১৮২৭ সালে কলকাতার তৎকালীন শেরিফ টি সি প্লাউডেন-এর কাছে একটি আবেদন জমা পড়ল। তাতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে জেমস পামার, আলেকজ়ান্ডার কলভিনের মতো সাহেবের পাশাপাশি সই করেছিলেন রাধাকান্ত দেব, হরিমোহন ঠাকুর, রূপলাল মল্লিক, শাহ গোপাল দাস, মনোহর দাস প্রমুখ, দেশের নানা অঞ্চল থেকে শহরে আসা মানুষ। তবে দরখাস্তের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যের সঙ্গে এই স্বাক্ষরকারীদের সরাসরি কোনও সম্পর্ক ছিল না। আবেদনটি ছিল ইংরেজ ছাড়া শহরের অন্যান্য ইউরোপীয় নাগরিকদের কেনা জমির উপর তাঁদের উত্তরাধিকারীদের অধিকারের স্বীকৃতি সংক্রান্ত। সংশ্লিষ্ট ইউরোপীয়দের পক্ষ থেকেই আবেদন করা হলেও, জাতিনির্বিশেষে কলকাতাবাসী তার পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন, বক্তব্য এমনই। সকল শ্রেণির মানুষের উৎসাহে শহর যেন আন্তর্জাতিকতায় উত্তীর্ণ হচ্ছে।
হবে না-ই বা কেন। উনিশ শতকের প্রথমার্ধেই কোলসওয়ার্দি গ্রান্ট এ শহরে দেখতে পাচ্ছেন বাঙালির সঙ্গে পার্সি আরবি ইহুদি মারওয়াড়ি আর্মানি মাদ্রাজি শিখ তুর্কি ইরানি চিনা বর্মির একত্রবাস। স্বভাবতই একের যাপন প্রভাবিত করছিল অন্যকে। বদল আসছিল শহরের সামাজিক জলহাওয়ায়। ১৮৭১ সালে ভারত সরকারের কাছে নিজের প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ের অনুমোদনের জন্য ওয়াজিদ আলি শাহ প্রস্তাব পাঠাচ্ছেন। সেখানে জানাচ্ছেন, বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষা ও আরবি বর্ণমালার পাশাপাশি ইংরেজি, বাংলাও শিখতে হবে। বংশগৌরব প্রদর্শনের প্রয়োজন নেই, বরং প্রতিদিন বাধ্যতামূলক শারীরিক কসরত শিখতে হবে, সম্ভবত ক্রিকেট খেলাও।
এক দিকে রাস্তাঘাট, পানীয় জল, নিকাশি ব্যবস্থা-সহ পুর-পরিষেবা গড়ে ওঠা, অন্য দিকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিক্ষার উন্নতিতে নাগরিকদের সামনে তখন খুলে যাচ্ছে উন্নত জীবনযাপনের সুযোগ। ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮২৩-এই কলিকাতা কমলালয় গ্রন্থে এ শহরকে বলছেন ‘মহানগর’, ক্ষুদ্র গণ্ডির বাইরে বিশ্বচেতনার স্বাদ পাচ্ছেন কলকাতাবাসী। তাঁদের একটি অংশে গড়ে উঠছে প্রতিবাদী চরিত্রও, পরে যা স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠবে। এর পাশাপাশি সমাজে নানা দুর্নীতি, জাতিগত রেষারেষি আর বাবু কালচারের নামে সামাজিক স্খলনও দেখা দিচ্ছে, সব পেরিয়ে কলকাতা এগোতে চাইছে অগ্রগতির পথে।
উনিশ শতকে কলকাতার এই উত্তরণের যাত্রা তুলে ধরার প্রয়াস সৌমিত্র শ্রীমানীর কলকাতায় উনিশ শতক (অরুণা প্রকাশন) বইটি। কলকাতাকে এক স্বতন্ত্র অবয়ব দানে শহরবাসীর ভূমিকার উপর আলো ফেলে এ বই। সেখানে উঠে এসেছে শহরের দেশি-বিদেশি অধিবাসীদের কথা, শাসকদের বেহিসাবি জীবন, আবার নাগরিক সম্পত্তি ও ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষায় তাঁদের ভূমিকাও। পরবর্তী কালেে দেশের নেতৃত্ব কাঁধে তুলে নেওয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান ও শহরের সামগ্রিক চরিত্র গড়ে তুলতে তার ভূমিকাও আলোচিত। গণ্ডগ্রাম থেকে ভারতের প্রথম মেট্রোপলিটন শহর হিসাবে কলকাতার আত্মপ্রকাশের এই বিবরণী বর্তমানের সামনেও এক আয়না তুলে ধরে। ছবিতে ১৮৭০-এর দশকের কলকাতার ক্লাইভ স্ট্রিট, উইকিমিডিয়া কমনস থেকে।
অমলিন
মার্চের প্রথম দিকে লেখা বুদ্ধদেব বসুর চিঠিটি কানপুর নিবাসী জামাতা প্রদীপ ঘোষের কাছে অভিনব মনে হয়েছিল। ১৯৭৪, কলকাতা তখন লোডশেডিংয়ে নিষ্প্রদীপ প্রায়শ। কনিষ্ঠা কন্যার স্বামীকে শ্বশুরমশাই লিখছেন: “কাজের পুঞ্জ, চক্ষুতে ছানি,/ দেশ বিদ্যুৎহীন।/ কবে দেখা দেবে সদীপ প্রদীপ/ তাই ভাবি নিশিদিন।” পঞ্চাশ বছর আগের এই চিঠি লেখার ঠিক বারো দিন পরে প্রয়াত হন বুদ্ধদেব। তাঁর সঙ্গস্মৃতিসুধায় ভরে উঠেছে প্রদীপ ঘোষের বই বুদ্ধদেব বসুর সান্নিধ্যে (প্রকা: অহর্নিশ), যার নতুন সংস্করণটিতে বুদ্ধদেব, প্রতিভা বসু ও নবনীতা দেব সেনের একগুচ্ছ অপ্রকাশিত চিঠি, মূল্যবান ছবি। আগামী ১৮ মার্চ বিকেল সাড়ে ৫টায় মহাবোধি সোসাইটিতে আনুষ্ঠানিক প্রকাশ, বুদ্ধদেবকে নিয়ে বলবেন সুচরিতা গুহ জিৎ মুখোপাধ্যায় ও মোস্তাক আহমেদ। দ্বিতীয় পর্বে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থীদের উপস্থাপনা ‘বিপন্ন বিস্ময় বু.ব.’। সঙ্গের ছবিটি নরেশ গুহের তোলা, ১৯৭০-এ।
কর্মীর অধিকার
সমাজ তাঁদের বলে যৌনকর্মী, কিন্তু ‘কর্মী’ হিসাবে মর্যাদা দেয় না। স্বাভাবিক ভাবেই কর্মীর নানা অধিকার ও সুযোগসুবিধা থেকেও তাঁরা বঞ্চিত। কলকাতার সোনাগাছি অঞ্চলের যৌনকর্মীদের আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তাঁদের বৃত্তির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ করেছেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক স্বাতী ঘোষ, তাঁর দ্য জেন্ডারড প্রোলেতারিয়েত: সেক্স ওয়ার্ক, ওয়ার্কারস’ মুভমেন্ট অ্যান্ড এজেন্সি (অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস) বইয়ে; উপনিবেশ ও উত্তর-ঔপনিবেশিক কালে ভারতে যৌনকর্মীদের জীবিকার গবেষণায় আলো ফেলেছেন তাঁদের অধিকারে। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের আবহে গত ৭ মার্চ দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোচনা হল বইটি ঘিরে, বললেন স্বাতী ঘোষ পায়েল রায়চৌধুরী দত্ত বৃষ্টি বসু প্রমুখ।
স্মার্ট অ্যালবাম
রেকর্ড-ক্যাসেট-সিডি অতীত, সঙ্গীত-বিনোদনের উপায় এখন ডিজিটাল মাধ্যম। এই আবহেই নতুন বিকল্প ‘স্মার্ট অ্যালবাম’, যার সাহায্যে ক্লান্তিকর খোঁজাখুঁজি এড়িয়ে প্রিয় শিল্পীদের গান নাচ অভিনয় গল্পপাঠ ইত্যাদি শোনা-দেখা যাবে সরাসরি, ঠিক আগেকার মতো। এ হল একটা ছোট্ট প্লাস্টিক কার্ড, যার এক দিকে অ্যালবামের তথ্য, অন্য দিকে নিয়মাবলি ও কোড, স্মার্টফোনের স্ক্যানার দিয়ে যা স্ক্যান করলেই খুলে যাবে অ্যালবাম। ব্লুটুথ দিয়ে সাউন্ড সিস্টেম-হোম থিয়েটারে জোড়াও যাবে। অনবদ্য এই উদ্ভাবনটি ডা. পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকারের। আজ ১৬ মার্চ বিকেল সাড়ে ৫টায় বাংলা আকাদেমি সভাঘরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে আনুষ্ঠানিক প্রকাশ, বিশিষ্টজনের উপস্থিতিতে।
