নির্মোহ শ্রদ্ধাতেই আমজাদের বড়চর্চা

উস্তাদ আমজাদ আলি খান সাহেব বললেন, ‘‘বাজাতে শুরু করে ক্রমশ দেখছি উস্তাদজি রিহার্সালে যা ঠিক হয়েছিল, তার কিচ্ছু মানছেন না। আচমকা সব সারপ্রাইজ আসছে, তাঁর কাছ থেকে। সেই সঙ্গে, সায়েন্স সিটি-র ‘সাউন্ড’ নিয়ে বকুনি, ওঁর সানাই নাকি শোনাই যাচ্ছে না!’’

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০১৯ ০২:৫৪
Share:

বক্তার আসনে: ‘কলকাতা লিটারারি মিট’-এ সরোদবাদক উস্তাদ আমজাদ আলি খান। রবিবার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

পনেরো বছর আগে কলকাতায় উস্তাদ বিসমিল্লা খান সাহেবের সঙ্গে যুগলবন্দির অকথিত কাহিনি শোনাচ্ছিলেন তিনি।

Advertisement

উস্তাদ আমজাদ আলি খান সাহেব বললেন, ‘‘বাজাতে শুরু করে ক্রমশ দেখছি উস্তাদজি রিহার্সালে যা ঠিক হয়েছিল, তার কিচ্ছু মানছেন না। আচমকা সব সারপ্রাইজ আসছে, তাঁর কাছ থেকে। সেই সঙ্গে, সায়েন্স সিটি-র ‘সাউন্ড’ নিয়ে বকুনি, ওঁর সানাই নাকি শোনাই যাচ্ছে না!’’ বিসমিল্লা খান সাহেব হঠাৎ বাজানো বন্ধ করার পরে খানিক ক্ষণ বাদে বিরতি ঘোষণা করেন প্রবীণ সরোদ-শিল্পী। পরে আমজাদকে একাই অনুষ্ঠানে ফিরতে দেখা যায়।

কেন ফেরেননি সানাই-কিংবদন্তি? এত দিন বাদে আমজাদ বললেন, ‘‘বিসমিল্লা খান সাহেবের সঙ্গে আসরে বসার আগে কিছুটা শশব্যস্ত ছিলাম, আমার কোনও ব্যবহারে উনি কষ্ট না পান! বিরতিতে আমিই উদ্যোক্তাদের বলি, বিসমিল্লা খান সাহেবকে আগে বাড়িতে পৌঁছে দিন। না-হলে আমার আর বাজানো হবে না!’’

Advertisement

হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বরণীয় আচার্যদের নিয়ে কিছু দিন আগে প্রকাশিত তাঁর অন্তরঙ্গ কথন ‘মাস্টার অন মাস্টার্স’ বইয়ে এমন গল্পের ছড়াছড়ি। রবিবার, ভিক্টোরিয়ার বাগানে ‘কলকাতা লিটারারি মিট’-এর আসরে তার কিছু-কিছু উঠে এল। সেনিয়া বঙ্গাশ ঘরানার প্রবীণ উত্তরাধিকারীকে বিভিন্ন শিল্পী প্রসঙ্গে উস্কে দিচ্ছিলেন আইনজীবী, সঙ্গীতলেখক অরুণাভ দেব। বড়চর্চার এক অন্য অভিজ্ঞান মেলে ধরলেন আমজাদ। ঈশ্বরপ্রতিম গুণিজনও রক্তমাংসের মানুষ। পারস্পরিক শ্রদ্ধা অটুট রাখতে কোনও কোনও সময়ে খানিক দূরত্ব বজায় রাখাই বরং ভাল।

