নতুন: পার্সি ‘থিম রেস্তরাঁ’র অন্দরসজ্জা। নিজস্ব চিত্র।
“তিন রকমের ডাল দিয়ে রান্না মাংসের ধানসাক খেলেও মাটন বেরি পুলাও পার্সি বাড়িতেও বেশি জোটে না!” দুধেল এলাচদার ইরানি চায়ে চুমুক দিয়ে ‘লাঞ্চ’ শেষের ফুরোতে না-চাওয়া আড্ডায় বলছিলেন সিসিএফসি, বেঙ্গল ক্লাবের চেনা মুরুব্বি দিনইয়ার মুকাদম। তাঁর স্ত্রী সুপর্ণা এবং ছোটদের বইয়ের লেখিকা, ধর্মতলাবাসী তরুণী কাইজিন কনফেকশনারও এই পোলাওয়ে মুগ্ধ।
অতিমারির পরে ইরানি বেরি দুর্লভ। তবে টক-মিষ্টি ব্লুবেরি, ক্র্যানবেরিতেই পোলাওয়ের স্বাদ খুলছে সাউথ সিটি মলের সোডাবটলওপেনারওয়ালা রেস্তরাঁয়। একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা অবন কনফেকশনারের সগর্ব হাসি, “যাক, বাঙালি বন্ধুদের সামনে মুখরক্ষা হবে। তোমাদের পার্সি খানা কোথায় পাব করে যা মাথা খেত!” সদ্যোজাত রেস্তরাঁয় শেষ পাতের ‘লগান নু কাস্টার্ড’ কেটে জন্মদিন পালন হচ্ছিল তাঁর।
এত দিন পার্সি রান্না বলতে কিড স্ট্রিটের ‘মনচারজি’ বা বৌবাজারের রুস্তমজি মানেকশ ধর্মশালাই চিনত কলকাতা। পার্সি পরিবারের বধূ, বাঙাল মেয়ে সুপ্রিয়া মনচারজি পার্সি সমাজের নানা অনুষ্ঠানেও খাবার করেন। শহরের প্রবীণ পার্সিদের অনেকের বাড়িতেই নিয়মিত যায় তাঁর রান্না। পার্সি ধর্মশালার হেঁশেল সামলান হংসোটিয়া দম্পতি। আগাম ফরমায়েশে তাঁরাও ভালমন্দ রেঁধে খাওয়ান। কিন্তু সাবেক বম্বের ইরানি কাফেগুলির আদলে পার্সি ‘থিম রেস্তরাঁ’ এই প্রথম এল কলকাতায়।
পার্সিদের সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক অবশ্য আজকের নয়। বম্বেওয়ালা, পুনাওয়ালার মতো ‘বেঙ্গলি’ পদবীধারী পার্সিও কম দেখা যেত না! প্রথম বাংলা ছবি ‘জামাইষষ্ঠী’র প্রযোজক ম্যাডান থিয়েটার্সের স্মৃতি মিশে ম্যাডান স্ট্রিটে। উনিশ শতকের গোড়ায় খিদিরপুরের ডকটাই কিনে নেন রুস্তমজি কাওয়াসজি বানাজি। থাকতেন আজকের গড়পারের পাশে। ত্রিসীমানায় পার্সিরা নেই, তবু সেই পাড়া পার্সিবাগান বলেই লোকে আজও চেনে। বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই কলকাতা ছাড়ছেন পার্সিরা। এ শহরে পার্সি রেস্তরাঁর উদ্ভব তাই নিঃসন্দেহে উলটপুরাণ।
কলকাতার কফি হাউস বা তেলচিটে সাবেক কেবিনের মতো বম্বের ইরানি কাফে মানেও নগরজীবনের একরাশ মায়া। খাবারের স্বাদ ভাল হলেও কোথাও স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব। কোথাও বা পারিবারিক ব্যবসার ধারায় চিড় ধরার লক্ষণ। একটি সর্বভারতীয় রেস্তরাঁ গোষ্ঠী সেই ক্ষয়িষ্ণু কাফে-পরম্পরার গাথা মেলে ধরছে! মুম্বই, দিল্লি, বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদের পরে সোডাবটলওপেনারওয়ালারা এ বার কলকাতায়।
বম্বের ব্রিটানিয়া কাফের তুলনায় ঝকঝকে আলো। তবে মোজ়েইক করা মেঝেয় বাদামি কাঠের টেবিল, চেয়ারে চেনা পরিবেশ। শোকেসে, বয়ামে মাওয়া কেক, নানখাটাই, মশলা বিস্কুট। সাবেক ঠাকুরদা ঘড়িখচিত দেওয়ালে বড় বড় হরফে পার্সি পদবীধারী দারুওয়ালা, গাঞ্জাওয়ালা, বাটলিওয়ালাদের নিয়ে সরস টিপ্পনী। লেখা আছে, ‘এখানে কেউ বাটার চিকেন চাইলে তাকে আমরা ঘেলসাপ্পা বলি।’ গুজরাতি বুলিতে যার মানে বোকার হদ্দ! কান্ট্রি-হেড শেফ ইরফান পবনী বলছিলেন, “একঘেয়ে ক্যাপুচিনোর বদলে কেউ পার্সি ঘরানার ফেটানো দুধ কফির (ফাটেলি কফি) সঙ্গে পুরু মাখন দেওয়া বান রুটি বান মাস্কা, নানখাটাই বা খিমা পাও (কিমা) খেলেও সময়টা দারুণ কাটবে! আর পাটিয়ালা পেগের থেকেও ঢাউস পার্সিদের বাওয়া পেগে চুমুক দিলে তো মনটা তর হবেই!” সঙ্গে ধ্রুপদী বম্বের বড়া পাও বা বড়ে মিয়াঁ
ঘরানার ডিম, মাংসের পুর ঠাসা বৈদা রুটিও মজুত। ডিমপাগল পার্সিদের রীতি মেনে এডু বা ইডা তথা ডিম পোচের চাদর বিছানো নানা পদেই। দু’পাত্তর খেতে মুচমুচে, নরম, চিজ়ে ঠাসা পার্সি চিকেন কাটলেট কবিরাজি কটলেটের শহরেও পরম প্রাপ্তি। আস্ত পমফ্রেটের পত্রানি মচ্ছি, চিংড়ির গরগরে প্যাটি বা আলুভাজা তথা সাল্লি ছড়ানো মাটন বোটিও জমবে। শাশুড়ির রান্না শিম, আলুর পিপরানি গোস্তের মতো পদ মেনুতে নেই বলে হাল্কা আফশোস সুপর্ণার। বলছিলেন, “বিদেশ থেকে ছেলে ফিরলে অবশ্যই এখানে আনব! পার্সিরা থাকুক না থাকুক, সংস্কৃতির নিশানা কিছু খানাপিনা এ ভাবেই থাকবে!”