গানে বাদনে
সিমলে পল্লির নরেন্দ্রনাথের ভিটেয় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ‘রবিবাবু’র গান, সরোদের যুগলবন্দিতে। আজ বিকেল ৫টায় রামকৃষ্ণ মিশন স্বামী বিবেকানন্দের পৈতৃক আবাস কেন্দ্রে মনোময় ভট্টাচার্য ও দেবজ্যোতি বসুর পরিবেশন, সঙ্গতে শুভজ্যোতি গুহ। সুতানুটি পরিষদ চোরবাগান অঞ্চল আয়োজিত এই উদ্যোগে সংবর্ধিত হবেন অনিন্দ্য মিত্র, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতি ওঁর সনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষকতার জন্য। অন্য দিকে, এস এন বি ফাউন্ডেশনের নিবেদনে দশম ‘ঋতচ্ছন্দ উৎসব’ উত্তম মঞ্চে; আজ ৫টায় সরোদ কণ্ঠসঙ্গীত চতুরঙ্গ-গিটার সেতারবাদনে সুনন্দ মুখোপাধ্যায় বিদুষী ভারতী প্রতাপ পণ্ডিত দেবাশিস ভট্টাচার্য বিদুষী মিতা নাগ; রবিবার ৬টা থেকে ভরতনাট্যম ওড়িশি কত্থক কথাকলির সম্ভার।
সময়ের জলছবি
বাংলাদেশের মানুষ মুকুল আহমেদ, স্থায়ী বাস লন্ডনে। প্রায় প্রতি বছর কলকাতা আসেন ওঁর নাটকের দল ‘মুকুল অ্যান্ড গেটো টাইগারস’ নিয়ে। এ বার একা এসেছেন, কিন্তু ‘হাওড়া জোনাকি’ নাট্যদলকে সঙ্গে নিয়ে তৈরি করেছেন শেক্সপিয়র ও গ্রিক ক্যানন-নির্ভর, মোনোলগধর্মী ছ’টি ছোট নাটক। আখ্যান যতই পুরনো হোক, কোথায় যেন বড্ড মিল এই সময়ের সঙ্গে; এখনকার সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্যাই ওঁকে চালিত করেছে এই নির্মিতিতে। মিরান্ডা, শায়লা অ্যান্ড টনি, গায়ত্রী, আগামেমনন, ক্লাইটেমনেস্ত্রা ও মেদেয়া— ত্রিশ মিনিটের এক-একটি উপস্থাপনা, সময়েরই জলছবি। শেক্সপিয়রের দ্য টেম্পেস্ট, দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিস, হ্যামলেট থেকে শুরু করে গ্রিক আখ্যান-ভাঙা এই প্রযোজনা— কনফ্লুয়েন্স অব ট্র্যাজেডি— অভিনীত হবে ১৮ ও ১৯ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়, সল্ট লেকে ‘অন্য থিয়েটার’ ভবনে।
বিভূতি-স্মৃতি
বাবা যখন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ছেলের জীবনে তখন পরম সম্পদ পিতৃস্মৃতি। তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সেই স্মৃতিকথা লিখেছিলেন ‘পিতা নোঽসি’ নামে, উদ্বোধন পত্রিকায় প্রকাশ পায় ২০০৮-২০১০ সময়কালে। ২০১০-এর জুলাইয়ে প্রয়াত হন তারাদাস, শেষ দিকে স্ত্রী মিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘ডিক্টেশন’ নিয়ে তৈরি করেছেন লেখা, এমনও হয়েছে। স্বামী শাশুড়ি-সহ গজেন্দ্রকুমার মিত্র, সুমথনাথ ঘোষ, প্রমথনাথ বিশী, প্রবোধ সান্যাল প্রমুখের কাছেও মিত্রা শুনেছেন বিভূতিভূষণ নিয়ে বহু অজানা কথা। এই সবই এ বার গ্রন্থিত হল পিতা নোঽসি: পুত্র ও পুত্রবধূর কৌতূহল জাগানো স্মৃতিকথা (দীপ প্রকাশন) নামে। গত ১১ মার্চ কলেজ স্ট্রিটে দীপ প্রকাশনের বইঘরে হল আনুষ্ঠানিক প্রকাশ, ছিলেন মিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতি-পৌত্র তথাগত বন্দ্যোপাধ্যায়, পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, প্রণতি ঠাকুর প্রমুখ। ছবিতে সপরিবার বিভূতিভূষণ ও তাঁর ঘাটশিলার বাড়ি।
কেবলই ছবি?
সে ছিল এক আশ্চর্য বিকেল। বাবা কাপড় পরিয়ে, চুল আঁচড়ে দিয়ে সঙ্গে নিয়ে বেরোলেন। বিশাল এক মাঠ, কোত্থেকে দুই পরি এসে, হাতে ফুল গুঁজে দিয়ে, ডানায় বসিয়ে উড়ে চলল অথৈ আকাশনীলে; চার পাশে নীলরঙা চাঁদ, কথা-বলা গাছ, প্রজাপতি, ঝিনুক, নদী, পাখি! ঘরে ফেরা হল বুকভরা বিস্ময় আর গোটা বিশ্বপ্রকৃতিটাকেই নিয়ে যেন। ‘বাবাদের সঙ্গে বেড়াতে-যাওয়া’রা কেমন জীবন জুড়ে থাকে, এমনকি বাবারা চলে যাওয়ার পরেও; রোজকার ছোট্ট, তুচ্ছ যত জিনিস, দৃশ্য, রূপকল্পও তখন স্মৃতির রঙ লেগে পাল্টে যায়। কেউ তা ধরেন কবিতায়, গানে, স্বপন নায়ক ধরতে চেয়েছেন আলোকচিত্রে (ছবি)। যতীন দাস রোডে গ্যাঞ্জেস আর্ট গ্যালারিতে ৯ মার্চ থেকে চলছে তাঁর অল্টারনেটিভ ফোটোগ্রাফি প্রদর্শনী ‘অ্যান আফটারনুন উইথ মাই ফাদার’। ২৯ মার্চ পর্যন্ত, রবিবার বাদে, ১১টা-৭টা।
শেষ শিকারি
বাংলা তথা ভারতের কিংবদন্তি ‘শিকারি জুটি’ ছিলেন তাঁরা— চঞ্চল সরকার ও রঞ্জিত মুখোপাধ্যায়। কোনও জঙ্গল বা লোকালয়ে সরকারি ভাবে কোনও হাতিকে ‘খুনী’ বা ‘পাগল’ ঘোষণা করা হলে মানুষের প্রাণ ও সম্পত্তি রক্ষার খাতিরে তাকে মেরে ফেলতে হয়; সেই কাজে ডাক পড়ে সরকারি তালিকাভুক্ত হাতি-শিকারিদের। এ-হেন পরিস্থিতিতেই, বাংলা তথা ভারতের নানা জঙ্গলে ও লোকালয়ে ডাক পড়ত রঞ্জিত মুখোপাধ্যায় ও চঞ্চল সরকারের। সত্তর দশক থেকেই নামডাক, দু’জনেই ছিলেন অসমসাহসী শিকারি। চঞ্চল সরকার চলে গিয়েছেন আগেই, গত ৮ মার্চ শুক্রবার নিউ টাউনে নিজের বাড়িতে ৭৯ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন রঞ্জিত মুখোপাধ্যায়। গোয়েঙ্কা গোষ্ঠীর সিইএসসি ভবনের নিরাপত্তা বিভাগের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন; বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ নিয়ে দেশে-বিদেশে নানা জায়গায় বলেছেন বহু বার। শিকার ও শিকারি দুই-ই এখন গল্পের উপজীব্য, তেমনই অনেক ‘গল্প হলেও সত্যি’র অবসান ঘটল ওঁর জীবনাবসানে।