মানুষই যদি নির্ভয়ে চলতে না পারে, তবে কীসের স্বাধীনতা 

৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপের সঙ্গে সঙ্গে এক সপ্তাহের বেশি ধরে দেশের এক প্রান্তে যা চলছে, তাতে কি স্বাধীনতা দিবসের মহিমাই ক্ষুণ্ণ হচ্ছে না?

Advertisement

আফরোজা খাতুন (সমাজকর্মী)

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৯ ০২:১৫
Share:

বেড়াজাল: ঝামেলা এড়াতে কার্ফু জারি রয়েছে সর্বত্র। সুনসান শ্রীনগরের লালচক চত্বর। ছবি: পিটিআই

৭৩তম স্বাধীনতা দিবস আজ বড়সড় প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে। স্বাধীনতা কী, তা নিয়েই এখন প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। এ দেশে এখন ধর্মের নামে উন্মাদনা চলছে, চলছে সংখ্যালঘুদের উপরে নির্বিচারে আক্রমণ। দেশমাতার প্রতি সংখ্যালঘুদের কতটা ভক্তি, প্রতিনিয়ত সেই পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। কখনও ‘জয় শ্রীরাম’, কখনও ‘ভারত মাতা কি জয়’ স্লোগান বলে প্রমাণ দিতে হচ্ছে যে ‘আমি তোমাদেরই লোক’। পরীক্ষকের ভূমিকায় রয়েছেন গোরক্ষকেরা। পাশ করলে তবেই মিলছে বেঁচে থাকার ছাড়পত্র। নচেৎ গণপিটুনি। তবে ‘জয় শ্রীরাম’ আউরেও যে সব সময়ে ছাড় মিলছে, তা নয়। এমতাবস্থায় ভারতের নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিতেই তো আটকাচ্ছে! প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে, এ কোন স্বাধীনতা?

Advertisement

আগেও বিভাজন-বিদ্বেষ ছিল বটে, তবে একটা আড়াল ছিল। এখন সব কিছুই প্রকাশ্যে। তাই সংক্রামক ব্যাধির মতোই ছড়িয়ে পড়েছে অসহিষ্ণুতা। জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করার নামে দেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করার এই প্রবণতার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অথচ তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে সেই উগ্র জাতীয়তাবাদের পালেই হাওয়া দিয়ে চলেছি আমরা।

৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপের সঙ্গে সঙ্গে এক সপ্তাহের বেশি ধরে দেশের এক প্রান্তে যা চলছে, তাতে কি স্বাধীনতা দিবসের মহিমাই ক্ষুণ্ণ হচ্ছে না? ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপ ঠিক না ভুল, সেই বিতর্কে না ঢুকলেও যে ভাবে এটি করা হল, সেই পদ্ধতি নিয়েই তো প্রশ্ন উঠছে।

Advertisement

গত ১০ দিন ধরে সেখানে সংবাদপত্র বন্ধ, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, চলছে কার্ফু। অথচ আজ এই কাশ্মীরেও না কি উড়বে জাতীয় পতাকা! স্বাধীনতার শুভেচ্ছা জানানো হবে! কিন্তু কাকে? ভূখণ্ডকে? নাকি সেখানকার মানুষকে? আমরা কাশ্মীরকে আপন করতে চেয়েছি, কিন্তু কাশ্মীরিদের

আপন বলে ভাবতে পেরেছি কি? ‘কাশ্মীর কি কলি’ বিয়ে করার সম্ভাবনায় উৎফুল্ল হয়েছি, কিন্তু বাড়ি ফিরতে না পারা ছেলেমেয়েদের কষ্টে শামিল হতে পেরেছি কি? নাকি সেখানেও ঢুকে পড়েছে ধর্মীয় বিভাজন, কাশ্মীরি পণ্ডিতদের প্রসঙ্গ তুলে কাশ্মীরি মুসলিমদের জব্দ করার মানসিকতা? স্বাধীনতার অর্থ যেখানে স্ব-অধীন, সেখানে কাশ্মীরের পথে পথে নিয়ন্ত্রণ, বন্দুক, কার্ফু।

স্বাধীনতা কোথায়?

আসলে হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টানরা নন, এ দেশে সমস্যা বেশি ‘বাদী’দের নিয়ে। যতই ডিজিটাল ইন্ডিয়া বা ‘সব কা সাথ সব কা বিকাশ’-এর বুলি আওড়ানো হোক, এই হিন্দুত্ববাদী-মৌলবাদীদের দৌলতেই দেশ ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে। মা-কে ভালবাসি, সেটাও বুক চিরে দেখিয়ে প্রমাণ করতে হচ্ছে! রবীন্দ্রনাথের বিশ্ব মানবতাবাদের আদর্শের বদলে উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রভাবে দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে আমাদের। বালাকোট হামলার খবরে আমস্টারডামে বহু প্রবাসীকে দেখেছিলাম প্রবল খুশি হতে। ভাবটা এমন, যেন পাকিস্তানকে বেশ একটা জব্দ করা গিয়েছে।

দেশের জন্য প্রতিরোধ প্রয়োজন ঠিকই, কিন্তু এই প্রতিশোধের ভাবনায় খুশি হওয়ার মধ্যেও কি ধর্মীয় ভেদাভেদ মিশে নেই? কাশ্মীর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাই কি তাঁদের জব্দ করাতেই বেশি আনন্দ? নাগরিকপঞ্জি তৈরি করে, দেশবাসীর একাংশকে একঘরে করে দিয়ে ক্রমে হিন্দুত্ববাদী দেশ বানানোর চেষ্টা? প্রতিরোধ গড়তে গেলেই দেশদ্রোহী বলে দেগে দেওয়ার চেষ্টা?

দেশের মানুষই যদি নির্ভয়ে চলতে না পারে, তবে কীসের স্বাধীনতা?

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

অনুলিখন: স্বাতী মল্লিক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement