কলকাতার সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এক পাড়ায়। বুধবার। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
সন্ধে হয় হয়। কাজের বাড়ি থেকে বেরিয়েই এক দৌড়ে বড় রাস্তার মোড়ে ‘পে অ্যান্ড ইউজ’ টয়লেটে। দরজার সামনে পাতা টেবিলে ঝনাৎ করে কয়েন ফেলেই ভিতরে সেঁধিয়ে গেলেন নয়নতারা। মিনিট পাঁচেক পরে সেই শৌচাগার থেকে যিনি বেরোলেন, তাঁর মুখের আদলও অবিকল নয়নতারার মতো। কিন্তু শাখা-সিঁদুর উধাও। মাথায় হিজাব। তাঁকে দেখে হতবাক কাউন্টারের মহিলা। কোনও প্রশ্ন করার আগেই উত্তর আসে, ‘‘হ্যাঁ গো দিদি, আমিই ঢুকেছিলাম শাখা-সিঁদুর পরে। এখন বাড়ি যাচ্ছি তো, তাই এগুলো আবার পরে নিলাম।’’
প্রতিদিন সকালে আর সন্ধ্যায় এ ভাবেই নিয়ম করে ভোল বদলাতে হয় রুকসানাকে। সকালে তিনি হয়ে যান নয়নতারা। সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার আগে আবার রুকসানা। কাজের বাড়ির মাসিমা-মেসোমশাই মানুষ খারাপ নন। কিন্তু হিন্দু না হলে কাজে রাখবেন না। পেটের দায়ে অগত্যা নিজেকে বদলে ফেলেন রুকসানা।
উত্তরবঙ্গ থেকে এ শহরে চাকরি করতে এসেছিলেন ফারুখ আহমেদ (নাম পরিবর্তিত)। দক্ষিণ কলকাতায় বাড়ি খুঁজছিলেন ভাড়া নেবেন বলে। কিন্তু তাঁর ধর্মীয় পরিচয় জেনেই দালাল বলে দেন, ‘‘একটু সময় লাগবে দাদা। আপনাকে সবাই ভাড়া দিতে চাইবে না।’’ বাস্তবে সেটাই দেখেছিলেন পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ফারুখ। এক বাড়িওয়ালা সরাসরিই বলেন, ‘‘আপনাকে বাড়ি ভাড়া দিলে পাড়ায় একটু চাপে পড়ে যাব ভাই।’’
যে দেশ আজ ৭৩তম স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপনে মেতেছে, ফারুখ আর রুকসানারাও তো সেই দেশেরই নাগরিক। তাই প্রশ্ন ওঠে, তাঁরা কি সত্যিই স্বাধীন?
অর্থনীতির অধ্যাপক-গবেষক এবং ‘ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ’-এর অধিকর্তা অচিন চক্রবর্তীর মতে, ‘‘স্বাধীনতাহীনতার সঙ্গে বঞ্চনার প্রশ্নটাও ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। আমাদের এখানে কাজের সুযোগ এমনিতেই সীমিত। তার উপরে শুধু ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে কোনও বিশেষ জনগোষ্ঠী যদি কাজের সুযোগ হারায়, তা হলে বুঝতে হবে, সংবিধান স্বীকৃত সমানাধিকার অনেকের কাছেই পৌঁছচ্ছে না। এটা দুর্ভাগ্যজনক। শুধু মুসলিমরাই যে এই ধরনের বৈষম্যের শিকার, তা নয়। আদিবাসী বা দলিতরাও প্রতিনিয়ত এই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।’’
তিনি জানান, এই বৈষম্য আর বঞ্চনার কারণেই সংখ্যালঘুরা একটা সময়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে শুরু করেছিলেন। এবং সেই কারণেই শুরু হয় ধর্মের ভিত্তিতে ‘গেটোআইজ়েশন’ বা এলাকা ভাগ করে থাকার প্রবণতা। তাঁর কথায়, ‘‘আগে কিন্তু মানুষ নিজেদের ইচ্ছেমতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতেন। ধর্মের ভিত্তিতে এলাকা ভাগ করে থাকার প্রবণতা অনেক পরে শুরু হয়।’’
অচিনবাবু মনে করিয়ে দিচ্ছেন, বৈষম্য কিন্তু একটি বা দু’টি ক্ষেত্রে আবদ্ধ নয়, তার বিস্তার আরও বেশি। তাঁর কথায়, ‘‘চাকরির আবেদনপত্র বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও অনেক সময়ে দেখা যায়, ধর্মীয় পরিচয়টাই সেখানে প্রাধান্য পাচ্ছে। যোগ্যতার অন্যান্য মাপকাঠি গৌণ হয়ে যাচ্ছে। ব্যাঙ্কের ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রেও এই ধরনের সমস্যা হয়। বিশেষ বিশেষ অঞ্চলের মানুষকে ব্যাঙ্কের কর্মীরা ঋণ দিতে অস্বীকার করেন বা আগ্রহ দেখান না। যদিও খাতায়-কলমে এমন বৈষম্যের কোনও অস্তিত্ব নেই।’’
স্বাধীনতাই হোক বা পরাধীনতা— দু’টি ক্ষেত্রেই সবার আগে দরকার মানুষের বোধের জাগরণ। এমনটাই মনে করেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক আব্দুল কাফি। তিনি বলেন, ‘‘যিনি স্বাধীন, তাঁকে আগে বুঝতে হবে যে, তিনি স্বাধীন। তখন তাঁর কর্তব্য, অন্য কাউকে স্বাধীন হতে সাহায্য করা। আর যিনি পরাধীন, তাঁর মধ্যেও সেই পরাধীনতার বোধটা তৈরি হওয়া খুব জরুরি। সেই বোধ তৈরি না হলে স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব হয় না। যিনি পরিচয় গোপন করে কাজে যাচ্ছেন, তিনি হয়তো সেটাকেই স্বাভাবিক বলে মনে করছেন। কারণ, তাঁর মধ্যে পরাধীনতার বোধটা তৈরি হচ্ছে না।’’
তাঁর মতে, ‘‘সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ছাড়া স্বাধীনতা প্রাপ্তি সম্ভব নয়। আর এই নিরাপত্তার দায়িত্ব শুধু রাষ্ট্রের বা প্রশাসনের নয়, সহনাগরিকদেরও। মানুষে মানুষে পারস্পরিক বিশ্বাস ছাড়া স্বাধীনতা স্থায়ী হয় না। একটা কথা মনে রাখা দরকার, স্বাধীনতা কিন্তু এক বারে পেয়ে যাওয়ার কোনও বস্তু নয়। এটা সারা জীবন ধরে চর্চার বিষয়। অর্থাৎ, স্বাধীনতা পাওয়ার পরে তা রক্ষা করে চলাটাও সমান জরুরি।’’