বাড়িতে স্টুডিও করছি, মাসিকে বলেছিলেন পার্থ

দিন কয়েক আগেই মাসির সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছিল পার্থ দে-র। মামাবাড়ির সঙ্গে তাঁর পুরনো সম্পর্কের কথা তুলে পার্থ সে দিন মাসিকে বলেন, ‘‘ও সব কথা আর তুলো না! মেনি স্কেলিটনস উইল কাম আউট ফ্রম দ্য কাবার্ড!’’ এই ইংরেজি প্রবাদের বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায়, ‘পুরনো কাসুন্দি না ঘাঁটাই ভাল’।

Advertisement

সুনন্দ ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০১৫ ০৩:১৮
Share:

দিন কয়েক আগেই মাসির সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছিল পার্থ দে-র। মামাবাড়ির সঙ্গে তাঁর পুরনো সম্পর্কের কথা তুলে পার্থ সে দিন মাসিকে বলেন, ‘‘ও সব কথা আর তুলো না! মেনি স্কেলিটনস উইল কাম আউট ফ্রম দ্য কাবার্ড!’’

Advertisement

এই ইংরেজি প্রবাদের বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায়, ‘পুরনো কাসুন্দি না ঘাঁটাই ভাল’। দিদির ছেলের মুখে ওই কথা শুনে মাসিও তেমনটাই ভেবেছিলেন। কিন্তু বৃহস্পতিবার পার্থর ঘর থেকে মানুষ ও কুকুরের কঙ্কাল পাওয়ার খবর শুনে ইংরেজি প্রবাদটির কথাই সবার আগে মনে এসেছিল মাসি অঞ্জলি দে সিংহ-র। তবে কি পার্থর অবচেতনে সব সময় কঙ্কাল ঘোরাফেরা করত? ভাবতে ভাবতে দীঘর্শ্বাস ফেলেছিলেন অঞ্জলিদেবী।

কঙ্কাল-কাণ্ডের তদন্তে নেমে অঞ্জলিদেবীর সঙ্গেই বারবার কথা বলছেন কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা অফিসারেরা। পার্থদের বাড়ি থেকে পাওয়া মোবাইলের কল লিস্ট থেকে মাসির নম্বর পেয়েছে পুলিশ। লালবাজারের দাবি, গত কয়েক মাসে মাসির নম্বরেই সব চেয়ে বেশি ফোন গিয়েছে পার্থদের মোবাইল থেকে। শনিবার অঞ্জলিদেবী বলেন, ‘‘আমার কিছু লুকনোর নেই। পুলিশকে সব বলেছি। সব রকম সহযোগিতা করব।’’

Advertisement

৩ নম্বর রবিনসন স্ট্রিটে পার্থদের বাড়ি থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে পার্থর মামার বাড়ি। সেখানে থাকেন তাঁর ছোট মামা অবিবাহিত ধ্রুবআলো দে (৮৩) এবং ছোট মাসি অঞ্জলিদেবী (৭১)। অঞ্জলিদেবীর পরিবার থাকে পুণেতে। মেয়ে আত্রেয়ী মাঝে মাঝে বেলগাঁও থেকে আসেন মা আর মামাকে দেখতে। পার্থর মা আরতিদেবী ছিলেন অঞ্জলিদেবীর থেকে চার বছরের বড়। ‘‘২০০৫ সালে দিদির মৃত্যুর পর জামাইবাবু, মানে অরবিন্দ দে এবং তাঁদের দুই সন্তান পার্থ ও দেবযানী সব সম্পর্ক ছিন্ন করে দেওয়ায় ওঁদের প্রায় ভুলতে বসেছিলাম’’, বলেন অঞ্জলিদেবী। মনোবিদদের ব্যাখ্যা, হতে পারে আরতিদেবীর মৃত্যুর পরে এতটাই ভেঙে পড়েছিলেন পরিবারের বাকি তিন সদস্য যে, নিকটাত্মীয়দের সঙ্গেও মেলামেশা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

দূরত্ব আচমকাই সরে যায় গত মার্চে। প্রায় তিন মাস আগে একটি অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসে ধ্রুবআলো দে-র মোবাইলে। তিনি তখন বেশ অসুস্থ। ভাল করে কানে শুনতেও পান না। ফোনটি কিছুক্ষণ বেজে কেটে যাওয়ার পরে ওই নম্বরে ফোন করেন অঞ্জলিদেবী। ভেসে আসে জামাইবাবুর কন্ঠস্বর। আকাশ থেকে পড়েন অঞ্জলিদেবী। জামাইবাবুকে বলেন, ‘এত দিন পরে আমাদের মনে পড়ল!’ অঞ্জলিদেবীর কথায়, ‘‘এর কয়েক দিন পরে আমাকে ফের অবাক করে দিয়ে দরজায় কড়া নাড়েন অরবিন্দবাবু। মাঝে দশ-দশটা বছর!’’

গোয়েন্দাদের অঞ্জলিদেবী জানিয়েছেন, সে দিনের পর থেকে অরবিন্দবাবু যোগাযোগ বাড়াতে থাকেন। কখনও ফোনে, কখনও সশরীরে হাজির হয়ে। তৃতীয় দিন তাঁর সঙ্গেই হাজির হন পার্থ। এক দশক পর পার্থকে দেখে প্রথমে চিনতেই পারেননি তাঁর মাসি। পরে বুঝতে পেরে কেঁদে ফেলেন। অঞ্জলিদেবীর কথায়, ‘‘মাসি তো মায়ের মতোই। পার্থ, বাণী (দেবযানীর ডাকনাম) আমার সন্তানতুল্য। সে দিন সোফায় একটু আড়ষ্ট হয়ে বসেছিল ও।’’

কী কথা হয়েছিল?

পুলিশকে অঞ্জলিদেবী জানিয়েছেন, সে দিন কথায় কথায় উঠে এসেছিল দেবযানীর প্রসঙ্গ। পার্থ তাঁকে জানিয়েছিলেন, ও ব্যস্ত। গানবাজনা নিয়েই থাকে (পুলিশকে অবশ্য পার্থ জানিয়েছেন, দেবযানীর মৃত্যু হয়েছে গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর এবং দিদির কঙ্কালের সঙ্গে তিনি একই ঘরে থাকেন)। পার্থ নিজে তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা টিসিএস-এ তখনও চাকরি করছেন কি না, সে কথাও জানতে চেয়েছিলেন মাসি। পার্থ জানান, তিনি ওই চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। বাড়িতেই একটা স্টুডিও তৈরি করছেন। বলেন, তাঁর দিদির অনেক গান রয়েছে, পিয়ানোর রেকর্ডিং রয়েছে। সেগুলো থেকে সিডি তৈরির জন্যই স্টুডিও তৈরির ভাবনা। অঞ্জলিদেবীর কথায়, ‘‘টিসিএস-এর চাকরি ছেড়ে বাড়িতে স্টুডিও করছে শুনে কেমন যেন খটকা লেগেছিল আমার!’’

পার্থর সঙ্গে আরও কয়েক দফা কথা হওয়ার পরে তাঁকে ‘অস্বাভাবিক’ মনে হয় অঞ্জলিদেবীর। ইতিমধ্যে এপ্রিলে কলকাতায় আসেন তাঁর মেয়ে আত্রেয়ী। তত দিনে মাসির মোবাইলে নিয়মিত ফোন করতে শুরু করেছেন পার্থ। দিনে ছ’বার পর্যন্ত ফোন করেছেন বলে জানিয়েছেন পার্থর মাসি। নিজের জন্মদিনে তাঁদের আমন্ত্রণ জানানো, না গেলে খাবার পাঠানো, ২০০৫ সালে কেনা আত্রেয়ীর জন্য উপহার দশ বছর পর তাঁর হাতে তুলে দেওয়া, বারবার বাড়িতে যাওয়ার অনুরোধ, বাড়ির নিরাপত্তারক্ষীকে দিয়ে নিয়মিত বিভিন্ন আধ্যাত্মিক গানের সিডি এবং বই পাঠানো চলতে থাকে।

এক সময় নিজেদের গুটিয়ে নেওয়া এবং দশ বছর বাদে পার্থ ও অরবিন্দবাবুর নিয়মিত যোগাযোগের কারণ কী, তা এখনও রহস্য অঞ্জলিদেবীর কাছে। পুলিশকেও তিনি সে কথা জানিয়েছেন। তবে মনোচিকিৎসক জয়রঞ্জন রামের ব্যাখ্যা, ‘‘শেষের দিকে অরবিন্দবাবুর মন হয়তো কোনও কারণে অশান্ত হয়ে উঠেছিল। সমাজ থেকে নিজেদের এত দিন বিচ্ছিন্ন করে রাখার পরে এ বার তাঁরা মানসিক ভাবে বাইরের সমর্থন চাইছিলেন। বাইরের লোকদের সঙ্গে মেলামেশা করে হারিয়ে ফেলা শক্তি ফিরে পেতে চাইছিলেন।’’

তবে অঞ্জলিদেবীর মনে হয়েছে, ‘‘একটি অদৃশ্য বৃত্ত ছিল ওই চার জনকে ঘিরে, যার ভিতরে কাউকেই ঢুকতে দেওয়া হতো না।’’ দুই ভাই-বোন ছিলেন খুব পড়ুয়া, নিয়ম মেনে চলা। অনেক বড় হতে হবে, পরীক্ষায় প্রথম হতে হবে গোছের মানসিকতা ছিল। সেই পার্থই এত বছর পরে গত ৭ জুন শেষ বারের মতো মাসিকে ফোন করে বলেছিলেন, ‘‘আজ, মায়ের (আরতিদেবীর) জন্মদিন। তোমরা পিৎজা খেও। খুব ভাল থেকো।’’

ফোনটা পেয়ে কেমন অস্বস্তিই হয়েছিল মাসির। এর দিন দুয়েক পরেই অরবিন্দবাবুর আত্মহত্যা। আর তার পরেই পার্থর ঘরে উদ্ধার হয় কঙ্কাল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement