রহস্যভেদ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তদন্তকারীরা। শনিবার সন্ধ্যায় রাজু ও তার মা শ্যামলীকে গ্রেফতার করার পরে রবিবার বারুইপুর মহকুমা আদালতে তোলা হলে দু’জনের ১২ দিনের পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দেন বিচারক।
গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বারুইপুরের ডিহিমল্ল এলাকার একটি পুকুর থেকে উদ্ধার হয় ভারতীয় নৌসেনার প্রাক্তন কর্মী উজ্জ্বলের অর্ধেক মৃতদেহ। তার আগের সোমবার সন্ধ্যার পর থেকে উজ্জ্বল নিখোঁজ বলে মঙ্গলবার ভোরে থানায় এসে অভিযোগ করেছিলেন স্ত্রী শ্যামলী ও ছেলে রাজু। তদন্তে নেমে বারুইপুর পুলিশ জেলার স্পেশ্যাল অপারেশন্স গ্রুপের (এসওজি) ওসি লক্ষ্মীকান্ত বিশ্বাস ও বারুইপুর থানার আইসি সৌম্যজিৎ রায়ের নেতৃত্বে শনিবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মা-ছেলেকে টানা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
মৃতের এক প্রতিবেশী পুলিশকে জানিয়েছিলেন, সোমবার রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ তিনি উজ্জ্বল ও রাজুর মধ্যে ঝগড়াঝাঁটির আওয়াজ পেয়েছিলেন। পরে টিভির আওয়াজ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। তার পরে হঠাৎই সব চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। তদন্তকারীদের দাবি, ওই রাতে বাবা-ছেলের মধ্যে ফের বচসা হয়। উজ্জ্বল রাজুকে মারধর করেন। এর পরেই উজ্জ্বলকে মাটিতে ফেলে তাঁর বুকের উপরে চেপে বসে গলা টিপে শ্বাসরোধ করে রাজু।
তদন্তকারীরা জানান, পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে রাজু প্রথমে জানায়, সেই সন্ধ্যায় ঝগড়া করে উজ্জ্বল বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। অথচ শ্যামলী জানিয়েছিলেন, বাবা-ছেলের মধ্যে কোনও ঝগড়া হয়নি! সে দিন উজ্জ্বল বাড়িতে মোবাইল রেখে বেরিয়েছিলেন বলেও দাবি করে শ্যামলী।
তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, উজ্জ্বল ও মা-ছেলের তিনটি মোবাইলের নম্বর তাঁদের হাতে এসেছিল। বৃহস্পতিবার উজ্জ্বলের মৃতদেহ উদ্ধারের পরে শ্যামলীদের খবর দিতে তাদের বাড়ি যায় পুলিশ। হঠাৎ বাড়িতে পুলিশকে আসতে দেখে ঘরের দরজা বন্ধ করে প্রায় আধ ঘণ্টা মোবাইলে কারও সঙ্গে কথা বলে শ্যামলী। সেই সময়ে রাজু বাড়িতে ছিল না। এর পরে থানায় এসে শ্যামলী উজ্জ্বলের দেহ শনাক্ত করে। ঘণ্টাখানেক পরে থানায় এসে রাজু জানায়, সে অনেক দূরে মামার বাড়িতে গিয়েছিল।
এর পরে শুক্রবার শ্যামলী, উজ্জ্বল ও রাজুর তিনটি ফোনই বাজেয়াপ্ত করা হয়। উজ্জ্বলের দেহ উদ্ধারের খবর শুনে শ্যামলী কার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিল, তা জানতে চেষ্টা করে পুলিশ। তখনই তদন্তকারীরা দেখেন, শ্যামলীর ফোনে একটি নম্বর জয় নামে সেভ করা রয়েছে। সেই নম্বরেই সে দিন ফোন করে আধ ঘণ্টা কথা বলেছিল শ্যামলী। পরীক্ষা করে দেখা যায়, সেটি রাজুরই আর একটি মোবাইল নম্বর, যার সম্পর্কে পুলিশকে জানানো হয়নি। এতেই ওই দু’জনের উপরে সন্দেহ আরও দৃঢ় হয় পুলিশের। শ্যামলী ও রাজুর দ্বিতীয় ফোনটির ‘অটো ভয়েস কল রেকর্ডিং মোড’-এর তথ্য যাচাই করে জানা যায় যে, সে সময়ে ফোনে শ্যামলী ছেলেকে বলেছিল— ‘বাড়িতে পুলিশ এসেছে, বাবার মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। এখন ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’ এর পরেই শনিবার দুপুরে মা-ছেলেকে থানায় ডেকে তাদের সামনে ফোনের তথ্য তুলে ধরেন তদন্তকারীরা। জেরায় ক্রমশ চেপে ধরতে এক সময়ে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে মা-ছেলে।
তদন্তকারীদের দাবি, খুনের রাতে উজ্জ্বলের দেহ বাড়িতেই করাত দিয়ে খণ্ড খণ্ড করে রাজু। এর পরে মা-ছেলে সারা রাত ধরে বাড়ি থেকে প্রায় ৫০০ মিটার দূরে ডিহিমল্ল এলাকার পুকুরে দেহাংশ ফেলে আসতে থাকে। তদন্তকারীদের দাবি, প্রথম বার প্লাস্টিকে মোড়া উজ্জ্বলের দেহের উপরিভাগ সাইকেলে চাপিয়ে মায়ের সঙ্গেই গিয়ে পুকুরে ফেলে রাজু। এর পরে পুকুরের কাছেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে শ্যামলী। আর রাজু বার বার বাড়ি ফিরে এসে এক-একটি দেহাংশ নিয়ে গিয়ে পুকুরে ফেলে। পুলিশের দাবি, খুনের অস্ত্র করাতটিও পুকুরেই ফেলেছে বলে জেরায় জানিয়েছে রাজু। এর পরে ভোর ৫টা নাগাদ থানায় গিয়ে নিখোঁজ ডায়েরি করে বাড়িতে ফেরে মা-ছেলে। শৌচাগারে পড়ে থাকা রক্ত জল দিয়ে ধুয়ে দেয় তারা।
শনিবার রাতেই পুকুর থেকে উজ্জ্বলের দু’টি কাটা পা উদ্ধার হয়েছিল। ওই রাতে এবং রবিবার সকালে রাজুকে সঙ্গে নিয়ে দফায় দফায় পুকুরে তল্লাশি চালানো হয় বলে জানান তদন্তকারীরা। শেষমেশ এ দিন সকালে উদ্ধার হয় পাঁজর থেকে কোমর পর্যন্ত দেহের একটি খণ্ড। পুকুরের পাশে জঙ্গলে থাকা একাধিক শেয়ালের গর্তের কাছ থেকে উদ্ধার হয় ওই দেহাংশ। কিন্তু উজ্জ্বলের কাটা দুই হাত ও খুনের অস্ত্রটির এখনও খোঁজ মেলেনি। কাটা হাত দু’টি শেয়ালে নিয়ে যেতে পারে বলে মনে করছে পুলিশ।