সেই সূত্র ধরেই উঠে এল, উস্তাদ বিলায়েত খান সাহেব তাঁকে চিঠি লিখে একসঙ্গে অনুষ্ঠানের অনুরোধ জানালেও কেন রাজি হননি আমজাদ! ‘‘আমি ওঁর চিঠির জবাব দিইনি ইচ্ছে করেই। পার্কসার্কাসে ওঁদের বাড়িতে বিলায়েত খান সাহেবের সঙ্গে রেওয়াজের অভিজ্ঞতা খচখচ করছিল। মনে হচ্ছিল, একসঙ্গে অনুষ্ঠান করার পরে সুন্দর সম্পর্কটা যদি না-থাকে!’’ বিসম্বাদের সম্ভাবনায় একবার পণ্ডিত রবিশঙ্করের সঙ্গে মোলাকাত এড়িয়েও নীরবতাকে হাতিয়ার করেন আমজাদ। কাগজে একটি বিষয়ে, রবিশঙ্করের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধের খবর প্রকাশিত হয়। অগ্রজ সেতারশিল্পী তখন আমজাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য অস্থির। আমজাদ আমেরিকা সফরে যেতেই নিজের নিউ ইয়র্কের ঠিকানা দিয়ে তাঁকে বাড়িতে আসতে বলেন। আমজাদ বলছিলেন, ‘‘পরে কত বার রবিশঙ্করজির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। কিন্তু সে-বার ইচ্ছে করেই যাইনি। কী দরকার, যদি কথার পিঠে কথায়, সুন্দর সম্পর্কটায় চিড় ধরত!’’

রবিশঙ্কর, বিলায়েত, বিসমিল্লাদের মতো মহারথীদের অনুপস্থিতি কষ্ট দেয় তাঁকে। এ কথা বার বার বললেও তাঁদের নানা বৈশিষ্ট্য নিয়ে অকপট আমজাদ। তাঁর বইয়ে রবিশঙ্কর এবং তবলার কিংবদন্তি পণ্ডিত কিসান মহারাজের ‘অম্লমধুর (লভ-হেট) সম্পর্ক’-এর মতো নানা গল্প উঠে এল আসরে। বরণীয়দের প্রতি শ্রদ্ধা অটুট রেখে তাঁদের মানুষী সত্তা স্বীকার করার নির্মোহ দৃষ্টি আবার শিল্পীর গভীর জীবনবোধেরও দ্যোতক। আমজাদ বললেন, ‘‘পরম্পরা (ট্র্যাডিশন) ও রীতি (কনভেনশন)-র ফারাক লোকে গুলিয়ে ফেলে। আমাদের দেশে ধর্ম বা সঙ্গীতেও অন্ধের মতো রীতি আঁকড়ে ধরাটাই দস্তুর।’’

কাশীর সঙ্কটমোচন মন্দিরে তাঁর পুত্রদের সরোদ-নিবেদনের আমন্ত্রণে আনন্দ পেয়েছিলেন আমজাদ। বললেন, ‘‘আমার বাবা উস্তাদ হাফিজ় আলি খান সাহেব এক সর্বজনীন ঈশ্বর ও মানুষ জাতির কথা বলতেন! ক্ষমতার তাঁবেদার পুরোহিতেরা কোনও ধর্মেই সেই বৃহৎ ঈশ্বরকে মনে রাখে না!’’ একুশ শতকে দেশে-দেশে নিরাপত্তার আশঙ্কা, ধর্মান্ধতা বিষণ্ণ করে আমজাদকে। ঠিক যেমন, সঙ্গীতের গতে-বাঁধা একঘেয়েমি না-পসন্দ চিরনবীন শিল্পীর। ‘‘পরম্পরা আর মৌলিকতায় বিরোধ নেই। উপস্থাপনার ব্যাকরণ ছাপিয়ে সঙ্গীত রচনার অভিনবত্বই আসল জিনিয়াসের স্বাক্ষর।’’ রবীন্দ্রগানে ছক-ভাঙা রাগের প্রয়োগ গুনগুন করে রসিক দর্শকের সামনে রবীন্দ্রনাথকেও তাঁর প্রণাম জানিয়ে গেলেন আমজাদ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement